মোট দেশ উৎপাদন (জিডিপি) –এর সাথে ক্রয়ক্ষমতার সমতা বা পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটির (পিপিপি) তুলনা করে প্রকাশিত র্যাঙ্কিংয়ে বিশ্বের ২০তম অর্থনীতি হয়েছে ইরান। ২০২১ সালে এ অর্জন করেছে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা কবলিত ইরান। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এর সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন সূত্রে এসব কথা জানা গেছে।
বিশ্বের দেশে দেশে যেহেতু বিভিন্ন পণ্য ও সেবার দাম কমবেশি হয়, সে জন্য বিভিন্ন দেশের জনগণের জীবনযাত্রার মানকে তুলনীয় করার জন্য পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি (পিপিপি) পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে নমিনাল জিডিপিকে ‘পিপিপি ডলারে জিডিপি’তে রূপান্তরিত করা হয়।
আইএমএফ জানিয়েছে, মাথাপিছু জিডিপির সাথে পিপিপি বা ক্রয়ক্ষমতার সমতার ভিত্তিতে ২০২১ সালে ইরানি অর্থনীতির আকার ছিল প্রায় ১ লাখ ৪৩ হাজার কোটি ডলার। অর্থাৎ, গত বছরে ইরানের অর্থনীতি অন্য ১৭৩টি দেশের চেয়ে আকারে বড়ই ছিল।
২০২১ সালে ইরানের চেয়েও ছোট অর্থনীতি ছিল মিশর, থাইল্যান্ড, পাকিস্তান, নেদারল্যান্ডস, আর্জেন্টিনা, দক্ষিণ আফ্রিকা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সুইজারল্যান্ড, বেলজিয়াম, সুইডেন, অস্ট্রিয়া, নরওয়ে, পর্তুগাল, গ্রীস, ফিনল্যান্ড, ওমান এবং কুয়েতের মতো দেশের।
চলতি ২০২২ সালে পিপিপি ভিত্তিতে ইরানি অর্থনীতি আরও ১৩৭ বিলিয়ন ডলার বেড়ে ১ লাখ ৫৭ হাজার কোটি ডলার হবে বলে পূর্বানুমান প্রকাশ করেছে আইএমএফ।
আইএমএফের প্রতিবেদন অনুসারে, পিপিপি ভিত্তিতে ২০২১ সালে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি হয়েছিল চীন। এ হিসাবে যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় স্থান লাভ করে। ২০২১ সালে পিপিপি ভিত্তিতে চীনা অর্থনীতির আকার ছিল ২৭ লাখ কোটি ডলারের বেশি। সে তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ছিল প্রায় ২৩ লাখ কোটি ডলারের।
নিষেধাজ্ঞায় জর্জরিত ইরান
সেই ৮০’র দশক থেকে ইরান মার্কিন নিষেধাজ্ঞার শিকার। কেবল সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আমলেই ইরানের ৬৫৫ প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। এ তথ্য জানিয়েছে প্রভাবশালী থিঙ্ক ট্যাঙ্ক- সেন্টার ফর নিউ আমেরিকান সিকিউরিটি (সিএনএএস)।
তবে সাম্প্রতিক কালের সবচেয়ে কঠোর বিধি-নিষেধ আসে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মেয়াদে। ইরানের সাথে বিশ্ব শক্তিগুলোর সম্পাদিত পরমাণু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে তার প্রশাসন। এরপর ২০১৮ সাল থেকেই অত্যন্ত নির্দয় কিছু নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দেওয়া হয়। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল- সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশনস (সুইফট) থেকে ইরানি ব্যাংকগুলোকে বাদ দেওয়া। সুইফট আসলে বৈশ্বিক আন্তঃব্যাংক লেনদেন বার্তা প্রেরক ব্যবস্থা।
২০১৮ সালের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে কেবল নিত্যনতুন নিষেধাজ্ঞার ঝুলিই খুলেছিল ট্রাম্প প্রশাসন। তারপর আসে আরো অনেক। ইরানের অর্থনীতিকে প্রচণ্ড চাপে ভেঙে পড়ার দ্বারপ্রান্তে উপনীত করে দেশটিকে আলোচনার টেবিলে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যেই এমন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে বলে যুক্তি দেয় হোয়াইট হাউজ।
২০২০ সালে ইরানের ব্যাংকগুলোর ওপর আরো নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। তখন দেশটির আর্থিক খাত কার্যত বিশ্ব অর্থনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ওই বছরেই প্যারিস ভিত্তিক ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স (এফএটিএফ) ইরানকে কালো তালিকা ভুক্ত করে।
