দেশের মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষার্থীদের ওপর যৌন নির্যাতনের খবরে শিউরে উঠছে সারা দেশ। যদিও মাদ্রাসাগুলোতে ক্রমবর্ধমান এই ধর্ষণ নিয়ে মাথাব্যথা নেই সরকারের। দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলোও সরব নয়। নেই বার্ষিক কোন প্রতিবেদন। তাই এই সব নির্যাতনের প্রকৃত চিত্র থেকে যাচ্ছে অজানা।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের পর শিক্ষার্থীরা লজ্জা, ভয়, নানান কিছুর কারণে তা প্রকাশ করে না। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে শিশুদের উপর যৌন নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে সবথেকে কম কথা বলা হয়। এর কারণ হয়তো সেক্স, অপ্রাপ্তবয়স্ক ভুক্তভোগী এবং ধর্মের মতো স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে মানুষের অন্ধবিশ্বাস।
মাদ্রাসা শিক্ষক কর্তৃক একের পর এক শিশু ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা মাদ্রাসা বিষয়ে দেশবাসীর নিকট এক নেতিবাচক মনোভাব তৈরী হয়েছে।
আজকের শিশুরাই আগামী দিনের দেশ গড়ার কারিগর। আজ যারা শিশু, কাল তারাই বিশ্বের নেতৃত্ব দেবে। আজ যারা বিখ্যাত ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত, একদিন তারাও শিশু ছিলেন। তাই শিশুদের নিয়ে তাদের রয়েছে নানা ভাবনা। কিন্তু সারাদেশে বিভিন্ন মাদ্রাসায় বহু ছেলেশিশু যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। আর এর জন্য দায়ী হচ্ছেন কখনো খোদ মাদ্রাসা শিক্ষক তথা মাদ্রাসা সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে লালমনিরহাটের হাতীবান্ধায় ছাত্রকে যৌন হয়রানির অভিযোগে মাদ্রাসার এক শিক্ষককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
হাতীবান্ধা উত্তর পারুলিয়া এলাকার বটতলা হাফেজিয়া মাদ্রাসা থেকে সোমবার(১৬ মে) রাত ১০টার দিকে গোলাম রব্বানিকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার বাড়ি উত্তর পারুলিয়া গ্রামে।
এর আগে রবিবার রাতে উত্তর পারুলিয়া বটতলা হাফিজিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানার এক ছাত্রকে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। গোলাম রব্বানী উত্তর পারুলিয়া বটতলা হাফিজিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানার শিক্ষকের পাশাপাশি অবস্থিত একটি মসজিদে ইমামতি করেন।
মামলার এজাহারে বলা হয়, রোববার রাত ১০টার দিকে রব্বানি তার মাদ্রাসার এক ছাত্রকে যৌন নির্যাতন করেন। ওই ছাত্র চিৎকার করলে রব্বানি তাকে নানা রকম ভয়ভীতি দেখান। সোমবার সকালে শিশুটি বাড়ি ফিরে তার পরিবারের সদস্যদের বিষয়টি জানায়।
এরপর সোমবার বিকেলে তার বড় ভাই রব্বানির নামে হাতীবান্ধা থানায় যৌন নির্যাতনের অভিযোগ করেন।
ওসি বলেন, ‘আমরা শিশুটির পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ পেয়ে ওই শিক্ষককে আটক করি। আটকের পর তার নামে করা অভিযোগ মামলা হিসেবে নথিভুক্ত করা হয়। মঙ্গলবার সকালে তাকে আদালতে পাঠানো হয়েছে।’
রোববার রাত ১০টার দিকে রব্বানি তার মাদ্রাসার এক ছাত্রকে যৌন নির্যাতন করেন। ওই ছাত্র চিৎকার করলে রব্বানি তাকে নানা রকম ভয়ভীতি দেখান। সোমবার সকালে শিশুটি বাড়ি ফিরে তার পরিবারের সদস্যদের বিষয়টি জানায়।
