দারুণ এক প্যারডক্সে বাংলাদেশ। বাংলাদেশে বৈদেশি মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়াকে অর্থনৈতিক সক্ষমতার দিক দিয়ে বিবেচনা করলে এখনই সতর্ক পদক্ষেপ নেয়ার তাগিদ দিয়েছেন বিশ্লেষকেরা। তারা বলছেন, রিজার্ভ কমে যাওয়া মানে হচ্ছে অর্থনেতিক সক্ষমতা কমে যাওয়া। আর তারা পরিস্থিতি সামলাতে কমপক্ষে পাঁচ বিলিয়ন ডলার ঋণ নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন আইএমএফ থেকে।
আবার বিশ্বের আরও কয়েকটি দেশে শ্রীলঙ্কার মতো সংকট হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সংস্থার প্রধান ক্রিস্টালিনা জর্জিভা গত শনিবার বলেছেন, যেসব দেশের ঋণের মাত্রা উচ্চ এবং নীতিমালার পরিসর সীমিত, তারা অতিরিক্ত চাপের মুখে পড়বে। তাদের জন্য শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি একটি সতর্কসংকেত।
আইএমএফ প্রধানের বক্তব্যের সূত্র ধরে বিবিসির এক প্রতিবেদনে ঝুঁকিতে থাকা তেমন কয়েকটি দেশের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশও আছে।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে গত মে মাসে মুদ্রাস্ফীতির হার ৭ দশমিক ৪২ শতাংশে পৌঁছেছে, যা ৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। রিজার্ভের পরিমাণ কমে যাওয়ায় জরুরি নয় এমন পণ্য আমদানি বন্ধ করতে দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার। প্রবাসীদের কাছ থেকে রেমিট্যান্স পেতে বিভিন্ন বিধান শিথিল করা হয়েছে। কর্মকর্তাদের বিদেশে ভ্রমণও কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এস অ্যান্ড পি গ্লোবাল রেটিংসের বিশ্লেষক কিম এং তান বিবিসিকে বলেন, আমদানি আয় ও রপ্তানি ব্যয়ের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ঘাটতিতে থাকা বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা সরকারকে ভর্তুকি বাড়াতে ব্যাপক প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হবে। পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা অর্থনৈতিক সহায়তার জন্য ইতিমধ্যে আইএমএফ ও অন্য দেশের সরকারের দ্বারস্থ হয়েছে।
কিম এং তান আরও বলেন, বাংলাদেশকে সরকারি ব্যয়ের বিষয়টিকে পুনঃ অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং ভোক্তা পর্যায়ে কেনাকাটার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করতে হবে।
১৪০ বিলিয়ন ডলারের ঋণ
বাংলাদেশ বিভিন্ন মেগা প্রকল্পে ১৪০ বিলিয়ন ডলারের ঋণ নিয়েছে। ২০২৩ সাল থেকে ঋণ পরিশোধ শুরু করতে হবে। ফলে ২০২৩-২৪ সাল থেকে পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এদিকে বাংলাদেশে বৈদেশি মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ায় আইএমএফ থেকে কমপক্ষে পাঁচ বিলিয়ন ডলার ঋণ নেওয়ার পরামর্শও দিয়েছেন বিশ্লেষকেরা। তারা বলছেন, রিজার্ভ কমে যাওয়া মানে হচ্ছে অর্থনেতিক সক্ষমতা কমে যাওয়া।
সর্বশেষ রপ্তানি ব্যয় পরিশোধের পর বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে ৩৯.৭৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়ায়। গত সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নকে (এসিইউ) ১.৯৯ বিলিয়ন ডলার আমদানি ব্যয় নিস্পত্তির পর রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে যায়। গত ডিসেম্বরে রিজার্ভ ছিলো ৪৬.১৫ বিলিয়ন ডলার।
গত দুই বছরের মধ্যে এই প্রথমবারের মতো রিজার্ভের পরিমান ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে গেল। ২০১৩ সাল থেকে বাংলাদেশের রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকে। ওই বছরের জুন মাসের শেষে রিজার্ভের পরিমান ছিলো ১৫.৩২ বিলিয়ন ডলার। গত বছরে আগস্টে প্রথমবারের মত রিজার্ভের পরিমাণ ৪৮.০৬ বিলিয়ন ডলার হয়। এরপর কমতে থাকে। গত অর্থবছরের শেষ দিন ৩০ জুন রিজার্ভ ছিলো ৪১.৮৬ বিলিয়ন ডলার।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়া, সেই অনুপাতে রপ্তানি না বাড়া, রেমিটেন্স কমে যাওয়া এবং ডলারের তুলনায় টাকার অবমূল্যায়ন- প্রভৃতি কারণে রিজার্ভ কমে গেছে। আর জ্বালানি আমদানিতে ব্যয় আরও বেড়ে গেলে রিজার্ভে টান বাড়তেই থাকবে। সাধারণভাবে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো রিজার্ভ থাকার কথা বলা হলেও রিজার্ভ কমে যাওয়া অর্থনৈতিক শক্তি কমে যাওয়াকে ইঙ্গিত করে। বাংলাদেশের এখনো পাঁচ-ছয় মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মত রিজার্ভ থাকলেও তাতে আশ্বস্ত হওয়ার কিছু নেই। কারণ আমদানি ব্যয়ের তুলনায় রপ্তানি আয় কমতে থাকলে রিজার্ভও কমতে থাকবে। একই সঙ্গে প্রবাসি আয় কমতে থাকলেও পরিস্থিতি খারাপের দিকে যেতে পারে। বাংলাদেশকে গড়ে মাসে এখন সাত মিলিয়ন ডলারের বেশি আমদানি ব্যয় মেটাতে হয়।
