দাবানল, দাবদাহ, খরা, বন্যা, মাত্রাতিরিক্ত বৃষ্টিপাত ও ঘূর্ণিঝড়ে বিশ্ব এখন বিপর্যস্ত। অঞ্চলভেদে বিভিন্ন দেশে এসব দুর্যোগ দেখা যাচ্ছে। চীন, ভারত ও জার্মানিতে চলতি মৌসুমে কয়েক দফা বন্যা, ঘূর্ণিঝড় হয়েছে। কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র স্মরণকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার মুখে পড়েছে। গ্রিস, তুরস্ক, ইতালিসহ দক্ষিণ ইউরোপ পুড়ছে দাবানলে। বেলজিয়ামসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশ রেকর্ড বৃষ্টিপাত দেখেছে। ব্রাজিল, মাদাগাস্কারসহ গোটা আফ্রিকা খরায় বিপর্যস্ত। যখন জলবায়ুর এমন চরম বৈরিতার মুখে বিশ্ব, এমন সময় এসব দুর্যোগের কারণ ব্যাখ্যা করেছেন বিজ্ঞানীরা।
প্রায় ৩০০ বছর আগে শিল্পভিত্তিক সভ্যতায় প্রবেশ করেছে মানবজাতি। দিন যত যাচ্ছে, পুরো উৎপাদনের পুরো প্রক্রিয়া ও মানুষের জীবনযাত্রা হয়ে উঠছে কলকারখানা ও শিল্প-প্রযুক্তি নির্ভর। কিন্তু এই সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখতে শিল্প-কলকারখানা ও যানবাহনে প্রতিনিয়ত বিপুল পরিমাণ জীবাশ্ম জ্বালানী পোড়ানোর ফলে বড় বিপর্যয় অপেক্ষা করছে মানবজাতির সামনে, যার উপসর্গ বা লক্ষণ ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে।
এদিকে ফিলিপাইন গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঝড়ের কবলে পড়েছে। গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঝড় মেগির প্রভাবে ভূমিধস ও বন্যায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে ১৬৭ জনে দাঁড়িয়েছে। একই সঙ্গে দেশটির ১১০ নাগরিক নিখোঁজ রয়েছে।
ফিলিপাইন সরকার শনিবার এ তথ্য জানিয়েছে।
ফিলিপাইনের ন্যাশনাল ডিজাস্টার রিস্ক রিডাকশন অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট কাউন্সিল জানায়, মধ্য ফিলিপাইনে ১৬৪ জন এবং দক্ষিণ ফিলিপাইনে তিনজন মারা গেছে।
এজেন্সিটি আরো জানায়, মধ্য ফিলিপাইনে আরো ১১০ জন নিখোঁজ রয়েছে।
গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঝড় মেগি ১০ এপ্রিল আঘাত হানার আগে ও পরে মধ্য ও দক্ষিণ ফিলিপাইন অঞ্চলে ঝড়টির প্রভাবে বৃষ্টিপাত হলে অনেক এলাকা প্লাবিত হয়। এতে লেইতে প্রদেশের বেবে নগরী ও আবুযোগ শহরে বেশ কয়েকটি গ্রামে ভূমিধস সৃষ্টি করে।
এদিকে, শুক্রবার ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তে বিধ্বস্ত প্রদেশ পরিদর্শন করেন এবং দুর্গত মানুষের কাছে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করেন। তিনি ভূমি ধসে চাপা পড়া গ্রামগুলো পরিদর্শন করেন।
ফিলিপাইন গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঝড়ের কবলে পড়েছে। গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঝড় মেগির প্রভাবে ভূমিধস ও বন্যায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে ১৬৭ জনে দাঁড়িয়েছে। একই সঙ্গে দেশটির ১১০ নাগরিক নিখোঁজ রয়েছে।