সংশ্নিষ্টরা জানান, মাদ্রাসাগুলোয় দিনের পর দিন ছেলে শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটে চললেও তা বন্ধে এখনও তেমন কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ফলে বিপথগামী কিছু শিক্ষক ও মাদ্রাসাসংশ্নিষ্টরা এটাকে অপরাধ বলেই গণ্য করেন না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিজেদের অপরাধ আড়াল করতে ধর্মের নানা অপব্যাখ্যা দেন জড়িতরা। আবার ধর্ষণের দৃশ্য ভিডিও করে রেখে তা ছড়ানোর ভয় দেখিয়ে শিশুদের জিম্মি করার ঘটনাও রয়েছে।
বাংলাদেশে এখন ছেলে শিশু ধর্ষণ উদ্বেগজনক হারে বড়ে গেছে৷ কিন্তু ধর্ষকদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেওয়ার তেমন কোনো নজির দেখা যায় না। প্রায় সমস্তটাই স্থানীয় জনপ্রতিনিধি কিংবা মাতব্বর কর্তৃক শালিসে বিচারের মাধ্যমে সুরাহা করা হয়। তবে এবিষয়ে আইনে সুস্পষ্টভাবে তেমন কিছু নেই বলে অনেকে দাবি করলেও আইন বিশেষজ্ঞরা জানান, একটা ভুল ধারণা চলে আসছিল যে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে শুধু নারী ও মেয়ে শিশু ধর্ষণের শিকার হলেই বিচার করা যাবে৷ কিন্তু এই আইনের সংজ্ঞায় শিশু বলতে ছেলে বা মেয়ে আলাদা করা হয়নি৷ ১৬ বছর পর্যন্ত সব শিশুকেই বুঝানো হয়েছে৷ শিশু আইনেও শিশুদের কোনো লিঙ্গ ভাগ করা হয়নি৷ তাই ১৬ বছর পর্যন্ত কোনো ছেলে শিশু যদি ধর্ষণের শিকার হয় তাহলে ধর্ষণ মামলাই হবে৷ যার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড৷
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, আলিয়া মাদ্রাসা ছাড়া অন্য মাদ্রাসাগুলোতে সরকারের নিয়ন্ত্রণ বা তদারকি সেভাবে নেই। সেজন্য যৌন নির্যাতন বা শিশু শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতনের সুযোগ থাকে। এছাড়া সেখানে পরিবেশ এমন যে, শিশু শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ অনেক সময় প্রকাশও হয় না। কওমি, এবতেদায়ী বা নূরানী-বিভিন্ন ধরনের মাদ্রাসা পরিচালনার জন্য বেসরকারি উদ্যোগে কর্তৃপক্ষ যারা রয়েছে, তাদের তদারকি বাড়ানো উচিত বলে মনে করেন তারা।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, অনেকে মনে করেন এরা আদব কায়দা শিক্ষা দেন। নৈতিকতা শিক্ষা দেন। সে কারণে ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে হোক বা নিরাপত্তার কথা ভেবে অনেকে ছেলেমেয়েদের মাদ্রাসায় পড়াতে দেন। কিন্তু বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে, যে নিরাপত্তার কথা ভেবে মাদ্রাসায় ছেলেমেয়েদের পড়াতে দেয়া হয় সেখানে আদৌ নিরাপদ নয়। দেখা যায় ছেলেরাও নিরাপদ নয় এসব তথাকথিত হুজুরদের কাছে। এটিও সমাজের বৈকল্যতা।
তারা বলেন, এমন ঘটনা অনেক হচ্ছে, তবে তা জানা যাচ্ছে কম। যখন কেউ মারা যায় বা নির্যাতনে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে তখনই কেবল তা প্রকাশ্যে আসে। মাদ্রাসা বোর্ডকে এ ব্যাপারে শক্ত ভূমিকা রাখতে হবে। কেন এসব ঘটছে তা খুঁজে বের করতে হবে। জড়িতদের যথাযথ শাস্তি দিতে হবে।
আরও বলেন, সেখানে এমন কোনো কমিটিও নেই যেখানে নির্যাতনের শিকার শিশুরা কথা বলতে পারবে। আর বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দরিদ্র শিশুরা মাদ্রাসায় পড়ে বলে তাদের নানা অজুহাতে দমিয়ে রাখাও সহজ হয়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৪৪
আপনার মতামত জানানঃ