পাকিস্তানে আগে থেকেই টালমাটাল ছিল অর্থনৈতিক অবস্থা। এখন চলছে রাজনৈতিক সংকট। এর মধ্যেই মার্কিন ডলারের বিপরীতে পাকিস্তানি রুপির ঐতিহাসিক দরপতন হয়েছে। প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য ছাড়িয়েছে ২০০ রুপি।
পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম জিও নিউজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৃহস্পতিবার দিনের শুরুতে ডলারের বিপরীতে রুপির মান ছিল ১৯৮ দশমিক ৩৯; কিন্তু মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এই মান ২০০ ছাড়িয়ে যায়।
ফোরেক্স এসোসিয়েশন অব পাকিস্তানের তথ্য মতে, আন্তঃব্যাংক লেনদেনে দুপুর ১ টা বেজে ৪৫ মিনিটে প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য দাঁড়ায় ২০০.১০ রুপির আশপাশে। খোলা বাজারব যা ৩ টা বেজে ৫০ মিনিটে ২০১ রুপিতে বিক্রি হয়েছে। যেখানে ফ্যাপ জানাচ্ছে, গত দিনের শেষে যা ছিল ১৯৯ রুপি।
১৯৪৭ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর গত ৭৫ বছরের ইতিহাসে নিজেদের মুদ্রার এই পরিমাণ পতন দেখেনি পাকিস্তান।
চলমান অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় ৬০০ কোটি ডলারের তহবিলের জন্য যখন পাকিস্তানের সরকার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে তদবির করছে, সে সময়েই ঘটল মুদ্রার এই দরপতন।
এদিকে, রুপির এই দরপতনের কিছুক্ষণের মধ্যেই শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে জরুরি বৈঠকে বসেন পাকিস্তানের প্রধামন্ত্রী শেহবাজ শরিফ। বৈঠকে তিনি দেশের বর্তমান পণ্য আমদানি-রফতানির হালনাগাদ পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চান। পাশাপাশি, বিলাসবহুল ও অতি জরুরি নয়—এমন পণ্য আমদানির বিষয়ে সরকার যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল, সেটির বাস্তবায়ন সম্পর্কিত প্রতিবেদনও তলব করেন তিনি।
সূত্র মতে, পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, কয়েকদিনের মধ্যে জ্বালানির মূল্য পুনরায় মূল্যায়ন করবে কর্তৃপক্ষ এবং কর আরোপের পরিবর্তে প্রায় ৩০ টি বিলাসবহুল পণ্যের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ হতে পারে। যার মধ্যে থাকতে পারে যানবাহন, মোবাইল ফোনও।
Interbank closing #ExchangeRate for todayhttps://t.co/1Ygp803qoD pic.twitter.com/ITPIZIgCO8
— SBP (@StateBank_Pak) May 19, 2022
আজকের আন্তঃব্যাংক ক্লোজিং এক্সচেঞ্জ রেট
বিশেশজ্ঞদের মার্কিন ডলারের বিপরীতে পাকিস্তানি রুপির রেকর্ড এই দরপতন, দেশটার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও টালমাটাল করে তুলবে।
আগাম নির্বাচন ঘোষণার কারণে এমনিতেই দেশটির বর্তমান সরকারের ওপর ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক চাপ তৈরি হয়েছে। এর মধ্যেই রুপির মান এতটা কমে যাওয়ায় অর্থনৈতিক সংকট আরও তীব্র হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
করাচিভিত্তিক আর্থিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান টপলাইন সিকিউরিটিজের প্রধান মোহাম্মাদ সোহাইল বলেন, ‘অনিশ্চয়তা থেকে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছে। আর এটা রুপির মূল্যের ওপর খারাপ প্রভাব ফেলছে।’
এদিকে গত এপ্রিলের প্রতিবেদন অনুযায়ী, পাকিস্তানের রিজার্ভ ১ হাজার ৬০০ কোটি মার্কিন ডলার থেকে কমে বর্তমানে ১ হাজার ২০০ কোটি মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে।
