বিষণ্নতায় ভুগছে ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজার শিশুরা। এ সংখ্যা একশ কিংবা দুইশ নয়; হাজার হাজার। প্রতি পাঁচটি শিশুর চারটিই মানসিক অবসাদ, বিষণ্নতা, ভয় ও আতঙ্ক নিয়ে বড় হচ্ছে।
নতুন এক গবেষণা রিপোর্টে বলা হয়েছে, বর্তমানে উপত্যকার ৮০ শতাংশ শিশুই মানসিক অবসাদে আক্রান্ত।
আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেনের এক প্রতিবেদনে বুধবার(১৫ জুন) এ তথ্য জানানো হয়েছে। ফিলিস্তিনি এ ভূখণ্ডে ইসরায়েলের কঠোর অবরোধের ১৫ বছর পূর্তিতে সেভ দ্য চিলড্রেন এ তথ্য প্রকাশ করল। খবর আলজাজিরা, এএফপির।
ফিলিস্তিনের কট্টর ইসলামপন্থী সংগঠন হামাসের সদস্যরা গাজার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ায় ২০০৭ সালের জুনে ইসরায়েল গাজা অবরোধ করে। ইসরায়েল ও মিশর গাজা উপত্যকা থেকে মানুষজনের যাতায়াত ও প্রয়োজনীয় পণ্যের আনা নেওয়া কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
সেভ দ্য চিলড্রেনের পক্ষ থেকে ‘ট্র্যাপড’ নামের প্রতিবেদনে বলা হয়, গাজার শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। ২০১৮ সালের পর থেকে গাজা উপত্যকায় শিশুদের মধ্যে বিষণ্নতা, দুঃখ ও ভয় ৫৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৮০ শতাংশে পৌঁছেছে।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে গাজা উপত্যকা অবরোধ করে রেখেছে ইসরায়েল। এক যুগের বেশি সময় অবরুদ্ধ জীবনযাপনের কারণে এখানকার বেশির ভাগ বাসিন্দাই এখন মানসিকভাবে অসুস্থ।
সবচেয়ে শোচনীয় অবস্থা এখানকার শিশুদের। রিপোর্টমতে, প্রতি পাঁচটি শিশুর চারটিই মানসিক অবসাদ, বিষণ্নতা, ভয় ও আতঙ্ক নিয়ে বড় হচ্ছে। ‘ট্রাপড’ শিরোনামের রিপোর্টটির জন্য উপত্যকার ৪৮৮ শিশু ও ১৬৮ বাবা-মা ও স্বাস্থ্যকর্মীর সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে। এ ধরনের গবেষণা এর আগে সবশেষ ২০১৮ সালে চালানো হয়েছিল।
অধিকৃত ফিলিস্তিনি অঞ্চলের জন্য সেভ দ্য চিলড্রেনের পরিচালক জেসন লি বলেন, ‘প্রতিবেদন তৈরির জন্য আমরা যেসব শিশুর সঙ্গে কথা বলেছি, তারা প্রায় প্রত্যেকেই ভয়, উদ্বেগ, দুঃখ এবং শোকের চিরস্থায়ী অবস্থায় জীবনযাপন করার কথা বর্ণনা করেছে। তারা আবার কখন সহিংসতা ঘটবে, তার অপেক্ষায় থাকে। এ জন্য তারা ঘুমাতে বা কোনো কিছুতেই মনোযোগ দিতে পারে না।’
জেসন লি আরও বলেন, শিশুদের মানসিক সমস্যার প্রমাণ হিসেবে তাদের বিছানা ভিজিয়ে ফেলা, কথা বলতে না পারা বা সাধারণ কাজগুলো ঠিকমতো করতে না পারার মতো বিষয়গুলো লক্ষ করা যায়। এ মর্মান্তিক বিষয়গুলো দেখে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে জরুরিভাবে জেগে উঠতে হবে।
গাজার ২০ লাখ জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক শিশু। সেভ দ্য চিলড্রেন বলছে, গাজার ৮ লাখের বেশি শিশু–কিশোর বাধাহীন জীবন কী, সেটাই জানে না।
শিশুদের মানসিক সমস্যার প্রমাণ হিসেবে তাদের বিছানা ভিজিয়ে ফেলা, কথা বলতে না পারা বা সাধারণ কাজগুলো ঠিকমতো করতে না পারার মতো বিষয়গুলো লক্ষ করা যায়।
ইসরায়েলের পক্ষ থেকে বলা হয়, তাদের জনগণকে হামাসের হাত থেকে রক্ষার জন্য গাজাবাসীকে অবরুদ্ধ রাখা জরুরি। হামাসকে পশ্চিমা দেশগুলোর অনেকেই সন্ত্রাসী সংগঠনের তকমা দিয়েছে। ২০০৭ সালের পর থেকে হামাসের সঙ্গে চার দফা লড়াই হয়েছে ইসরায়েলের। সর্বশেষ গত বছরের মে মাসে ইসরায়েলি সেনাদের সঙ্গে হামাস সদস্যদের লড়াই হয়েছে। গত এক বছরে ইসরায়েলের ভেতরে গাজার কিছু লোকজনকে কাজের সুযোগ দেওয়া হলেও গাজা উপত্যকার অবরুদ্ধ পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। এর মধ্যে এরেজ ক্রসিং দিয়ে গাজা ছেড়ে ইসরায়েলে যেতে এবং রাফাহ ক্রসিং দিয়ে মিশরে যাওয়ার পথে গাজাবাসীকে বাধার সম্মুখীন হতে হয়।
