পানি দিয়ে সব কেমিক্যালের আগুন নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। এ কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে সময় লাগছে। এ পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের ৯ জন নিহত ও ২১ জন আহত হয়েছেন৷
তবে বিএম কনটেইনার ডিপো কর্তৃপক্ষ সেখানে দাহ্য পদার্থ থাকার তথ্য না দেয়ায় আগুন ও বিস্ফোরণে এত মানুষের মৃত্যু ঘটেছে৷ ঘটনার পর থেকে প্রতিষ্ঠানের মালিক আওয়ামী লীগ নেতা মুজিবুর রহমান রহমান গা ঢাকা দিয়েছেন৷
শনিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে লাগা আগুন ২৪ ঘণ্টা পরও নিয়ন্ত্রণে আসেনি৷ ফায়ার সর্ভিসের ২৫টি ইউনিট ছাড়াও আগুন নিয়ন্ত্রণে সেনা ২৫০ জন সেনা সদস্য কাজ করছেন৷ ঢাকা থেকে পাঠানো হয়েছে ফায়ার সার্ভিসের কেমিকেল আগুন নেভানোর বিশেষায়িত দল ‘হাজমত’ টিম৷
শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ৪৯ জন৷ তাদের মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের কর্মী ৯ জন৷ আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৪০০ জন৷ তাদের চট্টগ্রাম মেডিকেলে কলেজ হাসপাতালসহ চট্টগ্রামের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে৷ আহত কয়েকজনকে সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে করে ঢাকা আনা হয়েছে৷ আরো আহতদের আনা হবে৷ হাসপাতালগুলোর পরিবেশ আহত এবং নিহতদের স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে৷
হাসপাতালে ৭০ জন চিকিৎসাধীন। এর মধ্যে ৪ জন নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন। বিস্ফোরণে আহত হয়েছেন দেড় শতাধিক মানুষ। হতাহতদের মধ্যে ডিপোর শ্রমিকের পাশাপাশি পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যও রয়েছেন।
এদিকে, শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত আগুন এখনো নিয়ন্ত্রণে আসেনি। এ অবস্থায় অভিযানে যোগ দিয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি দল। সেনাবাহিনীর ১৫০ থেকে ২০০ সদস্য অভিযানে অংশ নিচ্ছেন। এদিকে, ঘটনা তদন্তে ৯ সদস্যের একটি কমিটি করা হবে। কমিটিকে চার থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হবে।
তথ্য গোপনের কারণে এতো মৃত্যু
বিএম কনটেইনার ডিপোর অবস্থান চট্টগ্রাম থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে সীতাকুণ্ডে ২৪ একর জমির ওপর৷ সেখানে আগুনের সময় অন্তত ৬০০ জন কর্মী ছিলেন৷ কনটেইনার ছিলো চার হাজারের বেশি৷
ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক (মিডিয়া) শাহজাহান শিকদার জানান, ‘‘আগুন লাগার পর কনটেইনার ডিপোর মালিকপক্ষকে আমরা পাইনি৷ তাদের কেউ আমাদের জানায়নি যে সেখানে কেমিকেল আছে৷ তথ্য জানা না থাকায় আমাদের ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা মারা যান৷ কারণ কেমিকেল থেকে লাগা আগুন নেভানোর কৌশল আলাদা৷ ভিন্ন ধরনের পার্সোনাল প্রটেকটিভ সরঞ্জাম লাগে৷ কেমিকেলের তথ্য না জানায় ফায়ার ফাইটার যারা ফ্রন্ট লাইনে ছিলেন তারা মারা যান৷
তিনি বলেন, ‘‘কনটেইনার ডিপো করতে হলে ফায়ার লাইসেন্স দরকার হয়৷ এটা ছাড়া ডিপো করা যায় না৷ আর কোনো দাহ্য পদার্থ বা কেমিকেল থাকলেও তা জানিয়ে রাখতে হবে ফায়ার সার্ভিসকে৷ আমরা সেখানে অনেক কেমিকেলের উপস্থিতি পাচ্ছি৷ বিভিন্ন ধরনের কেমিকেলের অনেক ড্রাম রয়েছে সেখানে৷ তাদের ফায়ার লাইসেন্স আছে কী না আমরা তদন্ত করে দেখছি৷ তবে আমাদের তারা কেমিকেলের তথ্য জানায়নি এটা নিশ্চিত৷”