জুলাই ১, ২০২১ থেকে পাকিস্তানি রুপির মান ২৭ শতাংশ কমেছে। আজ বৃহস্পতিবার আন্তঃব্যাংক লেনদেনে মার্কিন ডলারের বিপরীতে পাকিস্তানি রুপির মান ২০০ ছাড়িয়েছে। অর্থাৎ দেশটিতে এক ডলার কিনতে এখন ২০০ রুপির বেশি খরচ করতে হচ্ছে। জিও নিউজের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়।
বিশ্লেষকদের মতে, চাহিদার তুলনায় বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ কম, বিশ্বব্যাপী নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে দেশটির অর্থনীতিতে।
এমন পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ দেশটির মুদ্রার মানের পতন ঠেকাতে এবং অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠার বিষয়ে জরুরি বৈঠক ডাকেন। ওই বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীকে দেশের আমদানি-রপ্তানি পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করা হয়।
অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আমদানিতে নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে প্রতিবেদন উপস্থাপন করতে তিনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন। চলতি সপ্তাহে আইএমএফ মিশনের প্রধানের সঙ্গে ভার্চুয়াল বৈঠক করেন পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী মিফতাহ ইসমাইল।
এর আগে গত ৯ মে মার্কিন ডলারের বিপরীতে রেকর্ড দরপতন হয় ভারতীয় মুদ্রার। প্রতি ডলারের বিপরীতে ভারতীয় রুপির মান নেমে দাঁড়ায় ৭৭ দশমিক ৪৬, যা সর্বকালের অন্যতম সর্বনিম্ন।
পাকিস্তানি মুদ্রা ডিলার, বিশেষজ্ঞ এবং বিশ্লেষকদের কাছে ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রার মূল্য হ্রাসের অনেকগুলো কারণ দেখছেন। কিন্তু স্থিতিশীলতা আনতে এই অবমূল্যায়ন বন্ধ করতে স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান (এসবিপি) কোনো হস্তক্ষেপ করছে না বলে জানান তারা।
ওয়েব বেসড ফিন্যান্সিয়াল ডেটা এবং এনালিটিক্যাল পোর্টাল মেটিস গ্লোবালের কো-ফাউন্ডার সাদ বিন নাসির দেশটির কেন্দ্রিয় ব্যাংকের রিজার্ভ ৭.৫ বিলিয়ন কমে যাওয়ার দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করে বলেন, বর্তমান সরকার চীন, সৌদি আরব এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকে অনুদান আনতে সক্ষম হবে কিনা, এই সন্দেহে আমদানিকরা প্যানিক বায়িংয়ে জড়িয়ে পড়ে।
অন্যদিকে, রপ্তানিকারকেরা তাদের অর্থ দেশের বাইরে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যার কারণ ডলারের বিপরীতে পাকিস্তানি রুপির এই অস্বাভাবিক দরপতন।
উপরন্তু ২০২০ সালের পর থেকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সর্বনিম্নে এসে ঠেকেছে। মাত্র ১০.৩ বিলিয়ন।
পাকিস্তানি রুপির আজকের দরপতন প্রসঙ্গে ফ্যাপের সেক্রেটারি জেনারেল ফাফর পারচা বলেন, আজ পাকিস্তানের ইতিহাসে অন্ধকারময় দিন। এদিকে, ফ্যাপের চেয়ারপারসন মালিক বসটন, রপ্তানি বন্ধে ফেডারেল বোর্ড অব রেভিনিউকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
২০১৮ সাল থেকেই অর্থনৈতিক সংকট চলছে পাকিস্তানে। করোনা মহামারিতে তা হয়েছে আরও তীব্র। দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকে মাত্র দেড় মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো ডলার মজুত আছে।
এসডব্লিউ/এসএস/২০২০
আপনার মতামত জানানঃ