২০২১ সালে বাংলাদেশ বিশ্ববাজারে ৩ হাজার ৫৮০ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে। একই বছরে পোশাক শিল্পের বিশ্ববাণিজ্যে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনামের রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ১০৮ কোটি ডলার। সে হিসাবে ২০২১ সাল শেষে ভিয়েতনামের চেয়ে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ৪৭২ কোটি ডলার মূল্যের।
এর মাধ্যমে ভিয়েতনামকে টপকে ফের পোশাক রপ্তানিতে দ্বিতীয় অবস্থানের স্বীকৃতি পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। তবে রপ্তানিতে দ্বিতীয় অবস্থানের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেতে আরও প্রায় তিন মাস অপেক্ষা করতে হবে।
বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) এবং ভিয়েতনামের ট্রেড প্রমোশন কাউন্সিলের (ভিয়েট্রেড) পরিসংখ্যানে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
চীনকে কি টপকাতে পারবে?
তৈরি পোশাকের বাণিজ্যে বাংলাদেশের সামনে আছে কেবল চীন। তবে গত বছর করোনা মহামারির মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পোশাক রপ্তানির প্রবৃদ্ধিতে চীনকেও টপকে যায় বাংলাদেশ।
গত বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে প্রায় ২৭ শতাংশ। আর্থিকভাবে এর পরিমাণ ৩১৩ কোটি ডলার।
একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে ভিয়েতনামের পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ২০ দশমিক ৪৫ শতাংশ এবং চীনের বেড়েছে ২৬ দশমিক ৭৭ শতাংশ। অর্থাৎ এ সময়ে পোশাক পণ্য রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি অর্জনে প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দেশ চীন এবং ভিয়েতনামের চেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ।
এছাড়া সামগ্রিকভাবে গত বছর ভিয়েতনামকে টপকে বাংলাদেশ চলে আসে দ্বিতীয় অবস্থানে। ২০২১ সালের শেষে ভিয়েতনামের চেয়ে দেশের রপ্তানি ছিল ৪৭২ কোটি ডলার বেশি।
গত বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে ভিয়েতনামের চেয়ে বাংলাদেশ ১৯৩ কোটি ৬৯ লাখ মার্কিন ডলার মূল্যের পোশাক বেশি রপ্তানি করেছিল। অবশ্য ২০২০ সালে বাংলাদেশের চেয়ে বেশি মূল্যের পোশাক রপ্তানি করে এগিয়ে ছিল ভিয়েতনাম।
দেশের ব্যবসায়ীরা বলছেন, চীন ও ভিয়েতনামের রপ্তানি আদেশগুলো এখন বাংলাদেশে আসছে। ক্রেতাদের ক্রয়াদেশ রক্ষা করতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন কারখানা। কাজ চলছে হরদম। অনেকে চাপ সামলাতে না পেরে সাব-কন্ট্রাক্টে কাজ করাচ্ছেন। আবার দুই শিফটেও ঘুরছে অনেক কারখানার চাকা।
বিজিএমইএ সূত্র বলছে, এ বছরের জানুয়ারিতে ক্রয়াদেশ ছিল ৩৭৫ কোটি ডলারের। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ছিল ২৩০ কোটি। অর্থাৎ এ সময়ে রপ্তানির আদেশ বেড়েছে ৬৩ শতাংশ তথা ১৪৫ কোটি ডলার।
তথ্য বলছে, ফেব্রুয়ারিতেও রপ্তানি আদেশ বেড়েছে ৩২ শতাংশ। রপ্তানির তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, মূলত গত বছরের এপ্রিল থেকেই ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে দেশের পোশাক রপ্তানি খাত। এরপর প্রায় প্রতি মাসেই আগের মাসের চেয়ে রপ্তানি বাড়ছে।
ডিসেম্বরে রেকর্ড পরিমাণ ৪০৪ কোটি ডলার অতিক্রম করে তৈরি পোশাক রপ্তানি। জানুয়ারিতে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪০৯ কোটি ডলারে। ফেব্রুয়ারিতে অর্ডার আসে ৩৫১ কোটি ডলারের। মার্চের প্রথম দুই সপ্তাহে আগের একই সময়ের চেয়ে বেড়েছে ৫২ শতাংশ।
যে কারণে বাড়ছে ক্রয়াদেশ
উদ্যোক্তারা বলছেন, দুই ক্রেতা জোট অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের তত্ত্বাবধানে সংস্কার উদ্যোগের ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের পোশাক খাতে। এই দুই ক্রেতা জোটের সংস্কার কর্মসূচির কারণে বাংলাদেশের পোশাক খাত শিল্প-পরিবেশের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে।
এছাড়া করোনায় সব যখন বন্ধ ছিল, তখনও খোলা ছিল কারখানা। এছাড়া চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য বিরোধ, ভারতে করোনার দীর্ঘ উপস্থিতি ও মিয়ানমারের অস্থিরতার কারণে ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছে দেশের পোশাক খাত।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতাদের কাছ থেকে আগের তুলনায় বেশি ক্রয়াদেশ পাচ্ছেন তারা। বিশেষ করে চীনের সঙ্গে দেশটির বৈরী সম্পর্ক এবং শুল্ক লড়াইয়ের কারণে মার্কিন ক্রেতারা এখন চীন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। সেগুলো চলে আসছে বাংলাদেশে।
অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের সুপারিশ বাস্তবায়ন এবং বাংলাদেশের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং কমপ্লায়েন্ট কর্মপরিবেশের সুবিধাও এতে যোগ হয়েছে।
জানা গেছে, কার্বন নিঃসরণ কমানোর পদক্ষেপ হিসেবে চীন সপ্তাহে তিন দিন উৎপাদন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে চীনের উৎপাদন সক্ষমতা বেশ খানিকটা কমেছে। বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের পর চীন তাদের লাল চিহ্নিত কারখানাগুলোও বন্ধ করে দেয়। এতেও বন্ধ হয় শত শত কারখানা।
তখন থেকে অনেক ক্রেতা চীনের সঙ্গে বাংলাদেশকেও রপ্তানি আদেশ দিতে শুরু করে। কোনও কোনও কারখানা মালিক জানিয়েছেন, তাদের ক্রয়াদেশ দ্বিগুণও ছাড়িয়েছে।
উল্লেখ্য, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) ২০২০ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্ব পোশাক বাজারে চীনের অংশ ৩১ দশমিক ৬ শতাংশ, ভিয়েতনামের ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। আর বাংলাদেশের ৬ দশমিক ৩ শতাংশ।
এদিকে, বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ‘পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে দ্বিতীয়। আমরা এখানেই থেমে থাকবো না। চীনকেও ছাড়িয়ে যেতে চাই।’
তিনি বলেন, এখন নতুন মার্কেটে যাওয়ার চেষ্টা করছি। ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী পোশাকে ভিন্নতা আনার চেষ্টা করছি। কারখানার নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রশিক্ষণ কর্মসূচিও নেওয়া হয়েছে। কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে সরকারের সহায়তা আরও দরকার হবে।
বিশেষ করে কাস্টমস সংক্রান্ত যেসব জটিলতা আছে, সেগুলো দূর করা গেলে আমরা আরও এগোতে পারবো। আগামী তিন বছরে আমরা টেক্সটাইলের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজেও প্রচুর বিনিয়োগ করবো।
এসডব্লিউ/এসএস/১৭০০
আপনার মতামত জানানঃ