এসব পদক্ষেপ ছিল কেবল সংবাদ শিরোনামে আসার মতো বড় ঘটনা। সিএনএএস-এর তথ্যমতে, সব মিলিয়ে ইরানের অর্থনীতির ওপর ৯৬০টি নিষেধাজ্ঞা দেয় ট্রাম্প প্রশাসন।
ওই সময়ে কোভিড-১৯ মহামারিতে ইরানে বিপুল সংখ্যক মানুষের মৃত্যু হয় সঠিক ওষুধ ও চিকিৎসা উপকরণের অভাবে। মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ সংক্রমণ ঢেউয়ের শিকার দেশটিকে মানবিক বিবেচনায় নিষেধাজ্ঞার সর্বাত্মক জাল থেকে সাময়িক নিষ্কৃতি দিতে মানবাধিকার সংস্থা এবং কয়েকজন বিশ্বনেতাও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি অনুরোধ করেন। কিন্তু, তাতে কর্ণপাত না করে কঠোর অবস্থান ধরে রাখে যুক্তরাষ্ট্র।
ট্রাম্প আমলের সেসব নিষেধাজ্ঞা প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন-ও অব্যাহত রেখেছেন। ওয়াশিংটনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা থেকে আজ ইরানি অর্থনীতির কোনো খাতই মুক্ত নয়। যেকারণে দেশটি দুই বছরব্যাপী মন্দার মধ্যে পড়েছে, ব্যাহত হচ্ছে নাগরিকদের দৈনন্দিন জীবন।
ইরানের বার্ষিক মূল্যস্ফীতি এখন ৪২ শতাংশেরও মতো ভয়াবহ হারে পৌঁছেছে। খোদ দেশটির পরিসংখ্যান দপ্তর দিয়েছে এ তথ্য। জাতীয় মুদ্রা- ইরানি রিয়াল গত তিন বছরে হারিয়েছে তার অর্ধেকের বেশি বিনিময় মূল্য।
দেশটির প্রধান রপ্তানিখাত পেট্রোলিয়াম। ২০১৭ সালে তেল রপ্তানি দৈনিক ২৫ লাখ ব্যারেল হলেও; নিষেধাজ্ঞার মুখে ২০২০ সালে তা মাত্র ৪ লাখ ব্যারেলে নেমে এসেছে বলে জানিয়েছে ইউএস এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। অবশ্য গেল বছর থেকে দেশটির জ্বালানি রপ্তানি কিছুটা পুনরুদ্ধার লাভ করেছে।
তাই বলে ইরানের অর্থনীতি একেবারে ভেঙে পড়েছে তাও নয়। গেল বছরেই খুব নিম্ন অবস্থান থেকে হলেও প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরতে শুরু করেছে অর্থনীতির চাকা। আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্য বৃদ্ধি, কোভিড-১৯ জনিত বিধিনিষেধ লাঘব এবং বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের চড়া দাম—এসবই রাখে ইতিবাচক ভূমিকা।
অনেক আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকের ধারণার চেয়েও বেশি অদম্যতা ও বৈচিত্র্য দেখিয়েছে ইরানি অর্থনীতি। ২০২০-২১ অর্থবছরে যা ২.৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক। ২০২১-২২ বা চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ৩.১ শতাংশ হওয়ার আভাসও দিয়েছে ওয়াশিংটন-ভিত্তিক দাতা সংস্থাটি।
নিষেধাজ্ঞা প্রতিরোধী অর্থনীতি
ইরানের নতুন প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রইসির প্রশাসন আরো উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য নিয়েছে। রইসি বলেছেন, তিনি ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি চান।
রক্ষণশীল এই প্রেসিডেন্ট বিশ্বাস করেন ‘নিষেধাজ্ঞা প্রতিরোধী অর্থনীতি’ ডকট্রিন বাস্তবায়নের মাধ্যমে তা অর্জন করা সম্ভব বলে। এই নীতিতে বিভিন্ন খাতে সম্পূর্ণ স্বনির্ভর হওয়ার পাশাপাশি রয়েছে চীন ও রাশিয়ার মতো আঞ্চলিক প্রতিবেশীদের সাথে বাণিজ্যের সম্পর্ক জোরদার করা।
এসব পদক্ষেপ এবং ভিয়েনায় নতুন পরমাণু চুক্তির বিষয়ে ইরানি কূটনৈতিকদের আলোচনায় অংশগ্রহণ নিষেধাজ্ঞার চাপ কিছুটা হলেও কমিয়ে অর্থনীতিকে বিকাশের ধারায় এনেছে, তবে সেক্ষেত্রে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে।
এনিয়ে ইউরেশিয়ান নেক্সাস পার্টনার্সের ম্যানেজিং পার্টনার বিজান খাজেহপুর বলেন, “ইরানের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সম্ভাবনাকে ব্যাহত করবে ব্যাংকিং খাতের ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং এফএটিএফ এর কালো তালিকাভুক্তিকরণ।”
