বর্তমান সময়টা হলো তথ্য-প্রযুক্তির যুগ। অনেক অভিভাবক এখন বাচ্চাদেরকে বিভিন্ন ডিভাইসের স্ক্রিনের সামনে বসিয়ে রেখে নিজেদের প্রয়োজনীয় কাজ সম্পাদন করেন বা বাচ্চাকে শান্ত করার জন্য স্ক্রিন ব্যবহার করে থাকেন। মজার ব্যাপার হলো, এই কৌশলটি বাচ্চাদের ক্ষেত্রে ঠিকই কাজ করে। ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসের স্ক্রিন যেভাবে একটি শিশুর মনোযোগ ধরে রাখে তা সম্ভবত অন্য কোনো কিছুর পক্ষে সম্ভব হয় না। বাচ্চাকে স্ক্রিনের সামনে বসিয়ে দিলে বাবা, মা যেন একটু স্বস্তিতে শ্বাস নেওয়ার সুযোগ পান। কিন্তু কখনো কি মাথায় প্রশ্ন জেগেছে এতে বাচ্চার কী কী সমস্যা হতে পারে? একজন শিশুর আসলে সর্বোচ্চ কতক্ষণ স্ক্রিনের সামনে থাকা উচিত?
স্ক্রিন টাইম
শিশু যে সময়টুকু কোনো ডিভাইসের স্ক্রিনের সামনে থাকে সেটাই স্ক্রিন টাইম। টেলিভিশন, সিনেমা হলের স্ক্রিন, মোবাইল, ট্যাব, ভিডিও গেমস, কম্পিউটার ইত্যাদি ডিভাইসের স্ক্রিনের দিকে বাচ্চা যতক্ষণ তাকিয়ে থাকে সেই সময়টুকুকে স্ক্রিন টাইম হিসেবে ধরা হয়। আপনার শিশু স্ক্রিনে শিক্ষণীয় ভিডিও দেখছে নাকি ভিডিও গেমস খেলছে তা এখানে বিবেচনার বিষয় নয়। স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকলেই সেটাকে স্ক্রিন টাইম হিসেবে ধরা হবে।
স্ক্রিন টাইম যেভাবে শিশুর ভাষার বিকাশে বিঘ্ন ঘটায়
অন্য আরেকজন মানুষের সাথে সরাসরি সংযুক্ত থাকার মাধ্যমে, তার সাথে যোগাযোগ স্থাপন এবং কথা বলতে চাওয়ার মধ্য দিয়েই মূলত শিশু ধীরে ধীরে কথা বলতে শেখে। যত উন্নত প্রযুক্তিই আসুক না কেন, সেই আদিকাল থেকে এখনো পর্যন্ত শিশুরা এই পদ্ধতিতেই কথা বলতে শিখেছে, সামনেও শিখবে। শিশুর জীবনের প্রথম কয়েকটি বছর তার ভাষার বিকাশের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। নতুন ভাষা শেখার জন্য এবং ভাষার মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপন করার পন্থা শেখার জন্য এই সময়ে শিশুর ব্রেন সবচেয়ে বেশি সক্ষম, গ্রহণক্ষম এবং ধারণক্ষম হয়ে থাকে। এই বয়সে শিশু যা শেখে তা তার সাথে আজীবন থেকে যায়।
একবার এই শেখার জানালা বন্ধ হয়ে গেলে মানুষের পক্ষে ভাষা শেখা এবং দক্ষতার বিকাশ ঘটানো খুবই কঠিন হয়ে পড়ে। মূলত এজন্যই বয়স বেড়ে গেলে বা প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় নতুন কোনো ভাষা শিখতে গেলে আমাদের অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়।
স্ক্রিনের সাথে কাটানো প্রতিটি মিনিটের মাধ্যমে শিশু ভাষা শেখার মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি দক্ষতা থেকে দূরে সরে যায়। বিষয়টা অনেকটা এরকম- এক মিনিট স্ক্রিন দেখা মানে ভাষা শেখার ব্যাপারে এক মিনিট কম ব্যয় করা। যে সময়টুকু শিশুর উচিত ছিল তার বাবা, মা বা পরিবারের বড় কারো সাথে কাটানো, তাদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করা, ভাষা ও শব্দের সাহায্যে যোগাযোগ স্থাপন এবং মনের ভাব আদান-প্রদান করার চেষ্টা করা; স্ক্রিন টাইম সেই সময়ের ভেতরে এসে ভাগ বসায় এবং শিশুর ভাষা বিকাশের ক্ষেত্রে বাধা প্রদান করে।
