চেক জালিয়াতির মাধ্যমে মাগুরা পুলিশ সুপার কার্যালয়ের অন্তত ২ কোটি ৬৫ লাখ ৮৫ হাজার ৮৮৩ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে একই অফিসের দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে। জালিয়াতির শুরু তিন বছর আগে হওয়ায় সরকারি অর্থ আত্মসাতের পরিমাণ আরও বেশি হতে পারে বলে ধারণা করছেন জেলা হিসাবরক্ষণ অফিসের কর্মকর্তারা।
মাগুরা জেলা হিসাবরক্ষণ অফিস সূত্রে জানা যায়, জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে কনস্টেবল মশিউর রহমানকে ২০১৬ সাল থেকে ক্যাশ সরকার হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। এ দায়িত্বে থেকে তিনি পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে কর্মরতদের বেতন, ভ্রমণ ভাতা ও প্রভিডেন্ট ফান্ডসহ সব প্রকার বিল-ভাউচার হিসাবরক্ষণ অফিসে জমা, চেক গ্রহণ এবং সোনালী ব্যাংক থেকে নিয়মিত অর্থ উত্তোলন করতেন। নিয়মিত প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব হিসাবে জেলা হিসাবরক্ষণ অফিসে কনস্টেবল মশিউরের অবাধ যাতায়াতের সুযোগ ছিল। সেই সুযোগে ৩০ নভেম্বর মশিউর হিসাবরক্ষণ অফিসের অডিটর জাহাঙ্গীর হোসেন শিকদারের ড্রয়ার থেকে দুটি ব্ল্যাঙ্ক চেক চুরি করেন। বিষয়টি বুঝতে পেরে মশিউরের কাছ থেকে চেক দুটি উদ্ধার করা হয়। কিন্তু ওই চেকে ইচ্ছামাফিক নাম এবং অর্থের পরিমাণ বসানো হয়েছিল। পরে চেক দুটির অনুকূলে ব্যবহৃত টোকেন নম্বর, অর্থের পরিমাণ এবং এডভাইস পেপার যাচাইকালে বড় মাপের জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়ে।
সংবাদ সংস্থা ইউএনবির সংবাদ সূত্রে জানা যায়, ব্ল্যাঙ্ক চেকের ঘটনার পর বিগত সময়ে পুলিশ অফিসের নির্ধারিত কোডে পরিশোধিত বিভিন্ন চেক যাচাই-বাছাই করতে গিয়ে মাগুরা জেলা হিসাবরক্ষণ অফিস নড়াইলের বাসিন্দা কনস্টেবল মশিউরের চেক জালিয়াতির আরও অনেক তথ্যপ্রমাণ পায়। সেখানে দেখা যায় কনস্টেবল মশিউর মাগুরা পুলিশ অফিসের কোডের অনুকূলে পরিশোধিত ১ কোটি ৭৬ লাখ ৫৩ হাজার ৪৮৩ টাকা আজমল মুন্সি নামে এক ব্যক্তির হিসাবে জমা করেছেন। পেশায় পশুরোগ চিকিৎসক আজমল মুন্সির বাড়ি কনস্টেবল মশিউরের বাড়ির এলাকা নড়াইলের মহাজন পাড়ায়। এছাড়া, ফিরোজ হোসেন নামে অপর এক কনস্টেবলের হিসাবে ১৯ লাখ ৯৯ হাজার ২০০ টাকা এবং রুকাইয়া ইয়াসমিন বিচিত্রা নামে একজনের হিসাবে ৪৯ লাখ ৪৯ হাজার ৪০০ টাকা জমা করা হয়।
অন্য একটি সূত্রে জানা যায়, ২০১৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর আজমল মুন্সির নামে মাগুরা সোনালী ব্যাংক প্রধান শাখায় একটি অ্যাকাউন্ট খোলা হয়। এর অথোরাইজেশনে পুলিশ সুপারের সিল এবং স্বাক্ষর ব্যবহার করা হয়। সে সময় মনিবুর রহমান মাগুরায় পুলিশ সুপার হিসেবে ছিলেন। তবে এ বিষয়ে তার কিছু জানা নেই বলে তিনি জানিয়েছেন।
আজমল মুন্সি পুলিশ অফিসের কর্মচারী না হওয়া সত্ত্বেও তার নামে পুলিশ সুপারের অথোরাইজেশনে হিসাব নম্বরটি খুলতে মাগুরা সোনালী ব্যাংকের দায়িত্বরত তৎকালীন সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার আবদুর রশিদ রহস্যজনক কারণে যাচাই-বাছাই করেননি।
এ জালিয়াতির মাধ্যমে প্রস্তুতকৃত চেকগুলো কার্যকর করে তুলতে কনস্টেবল মশিউর জেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার স্বাক্ষর ব্যবহার করে অনলাইন এডভাইস পেপার তৈরি করেন। পাশাপাশি হিসাবরক্ষণ অফিসের সার্ভার এবং মেইল অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে সোনালী ব্যাংকের অনুকূলে তা প্রেরণ করেন। তবে এসব কাজের সাথে নিজেরা কেউ জড়িত নন বলে দাবি করেছেন হিসাবরক্ষণ অফিসের কর্মকর্তা-অডিটররা।
জেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা সরকার রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘পুলিশ অফিসের কোডের অনুকূলে উত্তোলিত এবং আত্মসাৎকৃত অর্থ সেখানকার কর্মরতদের সরকারি প্রভিডেন্ট ফান্ড এবং ঠিকাদারদের জামানতের অর্থ। কিন্তু কনস্টেবল মশিউর আমার স্বাক্ষর জাল করে এসব অর্থ উত্তোলন করেছেন। কিন্তু পেমেন্ট দেয়ার ক্ষেত্রে এডভাইস পেপারে গড়মিল পাওয়ার পরও ব্যাংক কেন চেকগুলো ডিজঅনার করেনি জানি না। এ চক্রটি ২০১৭ সাল থেকে জালিয়াতি শুরু করে। বিগত সময়ের চেক তল্লাশি করলে আত্মসাৎকৃত অর্থের পরিমাণ আরও বাড়তে পারে।’
মাগুরা সোনালী ব্যাংকের এজিএম রশিদুল ইসলাম বলেন, ‘হিসাবরক্ষণ অফিস থেকে যেসব চেক পাওয়া গেছে সেগুলো যাচাই-বাছাই করে দেখা গেছে সেখানে আমাদের কোনো ত্রুটি নেই। প্রত্যেকের স্বাক্ষর এবং সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরই পেমেন্ট দেয়া হয়েছে। জালিয়াতির কোনো ঘটনা থাকলে তার সাথে ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তা কিংবা কর্মচারী জড়িত নেই।’
এ বিষয়ে মাগুরা পুলিশ সুপার খান মোহাম্মদ রেজোয়ান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘চেক জালিয়াতির বিষয়টি জানতে পেরে ইতোমধ্যে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কামরুল হাসানকে প্রধান করে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এছাড়াও কনস্টেবল মশিউর, কনস্টেবল ফিরোজসহ চারজনকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। পাশাপাশি এ বিষয়ে থানায় একটি সাধারণ ডায়রি করা হয়েছে।’ সূত্র : ইউএনবি
আপনার মতামত জানানঃ