শ্রীলঙ্কায় খাদ্য ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে জনসাধারণের ক্ষোভর মুখে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর এবং মন্ত্রীপরিষদের সব সদস্য পদত্যাগ করেছেন। মন্ত্রিসভার সদস্যদের পদত্যাগের পর প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের নেতৃত্বাধীন জোট সরকার থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন শরিক বিভিন্ন দলের এমপিরা। মঙ্গলবার (০৫ এপ্রিল) শরিক দলগুলোর ৪০ জনেরও বেশি আইনপ্রণেতা পদত্যাগ করেছেন।
নজিরবিহীন অর্থনৈতিক সংকটের ফলে গত দুসপ্তাহ ধরে শ্রীলঙ্কায় সরকারপতন আন্দোলন চলছে। এই অস্থিরতার মধ্যেই গোপনে দেশ ত্যাগ করেছেন দেশটির সাবেক উপমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট গোতাবায় রাজাপাকসের চাচাতো বোন নিরুপমা রাজাপাকসে।
বুধবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে দুবাইয়ের উদ্দেশে কলম্বো ত্যাগ করেন নিরুপমা। সর্বশেষ তাকে শ্রীলঙ্কার প্রধান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কাটুনায়েকে ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে দেখা গেছে বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে দেশটির জাতীয় দৈনিক সিলন টুডে।
শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে প্রভাবশালী রাজাপাকসে পরিবারের সদস্য নিরুপমা ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত দেশের পনি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী ছিলেন।
বিশ্বের বহু রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের গোপন সম্পদের গোমর ফাঁস করে দেওয়া প্যান্ডোরা পেপারসেও এসেছিল নিরুপমা এবং তার স্বামী থিরুকুমার নাদেসানের নাম।
সেখানে বলা হয়েছিল, একটি শেল কোম্পানির মাধ্যমে তারা গোপনে লন্ডন ও সিডনিতে বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছেন।
দক্ষিণ এশিয়ার দ্রুত অগ্রসরমান দেশ হিসেবে বিবেচিত শ্রীলঙ্কা এখন বিপুল ঋণের বোঝা আর বিদেশি মুদ্রার অভাবে দেউলিয়া হতে বসেছে।
জ্বালানি তেল কিনতে না পারায় দেশটিতে এখন বিদ্যুৎ মিলছে না, গাড়ি চালানো দুষ্কর হয়ে উঠছে, কাগজের অভাবে পরীক্ষা নেওয়া যাচ্ছে না শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, দ্রব্যমূল্য আকাশচুম্বী। এ পরিস্থিতিতে জনবিক্ষোভে সরকারও পতনের দ্বারপ্রান্তে।
বিশ্বের বহু রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের গোপন সম্পদের গোমর ফাঁস করে দেওয়া প্যান্ডোরা পেপারসেও এসেছিল নিরুপমা এবং তার স্বামী থিরুকুমার নাদেসানের নাম।
প্রেসিডেন্ট গোতাবায় রাজাপাকসে এবং তার ভাই প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টায় সর্বদলীয় সরকার গঠনের আহ্বান জানালেও বিরোধী দলগুলো তা মানছে না। মাহিন্দা রাজাপাকসে বাদে তার মন্ত্রিসভার ২৬ সদস্যের সবাই ইতোমধ্যে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন, তাদের মধ্যে রাজাপাকসে পরিবারের অন্তত চার সদস্য রয়েছেন। তাদের দলও পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ার এই দ্বীপরাষ্ট্রজুড়ে প্রতিনিয়ত বাড়ছে ক্ষোভ এবং হতাশা। প্রেসিডেন্টের পদত্যাগের দাবিতে হাজারও শ্রীলঙ্কান প্ল্যাকার্ড হাতে স্লোগান দিয়ে বিক্ষোভ কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন।
বিক্ষুব্ধ জনতা একটি স্লোগানই দিচ্ছেন, ‘চলে যাও গোতা, চলে যাও’।
গোতা হলেন শ্রীলঙ্কার বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ে রাজাপাকসে। বর্তমানে দেশটি যেই চরম অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তার জন্য তিনি অনেকাংশেই দায়ী।
শ্রীলঙ্কায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ায়, সরকার জ্বালানি ও এর মতো প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের আমদানির জন্য অর্থ প্রদান করতে পারেনি। এর পাশাপাশি মহামারিজনিত বিধিনিষেধের কারণে দেশের পর্যটন শিল্পেরও ব্যপক ক্ষতি হয়েছে। তবে অনেকেই এ সবকিছুর সঙ্গে প্রেসিডেন্টের অব্যবস্থাপনাকেই চলমান সংকটের জন্য দায়ী করছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০১৯ সালে প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে নির্বাচিত হওয়ার পর তার প্রবর্তিত নীতিগুলোর কারণেই সংকট আরও বেড়েছে। ট্যাক্স কমানো, আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে সাহায্য নিতে অনিহা ইত্যাদি নীতির সমালোচনা করছেন তারা।
মাহিন্দা রাজাপাকসে এর আগে দুইবার শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। আর গোতাবায়ে রাজাপাকসে তখন ছিলেন দেশের প্রতিরক্ষা সচিব। এ সময় তার বিরুদ্ধে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠে, যার পরিপ্রেক্ষিতে শ্রীলঙ্কায় প্রায় গৃহযুদ্ধ লাগতে বসেছিল।
এছাড়াও, দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে কঠোর পন্থায় ভিন্নমত দমনের অভিযোগও রয়েছে।
শ্রীলঙ্কা তার স্বাধীনতা-উত্তর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে। দেশটির নেতারা এ সংকটকে ২০১৯ সালের এপ্রিলের ইস্টার বোমা হামলা ও ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া কোভিড-১৯ মহামারির ফল বলে দাবি করে দায় এড়াতে চাইলেও বাস্তবতা আদতে তা নয়।
নিশ্চিতভাবেই এ দুটি ধাক্কা দেশের পর্যটনশিল্পে উল্লেখযোগ্যভাবে পর্যটনপ্রবাহকে হ্রাস করেছে এবং অর্থনৈতিক খাতে এটি কিছু নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
কাপড় ইস্ত্রি করার জন্য পুরোনো কাঠকয়লার আয়রন মেশিন আর কেরোসিন দিয়ে জ্বালানো বাতির ব্যবহার বাড়ছে শ্রীলঙ্কায়। অনেকের কাছে এটি সৌখিন বলে মনে হলেও আসলে চরম আর্থিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে শ্রীলঙ্কা।
বিদ্যুৎ বিভ্রাট, গ্যাস ও পানির তীব্র সংকট, খাদ্য সংকট, প্রয়োজনীয় পণ্যের আকাশচুম্বী দামসহ নানা সমস্যার বেড়াজালে আটকা পড়েছে শ্রীলঙ্কার মানুষ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৫০
আপনার মতামত জানানঃ