ফেনীর দাগনভূঁইয়ার নুরানীয়া হাফেজিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে ওই মাদ্রাসার এক শিশু শিক্ষার্থীকে (১০) পায়ে লোহার শিকল বেঁধে নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে।
গত শনিবার(১১ জুন) রাতে মাদ্রাসা থেকে পালানোর সময় উপজেলার পূর্বচন্দ্রপুর এলাকা থেকে টহল পুলিশ শিশুটিকে উদ্ধার করে।
এ ঘটনায় রোববার সকালে দাগনভূঁইয়া থানা পুলিশ ওই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ফখরুল ইসলামকে (৩২) আটক করেছে। তিনি নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার বড় চাঁড়িগাও গ্রামের বাসিন্দা।
জানা যায়, পায়ে লোহার শিকল বাঁধা অবস্থায় নির্যাতিত শিশু শিক্ষার্থী রাতের আঁধারে কৌশলে পালাতে গিয়ে টহল পুলিশের হাতে পড়ে। পুলিশ শিশুটিকে উদ্ধার করে রাতেই থানায় নিয়ে যায়। ১০ বছর বয়সী ওই শিশু শিক্ষার্থীর নাম জাহিদুল হাসান নাঈম।
শনিবার রাতে উপজেলার পূর্ব চন্দ্রপুর এলাকা থেকে শিশুটি উদ্ধার করা হয়। শিশুটি নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার মোহাম্মদপুর গ্রামের পাটোয়ারী বাড়ির আব্দুল্লাহ আল মামুনের ছেলে। সে মাদ্রাসার নাজরা শ্রেণির শিক্ষার্থী।
শিশুটি ফেনীর দাগনভূঞা উপজেলার পূর্বচন্দ্রপুর ইউনিয়নের দেউলিয়া নুরানীয়া হাফেজিয়া মাদ্রাসার নাজরা শ্রেণির আবাসিক ছাত্র ছিল।
ওই মাদ্রাসা শিক্ষার্থীকে লোহার শিকল দিয়ে বেঁধে রাখাসহ নানা ধরনের নির্যাতন করা হতো। নির্যাতন সইতে না পেরে একপর্যায়ে ওই শিশুটি গত শনিবার রাতে মাদ্রাসা থেকে কৌশলে পালিয়ে যায়।
রাত ৩টার দিকে দাগনভূঞা থানার টহল পুলিশের গাড়ির সামনে পড়ে। পুলিশ পায়ে শিকল পরা শিশুটিকে দেখতে পেয়ে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়।
পুলিশ শিশুটিকে উদ্ধারের পর উঠে আসে নির্যাতনের নানা কাহিনি। পুলিশকে শিশুটি জানায়, মাদ্রাসায় তাকে লোহার শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হতো। করা হতো নানা ধরনের নির্যাতন। নির্যাতন সইতে না পেরে একপর্যায়ে সে পালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। ওই সময় রাত তিনটার দিকে সে থানার টহল পুলিশের গাড়ির সামনে পড়ে। পুলিশ তাকে উদ্ধার করে সঙ্গে সঙ্গে থানায় নিয়ে যায়।
নির্যাতনের শিকার ওই শিশুর বাবা বলেন, তার ছেলের বয়স ১০ বছর। শিশুটিকে চলতি বছরের শুরুতে দেউলিয়া নুরানীয়া মাদ্রাসার নাজেরা শ্রেণিতে ভর্তি করানো হয়। এরপর থেকে শিক্ষার্থীদের নানা ধরনের নির্যাতনের কথা তিনি শুনে আসছেন।
তিনি আরও বলেন, ‘গত শনিবার আমি ছেলেকে দেখতে মাদ্রাসায় যাই। সে তখন নির্যাতনের বিষয়টি আমাকে জানিয়ে মাদ্রাসা থেকে নিয়ে যেতে বলে। তারপর আমি তাকে বুঝিয়ে মাদ্রাসায় রেখে আসি। অভিযোগের বিষয়টি অধ্যক্ষ জানতে পারেন।
এতে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে আমার ছেলেকে লোহার শিকল দিয়ে বেঁধে মাদ্রাসার একটি কক্ষে আটকে রাখেন ও লাঠি দিয়ে নির্মমভাবে পিটিয়ে জখম করেন। এ কারণে সে পালানোর সিদ্ধান্ত নেয়।’
