সরকারি হিসাবে গত মার্চ মাসে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৬ দশমিক ২২ শতাংশ। আর ওই মাসে মজুরি বেড়েছে ৬ দশমিক ১৫ শতাংশ। এর অর্থ হচ্ছে, গত বছরের মার্চে যে পণ্য বা সেবা ১০০ টাকায় পাওয়া যেত, সেই পণ্য বা সেবা পেতে এখন ১০৬ টাকা ২২ পয়সা খরচ করতে হচ্ছে। আর যে দিনমজুর-শ্রমিক বা অন্য পেশার মানুষ গত বছরের মার্চে তার মজুরির বিনিময়ে ১০০ টাকা পেয়েছেন, গত মার্চে তারা পেয়েছেন ১০৬ টাকা ১৫ পয়সা।
এই হিসাব বলছে, দেশের দিনমজুর-শ্রমিকরা যে মজুরি পাচ্ছেন, তা দিয়ে খাবারসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে পারছেন না। পরপর দুই মাস মানুষের আয় বৃদ্ধির চেয়ে মূল্যস্ফীতি বেশি দেশে।
ফলে দেশের মানুষের গড় মজুরি যে হারে বাড়ছে, তার চেয়ে বেশি হারে জিনিসের দাম বাড়ছে। তাই বাড়তি আয় দিয়ে আগের মতো জিনিসপত্র কেনা সম্ভব হচ্ছে না সাধারণ মানুষের। মূল্যস্ফীতির হার জাতীয় পর্যায়ে মজুরি বৃদ্ধিকে ছাড়িয়ে গেছে।
দুই বছরের মধ্যে তৃতীয়বার তৈরি হলো এ পরিস্থিতি। দেশের মানুষ যে মজুরি পাচ্ছেন, তা দিয়ে খাবারসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে পারছেন না। এ হিসেবে বলা যায়, এ সময়ে দেশে দিনমজুর-শ্রমিকের আয় কমেছে।
আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি
করোনা মহামারির ধাক্কা সামলে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙা হয়েছে। ঈদকে সামনে রেখে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের বিপণীবিতানে কেনাকাটায় ভিড় দেখলেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। এই প্রক্রিয়ায় মজুরিও বাড়ছে।
কিন্তু সেই বাড়তি মজুরির টাকা খেয়ে ফেলছে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি। এখন মূল্যস্ফীতির হার জাতীয় পর্যায়ে মজুরি বৃদ্ধিকেও ছাড়িয়ে গেছে।
সাধারণত মজুরি বৃদ্ধির হার মূল্যস্ফীতির কিছুটা বেশি থাকে। অর্থনীতির সেই চিরায়ত প্রবণতায় উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে। মজুরি বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম হলে মানুষের দুর্ভোগ চরমে ওঠে। এখন বাংলাদেশে তাই হয়েছে। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যও তাই বলছে।
অর্থাৎ এখন দেশের মানুষ যা উপার্জন করছেন বা যা মজুরি পাচ্ছেন, তা দিয়ে তাদের সংসার চলছে না। হয় ধার-দেনা করে চলতে হচ্ছে, না হয় অতি প্রয়োজনীয় পণ্য কম কিনছেন বা কম খাচ্ছেন, সঞ্চয় করা বা জীবনযাত্রার বাড়তি চাহিদা মেটানো তো দূরে থাক।
করোনা মহামারির মধ্যে ২০২০ সালের জুন মাসে মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধির হার কম ছিল। ওই মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ, আর মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৫ দশমিক ৯০। গত এক দশকের মধ্যে সেটিই ছিল ব্যতিক্রম ঘটনা। আবার সেই ব্যতিক্রম আবার ঘটেছে গত ফেব্রুয়ারি ও মার্চে।
বিবিএস গত মঙ্গলবার মূল্যস্ফীতি ও মজুরি সূচকের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, মার্চ মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক ২২ শতাংশ। আর মজুরি বৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ১৫। ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক ১৭ শতাংশ। আর মজুরি বৃদ্ধির হার ৬ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ।
মুদ্রাস্ফীতির পরিসংখ্যান
সাধারণত মূল্যস্ফীতি ও মজুরি হার বৃদ্ধির মধ্যে পার্থক্য ১ শতাংশের মতো হয়। সরকারি হিসাবেই কয়েক মাস ধরে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। এখন তা ৬ শতাংশ ছাড়িয়ে ৬ দশমিক ২২ শতাংশে উঠেছে। যা গত ১৭ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। কিন্তু মজুরি সেই হারে বাড়ছে না।
নভেম্বর, ডিসেম্বরে ও জানুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি ও মজুরি সূচক প্রায় সমান্তরালে চলেছে। ফেব্রুয়ারিতে এসে মজুরি বৃদ্ধিকে ছাড়িয়ে যায় মূল্যস্ফীতি।
গত নভেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৯৮ শতাংশ। আর মজুরি বৃদ্ধির হার ৬ দশমিক শূন্য ২। ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। আর মজুরি বৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ১১ শতাংশ। জানুয়ারিতে মজুরি হার ছিল ৫ দশমিক ৯২ শতাংশ। আর মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৫ দশমিক ৮৬ শতাংশ।
গত ২০২০-২১ অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতির (১২ মাসের গড় হিসাবে) হার ছিল ৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ। মজুরি বৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ১২ শতাংশ। তার আগের অর্থবছরে (২০১৯-২০) মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ৩৫ শতাংশ; মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৫ দশমিক ৬৫ শতাংশ।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫ দশমিক ৪৮ শতাংশ। আর মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ৪০ শতাংশ।
কী বলছেন অর্থনীতিবিদরা?
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সরকারি এই তথ্যই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, দেশের মানুষ কষ্টে আছেন। দুর্বিসহ জীবনযাপন করছেন তারা। তবে বিবিএসের মূল্যস্ফীতির তথ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তারা। অর্থনীতির বিশ্লেষকরা বলছেন, পরিসংখ্যান ব্যুরোর মূল্যস্ফীতির তথ্যের সঙ্গে বাজারের জিনিপত্রের দামের বাস্তব প্রতিফলন নেই। প্রকৃতপক্ষে এই হার অনেক বেশি।
অর্থনীতির গবেষক বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের পরিসংখ্যান ব্যুরোর মূল্যস্ফীতির তথ্য নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন আছে। বিবিএসের সঙ্গে সঙ্গে বাজারের পণ্যমূল্যের বাস্তব প্রতিফলন পাওয়া যায় না।
‘তারপরও বিবিএসের তথ্য মেনে নিয়েই যদি আমরা বিশ্লেষণ করি, তাহলেও কিন্তু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে দেশের মানুষ যা উপার্জন করছেন, তা দিয়ে তাদের সংসার চলছে না। মজুরি বৃদ্ধির চেয়ে মূল্যস্ফীতি বেশি হওয়া সাধারণত অর্থনীতিতে দেখা যায় না। এখন সেটা হচ্ছে। এতেই প্রমাণ হয়, দেশের মানুষ কষ্টে আছেন। দুর্বিসহ জীবনযাপন করছেন।’
তিনি বলেন, ‘৫০ টাকার কমে কোনো চাল পাওয়া যায় না বাজারে। ভোজ্যতেল, চিনি, ডালসহ সব জিনিসের দামই চড়া। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার প্রভাব পড়েছে পণ্যমূল্যে। বেড়েছে মানুষের পরিবহন খরচ। রজমান মাসকে সামনে রেখে আরেক দফা বেড়েছে পণ্যমূল্য।
এসডব্লিউ/এসএস/১২৪০
আপনার মতামত জানানঃ