স্থানীয় লোকজনের কাছে আগাতন নামে পরিচিত ঘূর্ণিঝড়টি প্রতি ঘণ্টায় ৬৫ কিলোমিটার গতিতে ৮০ কিলোমিটার পর্যন্ত দমকা হাওয়ার সঙ্গে গত রোববার ফিলিপাইনের স্থলভাগে আছড়ে পড়ে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয়দের শেয়ার করা ছবিতে দেখা গেছে, কর্দমাক্ত জলাভূমির মধ্যে দিয়ে হেঁটে অসহায়দের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করছেন উদ্ধারকারীরা। এছাড়া দুর্গম এলাকাগুলোতে বন্যার কারণে ডুবে যাওয়া বাড়ির মানুষদের উদ্ধারে রবারের ডিঙ্গি ব্যবহার করেতে দেখা গেছে তাদের।
সিএনএন বলছে, মেগি চলতি বছর দ্বীপরাষ্ট্র ফিলিপাইনে আঘাত হানা প্রথম ঝড়। ফিলিপাইনে প্রতিবছর অন্তত ২০টি ঝড় আঘাত হানে।
চার মাস আগে ডিসেম্বরে সুপার টাইফুন রাই ফিলিপিন্সের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় দ্বীপগুলোকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছিল। সে সময় ঝড়ের কারণে ৩৭৫ জনের মৃত্যু ও প্রায় ৫ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু সংকটের সরাসরি প্রভাবে মনুষ্য বসতির কাছাকাছি এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের উদ্ভব হচ্ছে। মূলত বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রকৃতির স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।
বিশ্লেষকরা বলছেন, উন্নত দেশগুলো অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে যেভাবে প্রকৃতির সঙ্গে যথেচ্ছাচার করেছে, তাতে প্রকৃতি রুষ্ট হয়ে উঠেছে। কারণ, প্রকৃতি একটি জীবন্ত সত্তা, তাকে শুধু সম্পদ লাভের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। অথচ এ বিষয়টিকে আমলে না নিয়ে উন্নত দেশগুলো নিজেদের তথাকথিত উন্নয়নের স্বার্থে জলবায়ু তহবিল, কার্বন ট্রেড প্রভৃতি তৈরি করে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে টোপ দিয়ে যাচ্ছে।
তারা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যাটি যেমন পরিবেশগত, তেমনি একই সঙ্গে তা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকও বটে। উন্নত দেশগুলোর কারণেই এই জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে, ফলে তাদের কার্বন উদ্গিরণ হ্রাসে বাধ্য করতে হবে। তার জন্য প্রয়োজন সদিচ্ছা, কার্যকর কূটনীতি ও রাজনীতি।
তারা বলেন, জলবায়ু সম্মেলনগুলোর মূল সুরে সমস্যা সমাধানের কোনো ব্যাপার থাকে না। কারণ, এর মধ্য দিয়ে কার্বন নিঃসরণ কমানোর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। কিন্তু এমন একটা ভাব করা হয় যে সমস্যাটি আমলে নেওয়া হয়েছে। কথা হচ্ছে, দুনিয়ার উন্নয়নের মডেল যেন প্রকৃতির ওপর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা না করে প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়, সেটাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
তারা বলেন, প্রাকৃতিক নিয়মে পৃথিবীর বিষুবরেখা সংলগ্ন অঞ্চলে গ্রীষ্মের তীব্রতা থাকায় বৃষ্টির পরিমাণ বেশি হয়ে থাকে। তবে এখন বিশ্ব জলবায়ু উষ্ণায়নের কারণে উত্তর গোলার্ধের দেশগুলিতে হিমবাহ গলে যাচ্ছে, কম তুষারপাত ও গরমকালে অতিরিক্ত গরম ও অতিবৃষ্টির ঘটনা ঘটছে। এখন ভাবার সময় এসেছে, পৃথিবীকে বাঁচাতে বিশ্বের সব প্রান্তের মানুষকে সজাগ হওয়ার। নইলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ তার সীমারেখা মানছে না, সে হোক উত্তর বা দক্ষিণ গোলার্ধ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৪৯
আপনার মতামত জানানঃ