ওই মাদ্রাসা শিক্ষার্থীকে লোহার শিকল দিয়ে বেঁধে রাখাসহ নানা ধরনের নির্যাতন করা হতো।
দাগনভূঞা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. হাসান ইমাম বলেন, ঘটনার খবর পেয়ে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ফখরুল ইসলামকে আটক করে থানায় নিয়ে আসা হয়েছে। এ ঘটনায় শিশুর পরিবার বা অন্য কেউ অভিযোগ দিলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এর আগে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার বরমচাল ইউনিয়নে বুধবার (৮ জুন) সিদ্দেক আলী (১৪) নামক ৮ম শ্রেণির এক মাদ্রাসা ছাত্রকে গুরুতর আহত অবস্থায় কুলাউড়া হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
ছাত্রের অভিভাবকরা এক শিক্ষককে অভিযুক্ত করে এ বিষয়ে কুলাউড়া থানা ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন।
আহত মাদরাসা ছাত্রের পরিবারের লোকজন অভিযোগ করেন, বরমচাল খন্দকার মাদ্রাসা সহ-সুপার মাওলানা মাহতাবুর রহমান বুধবার বেলা ১২টা নাগাদ ৮ম শ্রেণির ছাত্র সিদ্দেক আলীকে মারপিট করেন। এতে সে ঘাড়ে মারাত্মক আঘাতপ্রাপ্ত হয়। মাদ্রাসার অভিভাবক কমিটির সদস্য কামাল উদ্দিনসহ এলাকার লোকজন আহত ছাত্রকে কুলাউড়া হাসপাতালে ভর্তি করেন। জরুরি বিভাগে কর্তব্যরত ডাক্তাররা সিদ্দেক আলীর ঘাড়ে এক্সরে করার নির্দেশ দেন। ঘাড়ের জখম গুরুতর হলে তাকে ওসমানী হাসপাতালে প্রেরণ করা হবে।
পরিবারের লোকজন অভিযোগ করেন, গত দু’দিন থেকে শিক্ষক ছাত্রদের মারপিট করছেন। এজন্য মঙ্গলবার সিদ্দেক আলী মাদ্রাসায় যায়নি ভয়ে। বুধবার মাদ্রাসায় যাওয়ার পর শিক্ষকের নির্যাতনের শিকার হলো। মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের এভাবে মারপিট না করার জন্য অন্যান্য শিক্ষকরা সতর্ক করেন সহ-সুপারকে। কিন্তু তারপরও এধরনের ঘটনা সংঘটিত হলো।
বাংলাদেশের আইনে ছাত্রদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি দেয়া দণ্ডনীয় অপরাধ৷ ২০১১ সালে হাইকোর্টের এক আদেশের পর শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি বন্ধে নীতিমালা প্রণয়ন করে৷ আর তাতে শারীরিক ও মানসিক শাস্তির সংজ্ঞাও দেয়া হয়েছে৷ শারীরিক শাস্তি বলতে যেকোনো ধরনের দৈহিক আঘাত বলা হয়েছে৷ মারধর ছাড়াও আইনে কান ধরা, চুল টানা, বেঞ্চের নিচে মাথা রাখতে বাধ্য করাও দৈহিক শাস্তি৷ আর মানসিক শাস্তির মধ্যে শিশু বা তার পরিবারকে উদ্দেশ্য করে বাজে মন্তব্য বা যেকেনো আপত্তিকর অঙ্গভঙ্গি৷
এতে বলা হয়, হাত-পা বা কোনো কিছু দিয়ে আঘাত বা বেত্রাঘাত, শিক্ষার্থীর দিকে চক বা ডাস্টারজাতীয় বস্তু ছুড়ে মারা, আছাড় দেয়া ও চিমটি কাটা, কামড় দেয়া, চুল টানা বা চুল কেটে দেওয়া, হাতের আঙুলের ফাঁকে পেনসিল চাপা দিয়ে মোচড় দেয়া, ঘাড় ধাক্কা, কান টানা বা উঠবস করানো, চেয়ার, টেবিল বা কোনো কিছুর নিচে মাথা দিয়ে দাঁড় করানো বা হাঁটু গেড়ে দাঁড় করিয়ে রাখা, রোদে দাঁড় করিয়ে বা শুইয়ে রাখা কিংবা সূর্যের দিকে মুখ করে দাঁড় করানো এবং ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে এমন কোনো কাজ করানো, যা শ্রম আইনে নিষিদ্ধ৷