ধরুন, আপনি আপনার সন্তানকে নিয়ে গাড়িতে করে কোথাও যাচ্ছেন। তার হাতে একটা স্মার্টফোন ধরিয়ে দিয়েছেন, সেটার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থেকে চুপচাপ সে তার পছন্দের কার্টুন শো দেখছে। এরকম পরিস্থিতিতে আপনি হয়তো তার সাথে কোনো কথাই বলতে চাইবেন না। কারণ আপনি কথা বললে তার কার্টুন দেখায় ছেদ পড়বে, সে বিরক্তও হতে পারে।
এবার ভাবুন, আপনার সন্তানের হাতে কোনো ডিভাইস নেই। তাহলে কী হবে? এবার আপনার কথা বলার সম্ভাবনা অনেক বেশি। আপনার সন্তান যদি পাল্টা কোনো সাড়া দিতে বা কথা বলতে না পারে তারপরেও হয়তো আপনি তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করবেন। কারণ কোনো ডিভাইস থেকে আওয়াজ না এলে আমরা সাধারণত কথা বলতে কম দ্বিধা করি।
আপনি কথা বলতে থাকলে একটা সময় আপনার সন্তানও হয়তো কথা বলবে বা কথা বলার চেষ্টা করবে। এভাবেই তার ভাষার বিকাশ ঘটবে, সে কথা বলায় দক্ষ হয়ে উঠবে। অথচ হাতে থাকা ডিভাইসের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকলে সেটা সম্ভব হবে না।
গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব শিশুরা ১২ মাস বয়স হওয়ার আগেই টিভি দেখতে শুরু করেছে এবং দিনে ২ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে টিভি দেখেছে, তাদের দেরিতে কথা বলার সম্ভাবনা সাধারণ শিশুর চেয়ে ৬ গুণ বেশি!
অন্য আরেকটি গবেষণায় জানা গেছে, যেসব শিশু দিনে ২ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে টিভি দেখে তারা যোগাযোগ স্থাপন করার ক্ষেত্রে খুব অল্প স্কোর তুলতে সক্ষম হয়।
এরকম বিভিন্ন গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে, শিশুদেরকে অল্প বয়সে টিভি দেখায় অভ্যস্ত করলে তারা দেরিতে কথা বলতে শেখে এবং পরবর্তীতে স্কুল জীবনেও তাদের কথা বলার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দেয়।
অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম শিশুদের মনোযোগ সংক্রান্ত সমস্যার সৃষ্টি করে। পাশাপাশি স্বল্প-মেয়াদী স্মৃতি সমস্যা (শর্ট-টার্ম মেমোরি প্রবলেম), সামাজিক এবং আবেগীয় সমস্যা এবং অক্ষর পড়ার ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি করে। এসবের কারণে শিশুর পক্ষে তার মাতৃভাষা শিখতেও সমস্যা হয়।
ভাষার বিকাশ
শিশুদের বয়স ২.৫ (আড়াই) বছর হওয়ার আগপর্যন্ত তারা কোনো ভিডিও দেখে ভাষা শিখতে পারে না। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ৪ বছরের কম বয়সী শিশুরা যত বেশি পরিমাণ সময় টেলিভিশন বা অন্য কোনো ডিভাইসের স্ক্রিনের সাথে ব্যয় করেছে তারা তত কম শব্দ শিখেছে।
