বাংলাদেশে প্রথম লকডাউন চালুর পর পার হয়েছে দুই বছর। শিশু অধিকার কর্মীরা বলছেন, দেশের হাজার হাজার শিক্ষার্থী আর বিদ্যালয়ে ফিরতে পারেনি, যাদের অধিকাংশের বয়স ১২ বা তার বেশি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সময়টায় দরিদ্র পরিবারের এসব সন্তান পুরোদস্তুর শিশুশ্রমিকে পরিণত হয়েছে।
২০২০ সালের মার্চে সরকার প্রথম যখন করোনা সংক্রমণ রোধে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়, তখন কেউই ভাবেনি এরপর ১৮ মাস স্কুল বন্ধ থাকবে। বাংলাদেশের এই শিক্ষাখাতের অচলাবস্থা পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম দীর্ঘতম স্কুল-কলেজ বন্ধের ঘটনা।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সশরীরে পাঠদান পুনরায় শুরু হলেও, ওমিক্রন ভেরিয়েন্ট বিস্তারের কারণে কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাব আবারও বাড়লে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে টানা চার সপ্তাহ বন্ধ ছিল স্কুল।
স্কুলে ফেরেনি হাজার হাজার শিক্ষার্থী
বাংলাদেশে প্রথম লকডাউন চালুর পর প্রায় দুই বছর পার হয়েছে। শিশু অধিকার কর্মীরা বলছেন, দেশের হাজার হাজার শিক্ষার্থী আর বিদ্যালয়ে ফিরতে পারেনি, যাদের অধিকাংশের বয়স ১২ বা তার বেশি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সময়টায় দরিদ্র পরিবারের এসব সন্তান পুরোদস্তুর শিশুশ্রমিকে পরিণত হয়েছে।
২০২০ সালের মার্চে সরকারের লকডাউন ঘোষণা আসার আগে ঢাকার শান্তিপুর হাই স্কুলটিতে ৫-১৭ বছরের শিক্ষার্থী ছিল ১,১০০ জন। কিন্তু ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে যখন দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর স্কুলের মরচে পড়া ফটক উন্মুক্ত হয়, তারপর ফিরেছে মাত্র ৭০০ জন। পরের মাসগুলোয় সেই সংখ্যা আর বাড়েনি।
ডিসেম্বর নাগাদ স্কুলের এতগুলো বেঞ্চ খালি পড়ে থাকতে শুরু করে যে সেগুলো রদ্দি হিসেবে বেচে দেওয়া শুরু করেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। যে শিশুদের অভাবে বেঞ্চগুলিও রদ্দির খাতায় নাম লেখাল–তাদের দুই-তৃতীয়াংশই আসলে বালক শিশু।
মহামারির শুরুর পর থেকে বাংলাদেশে ঠিক কতজন শিশু কাজে যোগ দিয়েছে তা সঠিকভাবে জানার কোনো উপায় নেই। টাইম ম্যাগাজিন একটি ধারণা পেতে, সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত ২০টি স্কুলের শিক্ষার্থী উপস্থিতির তথ্য সংগ্রহ করে।
এতে দেখা গেছে, ২০২০ সালের মার্চ এবং ২০২১ সালের নভেম্বর– এ সময়ের মধ্যে স্কুল থেকে ঝরে পড়াদের মধ্যে কমপক্ষে ৫৯ শতাংশ ছিল বালক। ছেলে শিশুদের ঝরে পড়ার এই বৈষম্যমূলক হারকে বাংলাদেশভিত্তিক সুপ্রতিষ্ঠিত এনজিও ব্র্যাকের তথ্যও সমর্থন করছে।
সমস্যা কেন জটিল হল
মহামারিকালে বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় শিশুশ্রমিক বৃদ্ধি পেয়েছে এমন আশঙ্কা করেছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা- আইএলও। একারণে চলতি বছরের মার্চে শিশুশ্রম সম্পর্কিত ১৩৮ নং কনভেনশনে পুনরায় অনুস্বাক্ষর করে বাংলাদেশ সরকার। ১৪ বছরের নিচের শিশুকে কোনো শিল্পে কাজ করতে দেওয়া হবে না- সে সময় এমন ঘোষণাও দেওয়া হয়। একইসঙ্গে, আগামী তিন বছরের মধ্য সম্পূর্ণরুপে শিশুশ্রম নির্মূলের প্রতিশ্রুতি দেয়।
কিন্তু, প্রতিশ্রুতি হোক বা আশার বাণী, অন্নের দায় বড় দায়। মহামারির কারণে যে ১৮ মাস স্কুল বন্ধ ছিল, তারমধ্যেই দেশজুড়ে গৃহস্থালি আয় গড়ে ২৩ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। অনেক পিতামাতা জানিয়েছেন, তারা কোনো বিকল্প উপায় খুঁজে না পেয়েই ছেলে শিশুদের কাজে পাঠাতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে অন্তত ছোট ভাইবোনদের খাবারের টাকা তারা আয় করতে পারছে। নাহলে তাদেরকেও অনাহারে থাকতে হতো।