এই পরিপত্রে শাস্তির কথাও বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কেউ শিশুদের শারীরিক শাস্তি দিলে ১৯৭৯ সালের সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালার পরিপন্থি হবে এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে৷
শিক্ষা মন্ত্রণালয় শারীরিক ও মানসিক দুই ধরনের শাস্তি দেয়াকেই শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলেছে৷ যাদের বিরুদ্ধে এই অপরাধ প্রমাণ হবে তাদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে৷ একই সঙ্গে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও বলা হয়েছে৷
কিন্তু এরপরও বাংলাদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের শাস্তি দেয়ার প্রবণতা বেশ লক্ষ্য করা যায়৷ বিশেষ করে মাদ্রাসায় এটা প্রকট৷
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘মাদ্রাসা শিক্ষকদের সেভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় না। এ কারণে তারা শিশুদের কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, সেটা জানে না। আর মাদ্রাসায় যেসব অভিভাবক তাদের ছেলেমেয়েদের পড়তে পাঠায় তারাও সচেতন না। এ কারণে নির্যাতন হলেও তারা তেমন কিছু বলে না। ফলে শিক্ষকদের মধ্যে ছাত্র নির্যাতনের একটি পরিবেশ অনেক দিন থেকেই চলে আসছে।’
এভাবে পেটানোর পেছনে শিক্ষকদের মানসিকতাই দায়ী বলেও মনে করেন তারা। বলেন, ‘মনে হয় ছাত্র নির্যাতনে তারা একধরনের আনন্দ অনুভব করেন। এটা অবশ্যই একটা মানসিক বিষয়।’
এর সমাধান বিষয়ে বলেন, ‘সমাধান হলো যারা সেখানে ছেলে-মেয়ে দেবে তারা যেন সচেতন হয়। অভিভাবক বলবে কোনোভাবেই যেন এ ধরনের অমানবিক নির্যাতন না চালানো হয়। সেই সঙ্গে নিয়মিত মনিটরিং প্রয়োজন।’
তারা বলেন, ‘এখানে শিক্ষা ব্যবস্থা শিক্ষার দর্শন অনুযায়ী গড়ে ওঠেনি৷ নানা ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত৷ কেউ কেউ মনেই করেন কিছুটা মারপিট সুশিক্ষার জন্য দরকার আছে৷ আর কওমী মাদ্রাসাগুলো যেহেতু সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই তাই তারা সরকারের নির্দেশও মানতে চায় না’৷
আরও বলেন, ওস্তাদের মার খেলে ওই জায়গাটা বেহেশতে যায়— এটা যদি হয় চিন্তা তাহলে মারপিট থামবে কীভাবে? সামাজিক এই দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই শিশুদের বলাৎকার করেও কেউ কেউ রেহাই পেয়ে যান৷
অবশ্য শিশুদের প্রকৃত শিক্ষা দিতে হলে, তাদের সঠিক মানসিক বিকাশ নিশ্চিত করতে হলে সব ধরনের নির্যাতন বন্ধ করতে হবে৷ সেটা যেমন স্কুলে তেমনি তার ঘরে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৫৮
আপনার মতামত জানানঃ