তিনি বলেন, ‘‘এখন আমরা ড্রোন ব্যবহার করে কেমিকেল চিহ্নিত করছি৷ ফোম ব্যবহার করে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি৷”
চট্টগ্রামের কাস্টমস কমিশনার ফখরুল আলম জানিয়েছেন ওই ডিপোতে রপ্তানির জন্য হাইড্রোজেন পার অক্সাইড ছিলো৷ এখান থেকে অনেক দিন ধরেই এটা রপ্তানি হচ্ছে৷ এটা তারা ডিক্লারেশন দিয়েই রপ্তানি করে৷ তবে এর বাইরে আর কোনো কেমিকেল এখানো রাখা ছিলো কী না তা তাদের জানানো হয়নি৷
তার কথা, ‘‘হাইড্রোজেন পার অক্সাইড কোনো দাহ্য পদার্থ বা বিস্ফোরক নয়৷ তবে যেকোনো জিনিসেই আগুন লাগতে পারে৷ কেউ আগুন লাগিয়ে দিতে পারে৷ আমি শুনেছি হাইড্রোজেন পার অক্সাইড-এর পাফে স্টাপল ফাইবারের একটি কনটেইনার ছিলো৷ সেকারনেও আগুন ছড়াতে পারে৷ অটোমেটিক কোনো বিস্ফোরণ ঘটেনি৷ সেটা হলে জাহাজেও তো বিস্ফোরণ ঘটত৷”
এদিকে বিস্ফোরক অধিদপ্তরের উপ-প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক ড. মো. আবদুল হান্নান জানান, ‘‘হাইড্রোজেন পার অক্সাইড কোনো বিস্ফোরক বা দাহ্য পদার্থ নয়৷ যে ৫৪টি দাহ্য পদার্থের তালিকা আছে তার মধ্যে এটা নেই৷ ফলে এটা আমদানি বা রপ্তানিতে আমাদের অনুমোদন লাগে না৷”
তবে তার কথা, ‘‘অন্য কোনো বিস্ফোরক বা কেমিকেল সেখানে থাকতে পারে৷ আগুন ও বিস্ফোরণের ভয়াবহতায় তাই মনে হচ্ছে৷ সেটা তদন্ত করে দেখা দরকার৷”
স্থানীয় সংসদ সদস্য দিদারুল আলম জানান, বিস্ফোরণ ও আগুনের ঘটনার সংবাদ পেয়ে রাতেই সেখানে যান তিনি৷ গিয়ে দেখেন মালিক পক্ষের কেউ নাই৷ সবাই পালিয়েছে৷
তিনি বলেন, ‘‘সেখানে আমি অনেক কনটেইনারে তরল কেমিকেল দেখেছি৷ বিস্ফোরণে কয়েক মাইল এলাকা কেঁপে উঠেছে৷ অনেক দূরে গিয়েও আঘাত করেছে বিস্ফোরিত কনটেইনারের বিভিন্ন অংশ৷” তিনি জানান, ওখানে কেমিকেল, গার্মেন্টস পণ্য সব একসাথে ছিলো৷ দাহ্য পদার্থের আলাদা কোনো ব্যবস্থাপনা ছিলো না৷ অগ্নি নিরাপত্তা বলে কিছু ছিলো না বলে জানান তিনি৷
এদিকে চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ‘‘ওই কনটেইনার ডিপোর কোনো কমপ্লায়েন্স নেই, এটা দুঃখজনক৷ আমরা ব্যবসায়ীরা যারা রপ্তানি করি তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি৷ বিজিএমইএ বলছে, ১০ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক পুড়ে গেছে৷”
মালিকরা পালিয়ে গেলেও ডিপোর মূল প্রতিষ্ঠান স্মার্ট গ্রুপের আরেকটি প্রতিষ্ঠান চিটাগং ডেনিম-এর জিএম মেজর(অব.) শামসুল হায়দার সিদ্দিকী ঘটনাস্থলে রয়েছেন৷ তিনি দাবি করেন, ‘‘ডিপোতে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড ছিলো এটা নিশ্চিত৷ অন্য কোনো কেমিকেল ছিলো কী না তা বলতে পারছি না৷”
তিনি জানান, ‘‘ডিপোতে প্রায় সাড়ে চার হাজার কনটেইনার ছিলো৷ এর মধ্যে ৯০ ভাগই গার্মেন্টস পণ্য৷ কাজ করছিলো ৫৫০ জনের মত কর্মী৷”
মালিক পক্ষের লোকজন কেন পালিয়ে গেল এবং তাদের কেন পাওয়া যাচ্ছে না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘তারা ভয় পেয়েছেন, তাই প্রকাশ্যে আসছেন না৷”