ড. সালেহ উদ্দিন মনে করেন, “এখন যে রিজার্ভের হিসাব দেখানো হচ্ছে তার মধ্যে এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ড (ইডিএফ) আছে। এটা তো রিজার্ভ থেকেই দেওয়া হচ্ছে। এরমধ্যে সাত বিলিয়ন ডলার দেওয়া হয়ে গেছে। সেটা কি ফেরত এসেছে? না আসলে সেই ডলার তো আর রিজার্ভে নেই।”
আরো একটি সমস্যা হলো টাকার অবমূল্যায়ন হওয়ায় পেমেন্ট রেট আরো বেড়ে যাবে বলে জানান তিনি।
এ পরিস্থিতির মধ্যেই ২০২৩ সাল থেকে ঋণ পরিশোধ শুরু করতে হবে। আর সুদ পরিশোধের পরিমাণও বাড়ছে। শুধু রূপপুর পারমানবিক প্রকল্পেই ২০২৩ সাল থেকে বছরে ৫৬৫ মিলিয়ন ডলার সুদ দিতে হবে। সিপিডির বোর্ড অব ট্রাস্টির সদস্য অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য মনে করেন, “ঋণ ও সুদ পরিশোধ করতে গিয়ে ২০২৩-২৪ সাল থেকে পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাবে। রিজার্ভের ওপর তখন আরও অনেক বেশি চাপ পড়বে।”
‘মেগা প্রকল্পের লগ্নি ফেরত না এলে এ দেশও শ্রীলঙ্কা হবে’
দেশের প্রয়োজনে বিভিন্ন মেগাপ্রকল্পের পাশাপাশি কম গুরুত্বপূর্ণ অনেক মেগা প্রকল্পও নেয়া হচ্ছে। কিন্তু এসব প্রকল্পে করা বিনিয়োগ দ্রুত সময়ে ফেরত না এলে বাংলাদেশকেও শ্রীলঙ্কার পরিণতি বরণ করতে হতে পারে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।
শনিবার ইনস্টিটিউট অফ চাটার্ড অ্যাকাউনটেন্টস অফ বাংলাদেশ (আইসিএবি) এবং ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত প্রাক বাজেট আলোচনায় তিনি এ কথা বলেন। রাজধানীর কারওয়ানবাজারে আইসিএবি কার্যালয়ে আয়োজিত এ আলোচনায় প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘শ্রীলঙ্কা থেকে এবং আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এখনই মেগা প্রকল্পগুলো নিয়ে ভাবতে হবে। এসব প্রকল্পে আমরা যে অর্থ বিনিয়োগ করছি, তা যদি সময়মতো ফেরত না আসে, তাহলে বাংলাদেশের অবস্থাও শ্রীলঙ্কার মতো হতে পারে।
আমাদের অনেকগুলো মেগা প্রকল্প হচ্ছে, যেগুলোর প্রয়োজন আছে। কিন্তু এমন অনেকগুলো আছে, যেগুলোর এই মুহূর্তে আসলে কোনো উপযোগিতা বা প্রয়োজন নেই। পদ্মাসেতু আমাদের দরকার আছে, যদিও এখানে ব্যয় বেড়েছে অনেক। কিন্তু ওই রুটে পদ্মা রেল সেতুর খুব একটা প্রয়োজন নেই। কারণ পদ্মা সেতু হওয়ার কারণে ওই এলাকা থেকে সহজেই পণ্য ঢাকায় আসবে, আবার নৌ পথ রয়েছে। এখানে রেলপথে যে এক্সট্রা ভ্যালু এডিশন হওয়ার কথা, সে সুযোগ নেই। যে বিশাল বিনিয়োগ হচ্ছে, সেটা ফেরত আসার সুযোগ নেই।
আমাদের ঢাকা-চট্টগ্রাম রেল লাইন হচ্ছে, তা দরকার আছে। এই পথে আরো বিনিয়োগ দরকার। কারণ এটা আমাদের অর্থনীতির লাইফ লাইন। কিন্তু আমাদের বিশাল টাকা খরচ করে মিয়ানমার সীমান্ত পর্যন্ত রেললাইন বসানোর কোনো দরকার নেই। মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের এমন কোনো বাণিজ্য হবে না, যা দিয়ে এই বিনিয়োগ ফেরত আসতে পারে।
রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পে আমাদের ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য আমার আড়াই বিলিয়ন ডলারের জায়গায় ১৩ বিলিয়ন ডলার খরচ করেছি। এই প্রকল্প হয়তো আমাদের দীর্ঘ মেয়াদে কাজে আসবে। কিন্তু আমাদের টাকা তো এখন দরকার। এ টাকা দিয়ে যদি আমরা আমাদের সবগুলো হাইওয়ে ফোরলেন করে ফেলতাম, সড়কগুলো আরো চওড়া করতে পারতাম, তাহলে রেট অফ রিটার্ন অনেকগুণ বেশি পেতাম। অর্থনীতিতে আরও দ্রুত উপকার পাওয়া যেত।
তবে যেটা হয়ে গেছে, সেটা হয়ে গেছে, সেখানে তো কিছু করার নাই। সামনের মেগা প্রকল্প নিয়ে এখনই ভাবতে হবে। কারণ এইভাবে যদি আমরা মেগা প্রকল্পগুলোতে বিনিয়োগের কোনো অর্থ ফিরে না পাই, তাহলে আমাদের অবস্থাও শ্রীলঙ্কার মতোই হবে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩১৫
আপনার মতামত জানানঃ