ওই অবরুদ্ধ অবস্থার ১৫ বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, মিশরের সহায়তায় ইসরায়েল গাজাকে এক উন্মুক্ত কারাগার তৈরি করে রেখেছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন অঞ্চলের পরিচালক ওমর শাকির বলেন, গাজার শিশুরা ক্ষতির মুখে পড়েছে। কারণ, তারা জানে না এই অবরুদ্ধ পরিস্থিতির আগে উন্মুক্ত শহর কেমন ছিল। তাদের দুনিয়া ৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ আর ১১ কিলোমিটার প্রস্থের একটা ঘেরা ভূখণ্ডে সীমিত করে দেওয়া হয়েছে, যাতে তারা বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে কোনোভাবে যুক্ত হতে না পারে।
গাজা হচ্ছে ফিলিস্তিনের এমন একটি এলাকা, যা পশ্চিম তীর থেকে বিচ্ছিন্ন। এই এলাকাটি ৪১ কিলোমিটার বা ২৫ মাইল দীর্ঘ এবং ১০ কিলোমিটার চওড়া। একদিকে ভূমধ্যসাগর, তিন দিকে ইসরায়েল ও দক্ষিণ দিকে মিশরের সিনাই সীমান্ত।
ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস ২০০৬ সালে অনুষ্ঠিত ফিলিস্তিনি সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করে। পরে অপর প্রভাবশালী সংগঠন ফাতাহর সঙ্গে নির্বাচন নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জেরে পশ্চিম তীর থেকে ফাতাহ হামাসের নেতাকর্মীদের বের করে দিলে গাজার নিয়ন্ত্রণ নেয় সংগঠনটি। তখন থেকেই মিশর ও ইসরায়েল যৌথভাবে গাজার ওপর অবরোধ আরোপ করে।
গাজা উপত্যকার অবরোধ মূলত শুরু হয় ২০০৭ সালের জুনে। এর ফলে গত ১৫ বছরে ভূমধ্যসাগরপাড়ের ছোট্ট ভূ-খণ্ডটির অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অবরোধের কারণে এখানকার অধিবাসীদের চলাচল সীমিত হয়ে পড়েছে। যার ফলে এখানকার শিশুদের জীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে।
মাত্র কয়েক বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ উপত্যকায় রীতিমতো গাদাগাদি করে বসবাস করে প্রায় ২০ লাখ মানুষ। এর জনসংখ্যার ৪৭ শতাংশই বর্তমানে শিশুকিশোর।
সেভ দ্য চিলড্রেনের রিপোর্টে বলা হয়েছে, এখানকার প্রায় ৮ লাখ শিশুকিশোরই অবরোধের বাইরের জীবন কেমন তা দেখেনি। এর মধ্যে তাদের আবার এমনসব পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়, যা যেকোনো মুহূর্তে তাদের জীবন কেড়ে নিতে পারে।
সেভ দ্য চিলড্রেনের রিপোর্টে আরও ভয়ানক তথ্য উঠে এসেছে। আর তা হলো, উপত্যকার শিশুদের অর্ধেকই কোনো না কোনো সময় আত্মহত্যা করার কথা ভাবছে। শুধু তাই নয়, প্রতি পাঁচজন শিশুর মধ্যে তিনজন নিজের ক্ষতি করার চেষ্টা করছে।
শিশু ও কিশোরদের এ মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতির পেছনে প্রধান কারণ (ফ্যাক্টর) স্বাস্থ্যসেবার মতো মৌলিক অধিকার না পাওয়া, সহিংসতা ও চলমান অবরোধের কারণে চলাচলের সুযোগহীনতা।
গবেষণায় অংশ নেওয়া স্বাস্থ্যকর্মীদের দেয়া তথ্যমতে, উপত্যকার শিশুদের ৭৯ শতাংশই কয়েক বছর ধরে বিছানায় প্রস্রাব করার মতো সমস্যায় ভুগেছে। এ ছাড়া ৫৯ শতাংশ শিশুর মধ্যেই ঠিকমতো কথা বলতে না পারা, ভাষা ও আচরণগত সমস্যা রয়েছে।
সেভ দ্য চিলড্রেন সতর্ক করে বলেছে, এসব লক্ষণের কারণে শিশুদের বেড়ে ওঠা, শিক্ষণ ও সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার ক্ষেত্রে স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে সংস্থাটির কাউন্ট্রি ডিরেক্টর জেসন লি বলেন, গাজার শিশুদের বিছানায় প্রস্রাব, ঠিকমতো কথা বলতে না পারা ও নিজেদের প্রাকৃতিক জরুরি কাজগুলো করতে না পারার মতো সমস্যাগুলোর বাস্তব প্রমাণ আসলেই মর্মান্তিক। বিষয়টি নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এখনই পদক্ষেপ নেয়া উচিত।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫১৯
আপনার মতামত জানানঃ