তবে আশার কথা হলো, ১২ মাস বয়স বয়সী শিশুরা ডিজিটাল স্ক্রিন দেখেও নতুন শব্দ শিখতে পারে যদি পাশে তাদের বাবা, মা থাকে। বাবা, মা তাদের বাচ্চাদের সাথে স্ক্রিন দেখার পাশাপাশি ডিভাইস থেকে শোনা বিভিন্ন শব্দ বারবার উচ্চারণ করার সাথে সাথে শব্দগুলোর অর্থ বুঝিয়ে দিলে শিশুরা নতুন শব্দ শিখতে পারে। কারণ শিশুরা মূলত তাদের বাবা, মায়ের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকার মাধ্যমেই ভাষা, শব্দ শেখে, শরীরি ভাষা, ইঙ্গিত আয়ত্ব করে, চোখে চোখ রাখা শেখে, চোখ দিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করতে শেখে। এভাবে বিভিন্ন জিনিস শেখার পাশাপাশি শিশু একা একা বসে খেলার ছলে বিভিন্ন ধরনের শব্দ করবে, নিরর্থক আওয়াজ করবে এবং নিজের কণ্ঠ নিয়ে পরীক্ষা চালাবে।
বাবা, মায়ের সাথে সংযুক্তি
শিশুরা বাবা, মায়ের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত হওয়ার মাধ্যমে সামাজিক হতে শেখে। কিন্তু ডিজিটাল স্ক্রিন তাদের মনোযোগ কেড়ে নেয় এবং তাদের সামাজিক হওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করে। এক গবেষণায় জানা গেছে, রুমে টেলিভিশন চালু থাকলে বাবা, মা সাধারণত বাচ্চার সাথে কম কথা বলেন। আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে- যেসব বাবা, মা তাদের মোবাইল ফোন নিয়ে যত বেশি ব্যস্ত থাকেন তারা তাদের বাচ্চার সাথে তত কম সংযুক্ত থাকেন।
মনোযোগের স্থায়ীত্ব কমে যাওয়া
বাচ্চাকে সফল হিসেবে গড়ে তুলতে হলে তাকে অবশ্যই মনোযোগী হওয়া শেখাতে হবে। শিশু বয়স থেকেই তার মস্তিষ্ক মনোযোগ হওয়ার ব্যাপারটি আয়ত্ব করে নিতে পারে। এসময় শিশুর মস্তিষ্ক আশেপাশের পরিবেশ, পরিস্থিতি নিয়ে অনেক স্পর্শকাতর থাকে। মস্তিষ্ক যথাযথ বিকাশের ক্ষেত্রে বাইরের জগত থেকে ইনপুট হিসেবে প্রয়োজনীয় তথ্য এবং উদ্দীপনা পাওয়া জরুরি।
তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো- সেইসব তথ্য এবং উদ্দীপনাকে শিশুর মস্তিষ্কে সাজিয়ে নেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত সময় দেওয়া। শিশুকে কোনো গল্প পড়ে শোনালে সে গল্পের শব্দগুলোকে নিজের মাথায় সাজিয়ে নেওয়ার সুযোগ পায়, সেখান থেকে সে ছবি এবং শব্দ কল্পনা করে নিতে পারে। কিন্তু সরাসরি স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকলে শিশু সেধরনের কোনো সুযোগ পায় না। স্ক্রিন তাকে কল্পনা করার সুযোগ দেয় না। স্ক্রিন তাকে সরাসরি একের পর এক দৃশ্য, ছবি, আওয়াজ সরবরাহ করে চলে। ফলে শিশুর কল্পনা করা শক্তি এবং সময় নিয়ে মনোযোগ সহকারে কিছু ভাবার দক্ষতা কমে যায়।
আবেগ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কমে যাওয়া
