ভারতে বন্দিমৃত্যুর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। দেশটির কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিত্যানন্দ রাই নিজেই জানিয়েছেন এই তথ্য। সম্প্রতি পার্লামেন্টে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ তথ্য জানান।
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিত্যানন্দ রাই লিখিত উত্তরে জানিয়েছেন, ২০২১-২২ সালে (ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত) ভারতে ২ হাজার ১৫২ জন আসামি কারাগারে বন্দী অবস্থায় মারা যান। আর পুলিশি হেফাজতে মৃতের সংখ্যা ১৫৫।
ভারতের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের (এনএইচআরসি) তথ্য উদ্ধৃত করে নিত্যানন্দ আরও জানান, দেশের মধ্যে বিচার বিভাগীয় হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা সবচেয়ে বেশি উত্তর প্রদেশে। সেখানে ৪৪৮ জন বন্দী মারা গেছেন। পুলিশি হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনায় এক নম্বরে রয়েছে মহারাষ্ট্র। সেখানে এই সময়কালে মৃতের সংখ্যা ২৯।
এনএইচআরসির তথ্য অনুযায়ী, ভারতে বন্দীমৃত্যুর গ্রাফ ঊর্ধ্বমুখী। ২০২১-২২ সালে এই সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৮৪০। তার আগের বছর ১ হাজার ৫৮৪ জন বন্দীর মৃত্যু হয়েছিল ভারতে।
সাম্প্রতিক কয়েক বছরে ভারতে পুলিশি হেফাজতে অসংখ্য সন্দেহভাজন ব্যক্তি মারা যায়৷ আদালত এইসব মৃত্যুর তদন্তের আদেশ দিলেও, কারাগারে থাকাকালীন মৃত্যুর জন্য কোনো পুলিশ কর্মচারীকেই অভিযুক্ত করা হয়নি৷
পুলিশের হেফাজতে থাকাকালীন পুলিশের অমানুষিক নির্যাতন ও অন্যান্য অত্যাচারে ভারতে গত ২০ বছরে পুলিশ হেফাজতে ১ হাজার ৮৮৮ জন মারা গেছেন। এসব ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন মাত্র ২৬ পুলিশ সদস্য। এ পরিসংখ্যান ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর (এনসিআরবি)।
দেশটিতে পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা অহরহ ঘটলেও বিচার হচ্ছে না দোষীদের। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর (এনসিআরবি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সারা দেশে গত ২০ বছরে হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনায় পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ৮৯৩টি মামলা করা হয়েছে। ওই মামলাগুলোতে ৩৫৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছে। তবে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন মাত্র ২৬ পুলিশ।
এনসিআরবি একটি সমীক্ষায় দেখিয়েছে, ২০০৬ সালে হেফাজতে মৃত্যুর জন্য সর্বোচ্চ ১১ পুলিশকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। এর মধ্যে সাতজন উত্তরপ্রদেশে এবং চারজনকে মধ্যপ্রদেশে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। ২০২০ সালে ৭৬ জন হেফাজতে মারা গিয়েছিল। এর মধ্যে গুজরাটে সবচেয়ে বেশি ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে।
২০২১-২২ সালে (ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত) ভারতে ২ হাজার ১৫২ জন আসামি কারাগারে বন্দী অবস্থায় মারা যান। আর পুলিশি হেফাজতে মৃতের সংখ্যা ১৫৫।
এছাড়া অন্ধ্রপ্রদেশ, আসাম, বিহার, ছত্তিশগড়, হরিয়ানা, কর্ণাটক, কেরালা, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, ওড়িশা, পাঞ্জাব, রাজস্থান, তামিলনাড়ু, তেলেঙ্গানা এবং পশ্চিমবঙ্গ থেকেও এ ধরনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। তবে গত বছর কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়নি।
এনসিআরবি ২০১৭ সাল থেকে হেফাজতে মৃত্যুর মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া পুলিশ কর্মীদের তথ্য প্রকাশ করছে। গত চার বছরে হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনায় ৯৬ পুলিশ কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০০১ সাল থেকে ‘রিমান্ডে নেই’ বিভাগে ১ হাজার ১৮৫ জন এবং ‘রিমান্ডে’ বিভাগে ৭০৩ জনের মৃত্যু হয়েছে।