প্রসঙ্গত, বিএম কন্টেইনার ডিপোর মালিক ও মূল প্রতিষ্ঠান স্মার্ট গ্রুপের এমডি মুজিবুর রহমান চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ৷ তিনি গত সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন চেয়েছিলেন বলে স্থানীয় লোকজন জানান৷ তিনি একই সঙ্গে চট্টগ্রামের স্থানীয় দৈনিক পূর্বদেশের সম্পাদক৷ তিনি এবং মালিক পক্ষের অন্যরা এখন পলাতক৷ পত্রিকা, কনটেইনার ডিপো ও তৈরি পোশাক কারখানাসহ ১২টি শিল্প প্রতিষ্ঠান আছে তাদের৷
১১০ মিলিয়ন ডলারের আর্থিক ক্ষতি
অভ্যন্তরীণ কনটেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশন (বিকডা) জানিয়েছে, শনিবার (৪ জুন) রাতে বিএম ডিপোয় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রাথমিকভাবে ১১০ মিলিয়ন ডলারেরও (৯ হাজার ৮১৩ কোটি টাকা) বেশি আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে ধারণা করা যাচ্ছে।
বিকডার দেয়া তথ্যানুযায়ী, রফতানির জন্য ৮০০ টিইইউস (২০ ফুট দীর্ঘ কনটেইনার) বোঝাই তৈরি পোশাক এবং হিমায়িত খাদ্যপণ্য ছিল। আমদানি করা পণ্যবোঝাই কনটেইনার ছিল ৫০০টি এবং খালি কনটেইনার ছিল ৩ হাজার।
জানা যায়, বেসরকারি বিএম কনটেইনার ডিপোয় প্রায় ৬০০ শ্রমিক কাজ করেন। ৩০ একর জায়গাজুড়ে অবস্থিত ডিপোটির কনটেইনার ধারণক্ষমতা ৬ হাজার ৫০০ টিইইউস। এর মধ্যে শনিবার ডিপোটিতে ৪ হাজার ৩০০ টিইইউস রফতানি, আমদানি ও খালি কনটেইনার ছিল।
এ ব্যাপারে বিকডার সচিব রুহুল আমিন সিকদার জানিয়েছেন, প্রাথমিকভাবে ১১০ মিলিয়ন ডলারের বেশি পণ্যের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে রফতানি কনটেইনারে ৪৫ মিলিয়ন ও আমদানি পণ্যের কনটেইনারের ক্ষেত্রেও ৪৫ মিলিয়ন ডলারের বেশি এবং অন্তত ২০ মিলিয়ন ডলারের খালি কনটেইনারের ক্ষতি হয়েছে।
বিজিএমইএর সহসভাপতি রকিবুল আলম চৌধুরী জানান, ডিপোতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে রফতানির জন্য পণ্যের চালান বোঝাই করা হয়েছে। বেশির ভাগ পণ্য ছিল ‘প্রাণ’ ও ‘অনন্ত’ গ্রুপের। এর মধ্যে ইউরোপীয় একটি ব্র্যান্ডকে ১০০ টিইইউস পণ্য পাঠানোর কথা ছিল। এছাড়াও বেশ কিছু পণ্য মার্কিনভিত্তিক চেইন ক্লথ ব্র্যান্ড এইচঅ্যান্ডএমের জন্য চালানের অপেক্ষায় ছিল।
তিনি আরও বলেন, ‘ডিপোয় যাদের পণ্য ছিল, তাদের তথ্য দিতে বলা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, ৯০০ কোটি টাকা মূল্যের রফতানি পণ্য একেবারে পুড়ে গেছে।’
রকিবুল আলম চৌধুরী বলেন, ‘এ ঘটনায় দেশের রফতানিতে বড় ধরনের প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করছি। এরপর আমরা ক্রেতা ও রফতানিকারক সবার সঙ্গে বসে এ ব্যাপারে করণীয় ঠিক করব।’
বাংলাদেশে ১৯টি ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো (আইসিডি) রয়েছে। এগুলো প্রায় শতভাগ রফতানি পণ্য ব্যবস্থাপনা করে। এছাড়া ৩৮ ধরনের আমদানি পণ্য যেমন: চাল, গম, সরিষা, ছোলা, ডালসহ আরও বেশকিছু পণ্য ডেলিভারির জন্য নিয়ে আসা হয় এসব ডিপোতে। কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে বন্দর এলাকার বাইরে থেকেই পণ্য খালাস ও ডেলিভারির মাধ্যমে এই ডিপোগুলো মূলত চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর চাপ কমাতে সাহায্য করে। এসব ডিপোর ধারণক্ষমতা প্রায় ৭৭ হাজার টিইইউস কনটেইনার। অন্যদিকে, চট্টগ্রাম বন্দরের ধারণক্ষমতা ৪৯ হাজার ১৮ টিইইউস কনটেইনার
এসডব্লিউ/এসএস/০৮৩০
আপনার মতামত জানানঃ