শিশুকে সবসময় উত্তেজনা এবং আনন্দের মাঝে রাখা যাবে না। তাকে কিছুটা সময় বোরিং, বিরক্তিকর সময়ের মধ্যে দিয়েও যেতে হবে। বোরিং সময় কাটানোর মাধ্যমে তারা নিজের আবেগ, হতাশা, রাগ ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করতে শিখবে। কিন্তু কোনো শিশু যদি সবসময় স্ক্রিন নিয়ে ব্যস্ত থাকে, বোরিং অনুভব হওয়া মাত্রই যদি সে স্ক্রিন থেকে বিনোদন পেতে শুরু করে তাহলে অবধারিতভাবে সে ধীরে ধীরে নিজের রাগ, হতাশা নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হবে। স্ক্রিন ছাড়া, বিনোদন ছাড়া সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না, নিজের সাথে নিজেই সময় কাটাতে পারবে না। এভাবে সে আরো হতাশ এবং বিষণ্ন হয়ে উঠবে এবং তার কল্পনাশক্তি হ্রাস পেতে থাকবে।
সহমর্মিতা কমে যাওয়া
গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে, শিশুদের ক্ষেত্রে স্ক্রিন টাইমের কারণে কারো মুখ দেখে তার মনের ভাব আন্দাজ করতে পারার দক্ষতা কমে যায় এবং সামাজিক দক্ষতা শেখার ব্যাপারে তারা বাধাপ্রাপ্ত হয়। অথচ এই দুটো জিনিস সহমর্মিতা বিকাশ হওয়ার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মুখে কিছু না বলা হলেও শুধু চেহারার অভিব্যক্তি দেখে মনের ভাব অনুধাবন করতে পারার দক্ষতা অর্জন করার জন্য সরাসরি কোনো মানুষের সাথে সংযুক্ত থাকা জরুরি।
শিশুর ভাষার বিকাশ হওয়ার আগপর্যন্ত তারা যেসব প্রক্রিয়ায় মনের ভাব আদান-প্রদান করে তার সবই ঘটে চেহারা দেখে এবং চেহারায় ফুটে ওঠা অভিব্যক্তি বোঝার মাধ্যমে। শিশু তার সামনে থাকা ব্যক্তির মুখ দেখে বোঝার চেষ্টা করে সেই ব্যক্তি তার সাথে খুশি নাকি তার ওপর রাগ করেছে। শিশুর মস্তিষ্ক বিকাশের ক্ষেত্রে সরাসরি মানুষের সাথে ভাবের এধরনের আদান-প্রদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
শিশু যখন স্ক্রিন নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকে তখন তার মানুষের চেহারা দেখে আবেগ বোঝার দক্ষতা কমতে থাকে এবং তার পক্ষে নিজের হতাশা, ফ্রাস্ট্রেশন নিয়ন্ত্রণ করাও কঠিন হয়ে যায়। স্ক্রিন টাইমের কারণে শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। স্ক্রিন নিয়ে পড়ে না থেকে যদি শিশু অন্য কোনো শিশুর সাথে খেলতো তাহলে তার মস্তিষ্কের বিকাশ ত্বরান্বিত হতো।
যদি নিতান্তই বাচ্চাকে স্ক্রিন টাইম দিতেই হয় তাহলে সময়টুকু সীমিত করে দিতে হবে এবং সেই সময়ে সে স্ক্রিনে কী দেখছে সে-ব্যাপারে নজর রাখতে হবে। বাবা, মার উচিত বাচ্চার সাথে স্ক্রিন টাইম শেয়ার করা, তার সাথে ভিডিও, কার্টুন ইত্যাদি দেখা এবং তাকে বিভিন্ন শব্দ, বিষয়-বস্তু সম্পর্কে বুঝিয়ে বলা। মোদ্দাকথা, স্ক্রিনের সামনে থাকলেও বাচ্চা যেন সরাসরি মানুষের সাথে সংযুক্ত থাকে, এটা নিশ্চিত করা। তাহলে স্ক্রিন টাইমের কারণে শিশুর ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা অনেকাংশেই কমে আসবে।
তথ্যসূত্র :
আপনার মতামত জানানঃ