গত দুই দশকে হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনায় পুলিশ কর্মীদের বিরুদ্ধে নথিভুক্ত ৮৯৩টি মামলার মধ্যে ৫১৮টি রিমান্ডে না থাকা ব্যক্তিদের মৃত্যুর জন্য।
এনসিআরবি ডেটা সম্পর্কে অবসরপ্রাপ্ত আইপিএস এবং আসাম ও উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন ডিজিপি প্রকাশ সিং বলেছেন, ‘পুলিশের কাজকর্মে ভুল ত্রুটিগুলো স্বীকার করা উচিত এবং সংশোধন করা উচিত।’
তিনি বলেন, ‘২০ বছরে পুলিশ হেফাজতে ১ হাজার ৮৮৮টি মৃত্যু ভারতের আকার এবং জনসংখ্যার সঙ্গে তুলনামূলক বিচারে একটি বড় সংখ্যা নয়। তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো পুলিশ সদস্যরা হেফাজতে থাকা ব্যক্তিকে আহত করার জন্য থার্ড-ডিগ্রি পদ্ধতি ব্যবহার করে। এটি একটি ভুল অভ্যাস। পুলিশ সদস্যদের সংবেদনশীল এবং শিক্ষিত হওয়া দরকার, তাদের তদন্তের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি এবং সঠিক জিজ্ঞাসাবাদের কৌশলগুলোর ওপর নির্ভর করা উচিত।’
প্রকাশ সিং বলেন, ‘পুলিশ এসব মামলা ঠিকভাবে তদন্ত করে না। তারা তাদের সহকর্মীদের রক্ষার চেষ্টা করে, যা অবশ্যই ভুল। যখন একজন ব্যক্তি হেফাজতে মারা যায়, তখন দায়ী ব্যক্তিকে জবাবদিহি করতে হবে এবং পুলিশকে নিশ্চিত করতে হবে যে তাকে যথাযথ শাস্তি দেয়া হবে।’
ভারতে পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু নিয়ে কয়েক বছর আগে প্রকাশিত হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডাব্লিউ) নামে এক মানবাধিকার সংস্থার রিপোর্টে বলা হয়েছে, এইসব হেফাজতকালীন মৃত্যুর জন্য আদালত তদন্তের আদেশ দিলেও এ পর্যন্ত কোনো পুলিশ কর্মচারিকে না দায়ী করা হয়েছে, না অভিযুক্ত করা হয়েছে৷
রিপোর্টে বলা হয়, পুলিশ এইসব হেফাজতকালীন মৃত্যুর ঘটনাকে হয় আত্মহত্যা, না হয় প্রাকৃতিক কারণ কিংবা শারীরীক অসুস্থতা বলে দাবি করে৷ পুলিশের বিরুদ্ধে মৃত ব্যক্তিদের আত্মীয়স্বজনদের আনা নির্যাতনের অভিযোগকে নস্যাত করে দেওয়া হয়৷
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ মনে করে, পুলিশ বাহিনীতে দায়বদ্ধতা এবং মানবাধিকার সচেতনতার অভাব দূর করতে প্রয়োজনীয় সংস্কারের দিকে একেবারেই নজর দেওয়া হয়নি৷ দিলে পুলিশি হেফাজতে নির্যাতনের ঘটনায় রাশ টানা সম্ভব হতো৷ পুলিশ বিভাগ যদি নিয়মবিধি মেনে চলে, তাহলে নির্যাতনজনিত মৃত্যুর ঘটনা কমে যাবে৷ তাই হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর ঐ রিপোর্টে বলা হয়, আইনের শাসন তখনই হবে, যখন পুলিশ বিভাগের দায়বদ্ধতা সুনিশ্চিত হবে৷
মানবাধিকারকর্মীরা মনে করেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আদালতের আদেশে তদন্ত শুরু হলেও, দোষী পুলিশ কর্মচারীদের বাঁচাতে বা তাদের আড়াল করারই চেষ্টা করা হয় বেশি৷ আসামিদের গ্রেপ্তার করার এবং হেফাজতে নেবার উপযুক্ত নিয়মবিধি পুলিশ পালন করে না৷ নিয়ম অনুসারে, আসামিকে হেফাজতে নেবার আগে তার ডাক্তারি পরীক্ষা করাতেই হবে এবং গ্রেপ্তারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কথিত আসামিকে ম্যাজিস্ট্রের সামনে হাজির করাতে হবে৷ কিন্তু আসামিকে জেরা করে বিনা নির্যাতনে কিভাবে স্বীকারোক্তি আদায় করতে হয়, সে বিষয়ে ভারতীয় পুলিশ বাহিনীর উপযুক্ত ট্রেনিং বা পরিকাঠামো নেই৷ ফলে সহজ পন্থা হিসেবে অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে যেমন প্রচণ্ড মারধর করে বা কখনও হাত-পা বেঁধে কড়িকাঠে ঝুলিয়ে তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ এবং স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়৷
তারা বলেন, আইন বলবত করার প্রাথমিক দায়িত্ব পুলিশের৷ সেই পুলিশই যদি সেটা পালন না করে, তাহলে পুলিশ থাকা কেন?
দোষীদের শাস্তি দাবি করে তারা বলেন, নির্যাতনের অভিযোগে শাস্তির মুখোমুখি করা হলেই পুলিশ শিখবে স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিকে নির্যাতন করা গ্রহণযোগ্য নয়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮২৯
আপনার মতামত জানানঃ