বয়স ৭০ বছরের উপরে। বৃদ্ধ এই মানুষটাই নাস্তানাবুদ করে দিয়েছিল বিশাল বাহিনীকে। তা আবার যে সে বাহিনী নয়। সেকালের দুনিয়ার সবচেয়ে দুর্ধর্ষ রোমের সৈন্য তারা। আরো আশ্চর্য এই মানুষটি কিন্তু সেনাপতি নয়। এমনকি সে কোনোদিন যুদ্ধবিদ্যা শিখেনি। তবু তিন বছর ধরে লড়াই করে ঠিকই রুখে দিয়েছেন প্রবল পরাক্রমশালী রোমান বাহিনীকে। বুদ্ধির জোরে রক্ষা করছে তার দেশকে। এই লোকটির নাম আর্কিমিডিস। পুরনো দিনের দুনিয়ার সবচেয়ে নামজাদা এবং সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী।
ভূমধ্যসাগরের বুকে একটি দ্বীপ। নাম তার সিসিলি। সেকালে এই দ্বীপের সবচেয়ে নামকরা শহর ছিল সিরাকিউজ। জায়গাটি ছিল গ্রিকদের বসতি। এখানেই ২৮৭ খ্রিস্টপূর্বে আর্কিমিডিসের জন্ম হয়। তিনি ছোটবেলাই লেখাপড়া করেছিলেন মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া শহরে। আর বেঁচে ছিলেন প্রায় ৭৫ বছর। এবং মৃত্যুবরণ করেন ২১২ খ্রিস্টপূর্বে।
এই কয় বছরের মধ্যে গণিত আর বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কতগুলো বড় বড় আবিষ্কার করে গিয়েছেন তিনি। আর্কিমিডিস বিখ্যাত হয়ে আছেন বস্তুর ঘনত্ব আর তরল পদার্থের কোনো জিনিস ভেসে থাকার নিয়মকানুন আবিষ্কারের জন্য। এই আবিষ্কারটিকে আজও বলা হয় ‘আর্কিমিডিসের সূত্র’। আর স্কুলের বিজ্ঞানের প্রায় সব বইতেই এর কথা লেখা থাকে। এত বড় একটা আবিষ্কার, কিন্তু ঘটেছিল নিতান্তই আচমকা।
সিরাকিউজের রাজা হিয়েরো যেমন ছিলেন সাহসী যোদ্ধা, তেমনি ছিলেন ধর্মভীরু। একেকটি যুদ্ধে তিনি জয়লাভ করতেন আর একেকটি জিনিস উৎসর্গ করতেন কোনো দেবতার উদ্দেশ্যে। একবার যুদ্ধজয়ের পড়ে হিয়েরো স্থির করলেন দেবতার মন্দিরে উপহার দিবেন একটি মূল্যবান সোনার মুকুট। স্বর্ণকারকে ডেকে হুকুম করা হলো খাঁটিসোনার একটি খুব সুন্দর একটি মুকুট বানাতে। রাজকোষ থেকে স্বর্ণকারকে খাঁটি সোনা মেপে দেয়া হলো।
অপূর্ব সূক্ষ্ম কারুকাজ করা মুকুট তৈরি করা হয়েছে। দেখে রাজা বেজায় খুশি। মুকুটটি তার খুব পছন্দ হয়েছে। কিন্তু তবু মনে কেমন যেন খটকা রইলো যে, এটা সত্যি সত্যি খাঁটি সোনা দিয়ে তৈরি হয়েছে তো। যদি রূপা বা অন্য কোনো সস্তা ধাতুর খাদ মেশানো হয় ,তাহলে তো দেবতাদের উদ্দেশ্যে তা উৎসর্গ করা চলবে না। হিয়েরো মুকুটটা সত্যি খাঁটি সোনার তৈরি কিনা সেটা যাচাই করে দেখতে চাইলেন।
