গত দুই বছরের ব্যবধানে গ্রাহক পর্যায়ে ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে প্রায় ১৫৫ শতাংশ। ২০২০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি বাজারে প্রতি লিটার ভোজ্যতেলের মূল্য ছিল ৭৮ টাকা। এখন এক লিটার সয়াবিন তেলের দাম ১৯৮ টাকা। আর এবার বাড়ছে চালের দাম।
চলতি মাসের শুরুতে একজন ক্রেতা যে দামে চাল কিনেছেন, মাসের শেষে এসে চাল কিনতে গেলে তাঁকে বড় ধাক্কাই খেতে হবে। কারণ, তিন সপ্তাহের ব্যবধানে বাজারে সব ধরনের চালের দাম অনেকটা বেড়েছে। সর্বশেষ গত এক সপ্তাহে চালের দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি দুই থেকে পাঁচ টাকা। সব মিলিয়ে তিন সপ্তাহে চালের দাম বেড়েছে পাঁচ থেকে আট টাকা।
দেশে এখন চলছে বোরো ধানের ভরা মৌসুম। প্রতিবছর এই সময় চালের দাম কমতির দিকে থাকে। কিন্তু এবার চিত্র উল্টো। সংশ্লিষ্টদের মতে, দাম বাড়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে, বড় ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্টরা (শিল্পপতিরা) হয়তো ধান ও চাল মজুত রেখেছে।
ভরা মৌসুমেও বাড়ছে দাম
দেশের অন্যতম বড় চালের মোকাম নওগাঁ, কুষ্টিয়ার খাজানগর ও ঢাকার পাইকারি বাজারে খোঁজ নিয়ে চালের দাম বাজার চিত্র দেখা যায়। নওগাঁয় এক সপ্তাহের ব্যবধানে পাইকারি বাজারে প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) চালের দাম ২০০ থেকে ৩০০ টাকা বেড়েছে। জেলার পার-নওগাঁ চাল মোকামের মোটা চাল (স্বর্ণা) কেজিপ্রতি ৪৬ টাকা, মাঝারি (বিআর-২৮, বিআর-২৯) ৪৮ টাকা, সরু চাল হিসেবে পরিচিত জিরা নন-শর্টার ৬০ টাকা, জিরা শর্টার (মিনিকেট) ৬৪ টাকা ও কাটারি নন-শর্টার ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
পাইকারিতে দাম বাড়ার প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারেও। সেখানে প্রতি কেজি মোটা চাল তিন টাকা, মাঝারি দুই টাকা ও সরু চাল চার থেকে পাঁচ টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে।
কুষ্টিয়ার খাজানগর মোকামে গতকাল শনিবার কেজি প্রতি মিনিকেট চাল বিক্রি হয় ৬৩ থেকে ৬৪ টাকায়, যা গত ২৯ এপ্রিল ছিল ৫৬ টাকা। অপরদিকে রাজধানীর মিরপুর-১ নম্বর ও মোহাম্মদপুরের কৃষি মার্কেট বাজারে গতকাল পাইকারিতে মোটা চাল ৪৭ থেকে ৪৮ টাকা ও মাঝারি চাল ৫০ থেকে ৫২ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। আর মিনিকেট প্রতি কেজি ৬৫-৬৬ টাকা এবং নাজিরশাইল ৭৮-৮০ টাকায় বিক্রি হয় বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে খুচরা পর্যায়ে এক সপ্তাহ আগের চেয়ে কেজিপ্রতি তিন-চার টাকা বেশি দামে চাল বিক্রি করতে দেখা যায়। দাম বাড়ার পর গুটিস্বর্ণা প্রতি কেজি ৫৩-৫৪ টাকা, বিআর-২৮ চাল ৫৪-৫৫ টাকা, মিনিকেট ৬৮-৭০ টাকা এবং নাজিরশাইল ৮২-৮৪ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
রাজধানীর মিরপুর-১ চাল আড়ত ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক হারুন-অর-রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, মিল পর্যায়ে চালের দাম প্রতিনিয়ত বাড়ছে। চালের চাহিদা জানিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকার চালকলে ফোন করলেই মালিকেরা বাড়তি দামের কথা শুনিয়ে দিচ্ছেন।
চালকল মালিকেরা বলছেন, ধানের দাম বাড়ার কারণে চাল উৎপাদনের খরচও বেড়েছে। সপ্তাহের ব্যবধানে প্রকারভেদে প্রতি মণ ধানের দাম ৮০ থেকে ২০০ টাকা বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। নওগাঁর অন্যতম বড় ধানের বাজার পত্নীতলা উপজেলার মধুইল বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতি মণ (৪০ কেজি) জিরা ধান মানভেদে (শুকনা ও ভেজা ধান) বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৩৪০ থেকে ১ হাজার ৩৬০ টাকায়।
মধুইল বাজারের ধানের আড়তদার আমিনুল ইসলাম বলেন, এবার পাকা ধান কাটার আগমুহূর্তে প্রচুর বৃষ্টির কারণে খেতেই ধানের একটা অংশ নষ্ট হয়েছে। চাল ব্যবসায়ীদের মধ্যে বেশি ধান কেনার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। ফলে প্রতিদিনই ধানের দাম বাড়ছে।
বাজারে এখন ডাল, তেল, চিনিসহ প্রায় সকল নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য পণ্য ও সাবান, টুথপেস্টসহ নিত্যব্যবহার্য পণ্যের দাম চড়া। এ অবস্থায় চালের মূল্যবৃদ্ধি বিপাকে ফেলছে মানুষকে।
কেন বাড়ছে চালের দাম?
খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেছেন, দেশের বেশির ভাগ মিলমালিক বাজার থেকে ধান কিনলেও উৎপাদনে যাচ্ছেন না। বাজারে নতুন চাল এখনো আসছে না। এখন বাজারে যে চাল পাওয়া যাচ্ছে, তা গত বছরের পুরোনো চাল। তাহলে নতুন ধান যাচ্ছে কোথায়?
এই প্রশ্ন তুলে তিনি বলেছেন, মিলমালিকদের এ অবস্থা চলতে দেওয়া হবে না। কে কী পরিমাণ ধান কিনছেন এবং কে কী পরিমাণ চাল ক্রাশ করছেন বা ভাঙছেন এবং বাজারে ছাড়ছেন, তা খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের প্রতিবেদন আকারে প্রেরণ করতে হবে।
আজ রোববার সচিবালয়ে নিজ অফিসকক্ষে ‘বোরো ২০২২ মৌসুমে অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ ও বাজার মনিটরিং–সংক্রান্ত অনলাইন মতবিনিময় সভায়’ ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্যে খাদ্যমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, বিভিন্ন কর্পোরেট হাউস ধান–চালের ব্যবসা শুরু করেছে। তারা বাজার থেকে ধান কিনে মজুত করছেন এবং প্যাকেটজাত করছেন। প্যাকেটজাত চাল বেশি দামে বাজারে বিক্রিও হচ্ছে। এ সময় ধান–চালের ব্যবসায় সম্পৃক্ত করপোরেট হাউসগুলোর সঙ্গে দ্রুততম সময়ে বৈঠক করতে খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন মন্ত্রী।
খাদ্যমন্ত্রী বলেন, ব্যবসায়ীদের মধ্যে ধান কিনে মজুত করার অসুস্থ প্রতিযোগিতা লক্ষ করা যাচ্ছে। সবাই প্রতিযোগিতা করে ধান কিনছেন, ভাবছেন ধান কিনলেই লাভ। এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা ভালো পরিণতি আনবে না বলে সতর্ক করেছেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার।
ভারত থেকে গম দেওয়া বন্ধ হচ্ছে গুজব ছড়িয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে। অথচ শুধু ভারত নয়, বিশ্বের অনেক দেশ বাংলাদেশকে গম দিতে আগ্রহ প্রকাশ করে চিঠি পাঠিয়েছে বলে উল্লেখ করেন সাধন চন্দ্র মজুমদার।
তিনি বলেন, বোরো সংগ্রহ সফল করতে হবে, পাশাপাশি বাজার মনিটরিং চালিয়ে যেতে হবে। কেউ যাতে বাজার অস্থিতিশীল করতে না পারে, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে উল্লেখ করে মিন্ত্রী বলেন, কে কোন দল করে সেটি বিবেচ্য নয়। কেউ চালের বাজার অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
উত্তরাঞ্চলে ঝড় ও বৃষ্টিতে ধানের ক্ষতি হয়েছে। কোন জেলায় কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার সঠিক হিসাব জানা জরুরি। উৎপাদনের হিসাব ও ক্ষতির পরিমাণ নিরুপণ করা না গেলে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হবে না। এ সময় সঠিক তথ্য প্রেরণের জন্য কৃষি বিভাগের কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেন মন্ত্রী।
নওগাঁ ধান ও চাউল আড়তদার সমিতির সভাপতি নিরোদ বরণ সাহা বলেন, ‘ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে খাদ্যসংকট তৈরি হবে, এমনটা প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রচারিত হয়েছে। ফলে অনেকেই ভাবছেন, আমাদের দেশে চালের সংকট তৈরি হবে। সে কারণে অনেকেই অবৈধভাবে চাল মজুত করছেন।’ এ ধরনের অবৈধ মজুতদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
এসডব্লিউ/এসএস/১৮৫২
আপনার মতামত জানানঃ