তিনি কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল জাজিরাকে বলেন, ব্যাংকিং খাতের নিষেধাজ্ঞা বজায় থাকলে, লেনদেনে বিপুল খরচ থেকেই যাবে। ফলে আমদানি ও রপ্তানি দুইই ব্যয়বহুল হয়ে থাকবে। ফলে নির্দিষ্ট কিছু বাজার ও কোম্পানির সাথেই যুক্ত হতে পারবে ইরানি অর্থনীতি, যা হবে বিকাশের প্রতিবন্ধক।
তার মতে, “একারণে স্বল্প মাত্রার প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারলেও, সমৃদ্ধির কাঙ্ক্ষিত দ্বারে পৌঁছাতে পারবেনা ইরানি অর্থনীতি।”
খাজেহপুর আরো জানান, সীমিত এই প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে হলেও অবকাঠামো খাতে বড় কিছু বিনিয়োগ জরুরি, আর শুধুমাত্র নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলেই সে ধরনের বিনিয়োগ আসা সম্ভব।
আগামী মার্চের শেষদিকে ইরানি নববর্ষের শুরুতে নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত থাকবে এমন অনুমান করে প্রণীত প্রস্তাবিত বাজেট উত্থাপন করবে রইসির প্রশাসন। সেখানে তেল খাত থেকে আয় বৃদ্ধি এবং ৬০ শতাংশ রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির অনুমান রয়েছে।
এসব প্রাক্কালন পূরণ হলেও উল্লেখযোগ্য বাজেট ঘাটতির মধ্যে দিয়েই যাবে তেহরান। কয়েক যুগের পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার ফলে ট্রাম্প আসার আগে থেকেই বার্ষিক ঘাটতি সাধারণ বিষয় হয়ে ওঠে।
চীন ও রাশিয়ার ভূমিকা
জ্বালানি তেল বিক্রির বেশিরভাগ আয় চীন থেকে আসবে এমন প্রত্যাশা তেহরানের। বেইজিং-ই এখন ইরানি তেলের শীর্ষ ক্রেতা।
নিষেধাজ্ঞার কারণে দুই দেশের মধ্যে তেল বাণিজ্যের পরিমাণ গোপন রাখা হয়। ইরান থেকে কেনা অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের চালান মালয়েশিয়া, ওমান বা আমিরাতের মতো কোনো দেশ থেকে আসছে বলে দেখায় বেইজিং।
তবে চলতি বছরের জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে গোপনীয়তার এই চাদর সরিয়ে ২০২০ সালের ডিসেম্বরের পর প্রথমবার ইরান থেকে অপরিশোধিত তেল আমদানির কথা জানায় চীন। মার্কিন নিষেধাজ্ঞা অবজ্ঞা করেই যা তারা বাণিজ্য করছে তা ঘোষণা দিয়ে জানিয়ে ওয়াশিংটনকে বিব্রত করেছে এশীয় পরাশক্তিটি।
আন্তর্জাতিক জ্বালানি তেলের বাজারও ঝুঁকে আছে ইরানের অনুকূলে। গেল সপ্তাহে বিগত সাত বছরের মধ্যে তেলের মূল্য সর্বোচ্চ মাত্রা স্পর্শ করে। ইউক্রেন নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের সাথে রাশিয়ার উত্তেজনা এবং ওপেক প্লাস জোটের সরবরাহ কর্তন ধরে রাখায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়।
বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য চাঙ্গা এমন সময়ে হয়েছে, যার দিনকয়েক আগেই তেল রপ্তানি বৃদ্ধির কথা জানায় রইসি প্রশাসন। প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির সাবেক প্রশাসনের শেষ মাস গেল বছরের আগস্টের তুলনায় যা ৪০ শতাংশ বেড়েছে।
জানুয়ারি মাসে চীন ও রাশিয়ার সাথে রাজনৈতিক ও অর্থনীতির দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদার করতেও ব্যস্ত সময় পার করেছেন ইরানি কর্মকর্তারা।
ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আব্দুলাহি চীনের জিংশু সফরকালে বলেন, ২০২০ সালে দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত একটি সহযোগিতার চুক্তি বাস্তবায়ন পর্যায়ে রয়েছে। অবশ্য তিনি এব্যাপারে বিস্তারিত জানাননি।
অন্যদিকে, রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে ক্রেমলিনে বৈঠক করেন ইব্রাহিম রইসি। আলোচনায় দুই নেতাই পারস্পরিক সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ করার ওপর জোর দেন, দুই দেশের কর্মকর্তারা একাধিক চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকে সই করেন। ইরানি কর্মকর্তাদের দাবি, নিকট ভবিষ্যতে এসব চুক্তি বাস্তব সুফল বয়ে আনবে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৭৩৫
আপনার মতামত জানানঃ