যাচাই করতে হলে তো মুকুটটা গলাতে হয়। অথচ এমন সুন্দর মুকুটটাকে গলিয়ে দেখতে কারো মন উঠে না। কিন্তু না গলিয়ে এর ভিতরের রূপার খাদ মেশানো হয়েছে কিনা সেটা পরীক্ষাই বা কীভাবে করে? ডাক পড়লো তাই রাজপণ্ডিত আর্কিমিডিসের। আর্কিমিডিস ভেবে কোনো কূল কিনারা পান না। ভাবতে ভাবতে তার চোখে ঘুম নেই। নাওয়া খাওয়ার হিসেব নেই।
একদিন তিনি গোসল করার জন্য ভরা চৌবাচ্চায় পা ডুবিয়েছেন। চৌবাচ্চায় পা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে খানিকটা পানি উপচে পড়লো। হঠাৎ আর্কিমিডিসের মাথায় যেন বিদ্যুৎ খেলে গেলো। সমস্যার সমাধান তিনি পেয়ে গেছেন। পোশাক পড়ার কথা ভুলে অর্থাৎ নগ্ন হয়ে আর্কিমিডিস পথ দিয়ে ছুটলেন রাজাকে খবরটা দিতে। গ্রিক ভাষায় যে কথাটা বলতে বলতে তিনি ছুটছিলেন তা আজও সারা দুনিয়ার লোকের মুখে মুখে।
‘ইউরেকা, ইউরেকা।’ ‘আমি পেয়েছি, আমি পেয়েছি।’ এই কাহিনীটি যদি সত্য হয় তাহলে বলতে হবে আর্কিমিডিসই ইতিহাসের প্রথম আপনভোলা বিজ্ঞানী। সমাধানটা আসলে আশ্চর্য রকম সহজ। অথচ এমন একটি সমাধানের কথা এর আগে কেউ কখনো ভাবেনি। আর্কিমিডিস জানতেন সমান আকারে সোনার চেয়ে রূপা প্রায় ২ গুণ ভারী। অর্থাৎ একই ওজনের সোনার চেয়ে রূপার আয়তন হবে দুইগুণ বেশি।
তবে জটিল আকারের কোনো জিনিসের আয়তন বের করার নিয়ম তখনো কারো জানা ছিল না। আর্কিমিডিস দেখলেন ভরা চৌবাচ্চায় পা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে খানিকটা পানি উপচে পড়ছে। পানিতে ডোবানো পায়ের আয়তন এবং উপচে পড়া পানির আয়তন নিশ্চয়ই হুবহু এক। এমনি করে তিনি আবিষ্কার করে ফেললেন যেকোনো আকারের জিনিসের আয়তন বের করার নিয়ম।
আর্কিমিডিস মুকুটটাকে পানিতে ডুবিয়ে দেখলেন কতটা পানি উপচে পড়ে। তারপর পানিতে ডুবালেন সমান ওজনের খাঁটি সোনা। দেখা গেলো, খাঁটি সোনা ডুবালে যতটা পানি উপচে পড়ছে মুকুটটা ডুবালে উপচে পড়ছে তার চেয়ে বেশি পানি। এতে প্রমাণ হলো মুকুটের আয়তন সমান ওজনের খাঁটি সোনার থেকে বেশি। অর্থাৎ এতে সোনার সঙ্গে হালকা কোনো ধাতুর খাদ মেশানো হয়েছে।
দুষ্টু স্বর্ণকার যখন শুনলো আর্কিমিডিস কোনো কৌশলে তার ফাঁকি ধরতে পেরেছেন, তখন সে নিশ্চয়ই তার দোষ স্বীকার করলো। রাজা হিয়েরো তাকে শাস্তি দিয়েছিলেন নিশ্চয়ই। এমনই ছিলেন আর্কিমিডিস।
আফ্রিকার উত্তরে এই সময়ে আর একটি শহর ছিল। তার নাম কার্থেজ। কার্থেজের রাজার সঙ্গে রোমের সম্রাটের চলছিলো বিবাদ। কার্থেজের সঙ্গে সিরাকিউজের আবার খুব ভাব ছিল। হিয়েরোকে জব্দ করার জন্য সেসময়কার রোমের সবচেয়ে সেরা ও শক্তিশালী সেনাপতি মারসেলাস সিরাকিউজের বিরুদ্ধে অভিযানে বেরোলেন।
