ইউক্রেনে রাশিয়ার সেনাদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ৯৩টি দেশ রাশিয়ার সদস্যপদ বাতিলের পক্ষে ভোটদানের পর মস্কো জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল থেকে নিজেদের সদস্যপদ প্রত্যাহার করেছে।
বৃহস্পতিবার নিউইয়র্কে সাধারণ অধিবেশনে মানবাধিকার কাউন্সিল থেকে রাশিয়াকে অপসারণে যুক্তরাষ্ট্রের উত্থাপিত প্রস্তাবের পক্ষে সমর্থন জানায় ৯৩টি দেশ। অন্যদিকে, রাশিয়ার সদস্যপদ স্থগিত করার বিপক্ষে ২৪টি দেশ ভোট দেয়।
তবে বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার আরও ৬টি দেশসহ ৫৮টি দেশ ভোটদানে বিরত ছিল।
ইউক্রেন যুদ্ধে কে কার পক্ষে
১৯৩ সদস্যরাষ্ট্রের মধ্যে প্রস্তাবে ভোট দেওয়া দেশগুলোর দুই-তৃতীয়াংশের বেশি দেশ রাশিয়ার সদস্যপদ স্থগিত করার পক্ষে ভোট দেয়।
যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রায় সব দেশ রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভোটদান করে। এছাড়া জাপান, অস্ট্রেলিয়া, কানাডাসহ পশ্চিমা মিত্র দেশগুলো রাশিয়াকে বাদ দেওয়ার পক্ষে ভোট দেয়।
অন্যদিকে প্রস্তাবের বিপক্ষে রাশিয়া ছাড়াও চীন, উত্তর কোরিয়া, ভিয়েতনাম, ইরান, সিরিয়া, বেলারুশ ও কিউবাসহ বেশ ২৪টি দেশ ভোট দেয়।
ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা, মেক্সিকো, মিশর, সৌদি আরব, আরব আমিরাত, জর্ডান, কাতার, কুয়েত ইরাক, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালেশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও কম্বোডিয়া ভোটদানে বিরত থাকে।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশসহ ভারত, পাকিস্তান, ভুটান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কা ভোটদানে বিরত ছিল। রাশিয়ার বিপক্ষে ভোটদানে বাইডেন প্রশাসন ভোটের আগে সিনিয়র দূতদের সাহায্যে দেশগুলোকে রাজি করানোর চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত তারা বিরত থাকে। ভোটদানে অনুপস্থিত ছিল আফগানিস্তান।
ভারত বিতর্কে অংশ নিয়ে ‘ইউক্রেনে মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে’ জানিয়ে বিবৃতি দিলেও ভোটদানে বিরত ছিল। অন্যদিকে পাকিস্তান বিতর্কে অংশ নেয়নি।
মধ্যপ্রাচ্যে ইরান প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দেয়। অন্যদিকে সৌদি আরব বিরত ছিল। ওয়াশিংটনের সঙ্গে সৌদির সাম্প্রতিক উত্তেজনার ইঙ্গিতই মিলেছে ভোটেও। মিশর, ইরাক, ওমান, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাতও ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকে।
প্রস্তাব পাসের জন্য ভোটে অংশগ্রহণকারীদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষঠতার প্রয়োজন ছিল। বিরত থাকা দেশগুলোর ভোট গণনা হয় না।
রাশিয়ার বক্তব্য কী
ভোটের পর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রথম স্থায়ী সদস্য হিসেবে রাশিয়া জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের সদস্যপদ হারাতে চলেছিল রাশিয়া। তবে ভোটের পরই রাশিয়া নিজেদের সদস্যপদ প্রত্যাহার ঘোষণা করে। মানবাধিকার কাউন্সিলের তিন বছরের মেয়াদে দেশটি দ্বিতীয় বছরে ছিল।
এদিকে রাশিয়ার ডেপুটি পার্মানেন্ট প্রতিনিধি কুজমিন জানান, রাশিয়া পূর্ণ মেয়াদের আগেই কাউন্সিল ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তিনি দাবি করেন, গুটিকয়েক রাষ্ট্র মানবাধিকার কাউন্সিলকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে।