মহামারির কারণে স্কুল প্রথম বন্ধের সময় কিন্তু অবস্থা এতোটা খারাপ ছিল না। তারপর একদিন শুরু হলো লকডাউন। যত দিন যায়, কর্মজীবী এলাকার মানুষের আর্থিক সামর্থ্য ততো কমতে থাকে।
বাংলাদেশে যখন মহামারি প্রথম আঘাত হানে, তখন নাগরিক ও সুশীল সমাজের বেশিরভাগের উদ্বেগ ছিল কন্যা শিশুদের নিয়ে। কারণ, অভাব-অনটনের কারণে বহু পরিবার অল্পবয়সী কন্যাদের বাল্যবিবাহ দেয়। সংসারে অন্নের মুখ কমানোর এ চেষ্টায় অনেক মেয়ের বিয়ে হয় দ্বিগুণ বা তিনগুণ বয়সী পুরুষের সাথে।
‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’-এর এক জরিপে লকডাউনের প্রথম ছয় মাসেই বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ অঞ্চলে প্রায় ১৪ হাজার বাল্যবিবাহ রেকর্ড করা হয়। এসব কন্যাশিশুদের অন্তত অর্ধেকের বয়স ছিল ১৩-১৫ বছর।
বাংলাদেশে সার্বিকভাবে মাধ্যমিক শিক্ষা অবৈতনিক নয়। শিক্ষার্থীদের বার্ষিক বেতন দিতে হয় গড়ে ৩ হাজার টাকা (৩৫ ডলার)। অথচ মহামারির আগেই দেশে প্রতি পাঁচ জনের মধ্যে একজনের দৈনিক আয় ছিল এক দশমিক ৯০ ডলারের চেয়েও কম। তার ওপর রয়েছে লাগাতার মূল্যস্ফীতি। গত দুই বছরে স্টেশনারি পণ্য, পাঠ্যপুস্তক বা ইউনিফর্মসহ সব শিক্ষাপণ্যেরও দাম বেড়েছে।
নারী শিক্ষায় যেন দেশ পিছিয়ে না পড়ে, সেজন্য উপবৃত্তি বা ভাতা দেয় সরকার। ১১-১৬ বছরের কন্যাশিশুরা স্কুলে পড়লে, বছরে তারা উপবৃত্তি ও বিদ্যালয়ের বেতনে সরকারের দেওয়া ভর্তুকিসহ গড়ে সাড়ে তিন হাজার টাকা (৪০ ডলার) পায়। এভাবে বাল্যবিবাহ কমাতেও সাফল্য পেয়েছে বাংলাদেশ। অনেক পরিবার এখন তাদের মেয়েদের স্কুলে রাখতেই বেশি আগ্রহ দেখায়।
সে তুলনায় ছেলে সন্তানদের কথা এখন অনেকটা আলাদা। ব্র্যাকের শিক্ষা-বিষয়ক পরিচালক সাফি খান বলেন, “সে তুলনায় কিন্তু ছেলে শিশু যেসব পরিবারে রয়েছে, তাদের কাছে শিক্ষার ব্যয় একটি বড় দুশ্চিন্তা। পরিস্থিতি বেশ নাজুক হলেও, সে তুলনায় তেমন সহায়তার উদ্যোগ নেই।”
লকডাউনের সময় ব্যবসা-বাণিজ্যের মন্দা, জনজীবনে স্থবিরতা প্রান্তিক ব্যবসায়ী ও খেটেখাওয়া মানুষের জীবন সংগ্রামকে কঠিনতর করে তোলে। আর তখনই ছেলে শিশুদের স্কুল থেকে ঝরে পড়া শুরু হয় বলে মন্তব্য করেন আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা- আইএলও’র বাংলাদেশ শাখার পরিচালক তুমো পৌতিয়ানিয়েন।
“এই অবস্থায় লিঙ্গের কারণেও পার্থক্য তৈরি হয়েছে। স্কুল বন্ধ হওয়ার পর বেশিরভাগ দরিদ্র মানুষ তাদের কন্যাদের কাজে পাঠানো নিরাপদ মনে করেনি, সে তুলনায় ছেলে সন্তানদের কাজে পাঠানো তাদের কাছে খুব দরকারি আয়ের উৎস হিসেবে গণ্য হয়।”
বাংলাদেশে কন্যাশিশুদের শিক্ষায় বিদেশি উৎস থেকে সহায়তা এসেছে লাখ লাখ ডলার। তবে শিশু অধিকার কর্মীরা জানান, তারা মহামারিকালে স্কুল ছেড়ে চলে যাওয়া হাজার হাজার ছেলে শিশুদের জন্য একইরকম বা সমান সহায়তা নিশ্চিতের আহ্বান জানিয়ে নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারছেন না।
দাতারা যেন শিশুশ্রমের বিষয়ে ইচ্ছে করেই উদাসীন রয়েছে এমন মন্তব্য করে ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশের পরিচালক টনি মাইকেল গোমেস বলেন, “আমি দুটি ক্ষেত্রে বড় পার্থক্য দেখতে পাচ্ছি। আপনি যদি সত্যিকার অর্থে জানতে চান, তারা (দাতারা) আসলে কীসের জন্য অনুদান দিচ্ছে বা তাদের দেওয়া সম্পদ শিশুদের জীবন উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারছে কিনা- তাহলে আমি ‘না’-ই বলব।”
তার সাথে একমত পোষণ করে ইউনিসেফের বাংলাদেশ প্রতিনিধি শেলডেন ইয়েট বলেন, “কন্যাশিশুরা যে ঝুঁকির মধ্যে থাকে, আমি তা খাটো করতে চাই না। তবে একইসাথে ছেলে শিশুদের বিশেষ কিছু প্রয়োজনে সহায়তার দিকটি অগ্রাহ্য করার উপায় নেই।”
এসডব্লিউ/এসএস/১৩৩০
আপনার মতামত জানানঃ