ছোট শহর সিরাকিউজ। কতই বা তার সৈন্যসামন্ত। তার বিরুদ্ধে লড়তে আসছে বিরাট রোমান বাহিনী। কিন্তু রোমান বাহিনী থমকে গেলো সিরাকিউজের রক্ষা গোত্রের কাছে এসে। নগরের রক্ষা ব্যবস্থা ভার করেছিল বিজ্ঞানী আর্কিমিডিসের উপর। আর আর্কিমিডিস নগর রক্ষার এমন সব আশ্চর্য ব্যবস্থা করেছিলেন, যার কথা রোমান বাহিনী কল্পনাও করেনি।
শক্তিশালী লিভার আর স্প্রিংয়ের সাহায্যে সিরাকিউজের সৈন্যরা রোমান বাহিনীর উপর বিরাট বিরাট পাথর ছুঁড়ে মারতে লাগলো। আর এসব যন্ত্র থেকে এমন প্রচণ্ড শব্দ হতে লাগলো যে তাতেই ভয় পেয়ে গেলো রোমের সৈন্যরা। মারসেলাস সমুদ্র আর স্থল দুই দিক থেকেই সিরাকিউজ অবরোধ করে বসে রইলেন তিন বছর ধরে।
আর্কিমিডিসকে কিছুতেই কাবু করা যাচ্ছে না। তিনি শহরের দেয়ালের উপর বিরাট বিরাট আয়না বসিয়ে রেখেছিলেন। সেগুলো মারসেলাসের সৈন্যভর্তি জাহাজের দিকে ঘুরিয়ে ধরতেই জাহাজের মাস্তুলে আগুন ধরে গেলো। না এও জাদু নয়, বিজ্ঞানের কৌশল। নগরের দেয়ালের উপর দিয়ে হঠাৎ বেরিয়ে এলো লম্বা লম্বা দালাল। তারপর সেগুলোকে কামড়ে ধরলো মারসেলাসের জাহাজ। কপিকল আর লিভারের কৌশলে জাহাজ উঠে গেলো শূন্যে। তারপর পানিতে ধপাস করে পড়ে গেলো।
তিন বছর অবরোধ করে রাখার পর নগরের কিছু লোক বিশ্বাসঘাতকতা করলো। তাদের সহায়তায় মারসেলাসের সৈন্যরা ঢুকে পড়লো সিরাকিউজের ভিতরে। আর্কিমিডিসের খ্যাতি তখন দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়েছিলো। সেনাপতি মারসেলাস তার সৈন্যদের নির্দেশ দিলেন যেন আর্কিমিডিসের ক্ষতি না করে। কিন্তু বিজয়ের গর্বে উন্মাদ সৈন্যরা আর্কিমিডিসের কদর বুঝলো না।
সৈন্যরা যখন আর্কিমিডিসের কাছে এসে হাজির হলো তখন তিনি তন্ময় হয়ে বালিতে জ্যামিতির আঁক কাটছেন। একটি সৈন্য কর্কশ গলায় তাকে বললো আত্মসমর্পণ করো। কিন্তু জ্যামিতির সমস্যা সমাধান নিয়ে তিনি মগ্ন। মারমুখো সৈন্যের হুকুম তার কানে পৌঁছালো না। তিনি অন্যমনস্কভাবে বললেন, ‘এই সময় আমাকে বিরক্ত করো না।’ সৈন্যটি আর্কিমিডিসকে চিনতে পারলো না। ভাবলো লোকটির স্পর্ধা তো কম নয়। আর্কিমিডিস ২১২ খ্রিষ্টপূর্বে তার হাতে নিহত হলেন।
আর্কিমিডিস নিহত হয়েছেন শুনে সেনাপতি মারসেলাস অত্যন্ত অনুতপ্ত হলেন। তার জন্য একটি সমাধিসৌধ তৈরি করলেন। আর তার গায়ে এঁকে দেয়া হলো আর্কিমিডিসের সবচেয়ে প্রিয় জ্যামিতিক আঁকটি। আর্কিমিডিস প্রাণ দিয়েছেন আজ থেকে সোয়া দুই হাজার বছর আগে। তবে তার শিক্ষা রইলো আগামী দিনের সব মানুষের জন্য।
এসডব্লিউ/এসএস/১৯৫৫
আপনার মতামত জানানঃ