সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অং সান সু চির নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত ও ক্ষমতার পালাবদলের পর থেকে মিয়ানমারে অস্থিতিশীলতা জারি রয়েছে।এই ঘটনার পর দেশটিতে তীব্র গণ-আন্দোলন শুরু হয় এবং সামরিক ক্ষমতার জোরেই বার্মিজ সেনাবাহিনী তা দমনের চেষ্টা করে। এতে নিহত হচ্ছে শিশু নারীসহ অনেক বেসামরিক মানুষ।
মিয়ানমারের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের সাগাইংয়ে হামলা চালিয়েছে দেশটির সামরিক বাহিনী। অঞ্চলটির চারটি গ্রামে রাশিয়ার তৈরি হেলিকপ্টার দিয়ে হামলা চালানো হয়। প্রাণে বাঁচতে সেখানকার ১০ হাজারের বেশি বেসামরিক মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছে।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের সূত্রে জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার সামরিক হেলিকপ্টার নিয়ে নামিয়ার গ্রামে অভিযান চালায় সামরিক বাহিনী।
এর মধ্যে দু’টি রাশিয়ার তৈরি এমআই-৩৫ হেলিকপ্টারের মাধ্যমে প্রায় ৪০ মিনিট গুলি চালানো হয়। হামলার সময় ৫০ বছর বয়সী এক নারী নিহত হন।
স্থানীয় মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো বলছে, হামলায় আরো কয়েকজন গ্রামবাসী আহত হয়েছে। গত ১ ডিসেম্বের থেকে চলতি বছরের ৩১ মে পর্যন্ত মিয়ানমারজুড়ে দুই হাজার ৮০০ যুদ্ধাপরাধের ঘটনা ঘটেছে।
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গণতন্ত্রকামী নেত্রী অং সান সু চি নেতৃত্বাধীন সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর মিয়ানমারের ক্ষমতায় আসে দেশটির সামরিক বাহিনী। এর পর থেকে প্রতিনিয়ত আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর সাথে দেশটির গণতন্ত্রকামী আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে।
মিয়ানমারে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে সহিংসতার মুখে অন্তত সাত লাখ মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। আর অভ্যুত্থানের আগে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা কমপক্ষে ৩ লাখ ৬ হাজার। জাতিসংঘের মানবিকবিষয়ক সমন্বয়ের কার্যালয় (ইউএনওসিএইচএ) সম্প্রতি এ তথ্য প্রকাশ করেছে।
সংস্থাটি বলছে, অভ্যুত্থান-পরবর্তী সহিংসতায় মিয়ানমারে প্রথমবারের মতো বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা ১০ লাখের বেশিতে ঠেকেছে। বর্ষা মৌসুম ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে দেশটিতে যুদ্ধের প্রকোপ বাড়ছে বলেও সতর্ক করেছে জাতিসংঘ।
অভ্যুত্থান-পরবর্তী সহিংসতায় মিয়ানমারে প্রথমবারের মতো বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা ১০ লাখের বেশিতে ঠেকেছে। বর্ষা মৌসুম ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে দেশটিতে যুদ্ধের প্রকোপ বাড়ছে বলেও সতর্ক করেছে জাতিসংঘ।
ইউএনওসিএইচএ বলছে, বেসামরিক মিলিশিয়ারা সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে প্রস্তুতি নিচ্ছে। অন্যদিকে তাদের দমাতে আক্রমণাত্মক হয়ে উঠছে সেনারা। গ্রাম ধ্বংস ও বিচারবহির্ভূত হত্যার পাশাপাশি বেসামরিক নাগরিকদের ওপর বিমান হামলা চালাচ্ছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী।
এদিকে মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোর একটি কারাগারে বিচারাধীন ডি-ফ্যাক্টো নেত্রী অং সান সু চি নির্বাচনের জালিয়াতি করার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। কারাগারে প্রতিষ্ঠিত একটি আদালতে তার বিচার করছে জান্তা সরকার। গত মাসে আবাসিক কারাগার থেকে বর্তমান নিভৃত কারাগারটিতে স্থানান্তর করা হয়েছে।
আদালত সূত্র জানিয়েছে, তিনি দণ্ডবিধি আইনের ১৩০(এ) ধারায় নির্বাচন কমিশনকে প্রভাবিত করার যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা কারা আদালতে অস্বীকার করেছেন। এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে। নির্বাচনে সু চির দল ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক লিগ ভূমিধস বিজয় লাভ করে। আটক প্রেসিডেন্ট উইন মিন্ট ও কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী মিন থুকেও এই অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
সূত্রটি জানিয়েছে, ‘সু চি বলেছেন তিনি নির্বাচন কমিশনকে প্রভাবিত করেননি এবং তিনি সঠিক পথেই ছিলেন।’ উইন মিন্তও এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। মিন থুয়ের সাক্ষ্যও গ্রহণ করা হবে। নির্বাচনে প্রতারণার অভিযোগে ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সামরিক অভ্যুত্থানের সময় এই তিনজনকে গ্রেফতার করেছে জান্তারা। তারা সু চির বিরুদ্ধে ১১টি অভিযোগ এনেছে।
এ জন্য তার ১৫০ বছর সাজা হতে পারে।
এর আগে দুর্নীতি, সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে উসকানি, কোভিড নীতি ভঙ্গ এবং টেলিকমিউনিকেশন আইন ভঙ্গ করার অভিযোগে তার বিচার হয়েছে। এ জন্য আদালত তাকে ১১ বছরের সাজা দিয়েছে। অং সান সু চির বর্তমান বয়স ৭৭ বছর। গত ২২ জুন জান্তা সরকার একটি অজ্ঞাত কারাগারে স্থানান্তর করে গোপনে তার বিচার করছে এখন।
২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সুচির নেতৃত্বাধীন গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করে জাতীয় ক্ষমতা দখল করে সামরিক বাহিনী। বন্দি করা হয় অং সান সুচি ও তার দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্র্যাসির (এনএলডি) বিভিন্ন স্তরের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে। সেনা প্রধান মিন অং হ্লেইং এ অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেন।
কিন্তু অভ্যুত্থানের পরপরই ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে মিয়ানমারের গণতন্ত্রকামী জনগণ। রাজধানী নেইপিদো, বৃহত্তম শহর ইয়াঙ্গুন, দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মান্দালয়সহ ছোট বড় বিভিন্ন শহরে জান্তাবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়।
বিক্ষোভ দমনে দেশটির আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রথম দিকে লাঠিচার্য, রাবার বুলেট, টিয়ার শেল, জল কামান ব্যবহার করলেও পরে জান্তার নির্দেশে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করা শুরু করে বাহিনীর সদস্যরা। নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের গুলিতে ইতোমধ্যে দেশটিতে প্রায় ১৫ শ’ মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
দেশটির একটি মানবাধিকার সংগঠনের বরাতে বার্তা সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, মিয়ানমারে গত এক বছরের সংঘাতে ১ হাজার ৫০০ জনের বেশি বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছেন। তাদের বেশির ভাগই জান্তাবিরোধী। নিরাপত্তা বাহিনীর গুলি–হামলায় তারা প্রাণ হারান। এক বছরে দেশটিতে গ্রেপ্তার হয়েছেন ১১ হাজারের বেশি বেসামরিক মানুষ। আর জান্তার হিসাবে, গত ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত মিয়ানমারে ১৬৮ সেনা ও পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৩৩
আপনার মতামত জানানঃ