রয়টার্সের বক্তব্য অনুসারে, পক্ষে ভোট দেওয়া ও ভোটদানে বিরত থাকা দেশগুলোকে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ‘মিত্রভাবাপন্ন নয়’ এমন দেশ হিসেবে চিহ্নিত করবে বলে সতর্ক করেছে রাশিয়া।
এর আগে ট্রাম্প প্রশাসন ২০১৮ সালে মানবাধিকার কাউন্সিলকে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের আশ্রয়স্থল হিসেবে অভিহিত করে। কাউন্সিলের বিরুদ্ধে ইসরায়েলবিরোধী ধারাবাহিক পক্ষপাতের অভিযোগ এনে কাউন্সিল ছাড়ে ট্রাম্পের প্রশাসন। তবে গত বছর যুক্তরাষ্ট্র পুনরায় কাউন্সিলে যোগদান করে।
এছাড়া চীনের বিরুদ্ধে ১০ লাখ উইঘুরকে জোরপূর্বক বন্দি শিবিরে আটকে রাখার অভিযোগ থাকলেও দেশটি এখনও মানবাধিকার কাউন্সিলের সদস্য।
আফ্রিকানদের নীরব সমর্থন
ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ নিয়ে জাতিসংঘে পুতিনকে নিরব সমর্থন দিয়ে চলেছে আফ্রিকার স্বৈরাচারী মিত্ররা।
পশ্চিমাদের কূটনৈতিক তৎপরতায় গত মাসে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে রশিয়া-বিরোধী প্রস্তাবে ১৪১টি দেশ ইউক্রেন “আগ্রাসনের” বিরুদ্ধে নিন্দা জানিয়ে ভোট দেয়।
প্রস্তাবে রাশিয়াকে “আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সীমানার মধ্যে ইউক্রেনের ভূখণ্ড থেকে অবিলম্বে, সম্পূর্ণভাবে ও নিঃশর্তে সমস্ত সামরিক বাহিনী প্রত্যাহার করার” আহ্বান জানানো হয়।
উত্তর কোরিয়া, বেলারুশ, সিরিয়া ও ইরিত্রিয়া কেবল এই চারটি দেশ রাশিয়াকে সমর্থন জানায়। ৩৫টি দেশ ভোট দেওয়া থেকে বিরত ছিল। এর মধ্যে নিশ্চিতভাবেই চীন ও ভারতের নাম আছে। ব্রিকসের (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা) কারণে মস্কোর সঙ্গে দেশ দুটোর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। তবে ভোটদানে বিরত অর্ধেক দেশই ছিল আফ্রিকার।
আফ্রিকা মহাদেশের ৫৪টি দেশ অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় উপনিবেশায়নের ভয়াবহতা ও দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে অবগত। আর তাই আফ্রিকার ভূরাজনীতি সম্পর্কে জানেন না এমন যে কেউ ইউক্রেনে রাশিয়ার সাম্রাজ্যবাদী আচরণ নিয়ে ১৭টি আফ্রিকান দেশ কেন নিন্দা জানাল না, তা দেখে অবাক হতে পারে। এছাড়াও সাতটি আফ্রিকান দেশ ভোটে অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানায়।
আফ্রিকার বেশ কিছু আঞ্চলিক সংস্থা ও দেশ অবশ্য এই আক্রমণের বিরুদ্ধে নিন্দা জানিয়েছে। আফ্রিকান ইউনিয়ন এবং পশ্চিম আফ্রিকার আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সংস্থা ইকোয়াস উভয়ই আঞ্চলিক পর্যায়ে আগ্রাসনের নিন্দা জানায়। আফ্রিকার প্রতিনিধিত্বকারী তিন দেশ কেনিয়া, গ্যাবন ও ঘানাও জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে নিন্দা জানিয়েছে।
এক্ষেত্রে কিছু প্রশ্ন উঠছে। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশ যারা বর্ণবাদের পতনের পর বিশ্বের নিপীড়িতদের পাশে দাঁড়ানো নিয়ে গর্ব করে, তারা কেন বেসামরিক এলাকায় ক্লাস্টার বোমা ব্যবহারের পরেও রাশিয়াকে নিন্দা জানাতে চাইছে না? কয়েক দশক ধরে যুদ্ধবিধ্বস্ত সেন্ট্রাল আফ্রিকা রিপাবলিকই (সিএআর) বা কেন এই সহিংসতার নিন্দা জানানো থেকে বিরত রয়েছে রয়েছে?
এর কোনো একক উত্তর নেই। তবে ভোটদানে বিরত থাকার বিষয়টি থেকেই দেখা যায় যে আফ্রিকার স্বৈরাচারী সরকারগুলোর ওপর মস্কোর কূটনৈতিক প্রভাব এখনও কত প্রবল।
এসডব্লিউ/এসএস/১৮৫০
আপনার মতামত জানানঃ