খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে ঢালাও সুবিধা দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মহামারি করোনার কারণে গত দুই বছরে ঋণ পরিশোধে ছিল বিশেষ ছাড়। তারপরও খেলাপি ঋণ কমছে না। এ কারণে কাগজে-কলমে খেলাপি আড়াল করতে ব্যাংকগুলো ‘ঋণ অবলোপন’ বা ‘রাইট অফ’ কৌশল বেছে নিয়েছে। একই সঙ্গে গণহারে খেলাপি ঋণের সুদও মওকুফ করছে ব্যাংকগুলো।
প্রসঙ্গত, ২০০২ সালে চালু হয় ‘লোন রাইট অফ’ বা ঋণ অবলোপন পদ্ধতি। শুরুতে যেসব খেলাপি ঋণ পাঁচ বছরেও আদায় করা যায়নি, সেগুলোকে শর্ত সাপেক্ষে অবলোপন করা যেতো। মূল খাতা থেকে বাদ দিয়ে অন্য একটি খাতায় হিসাব রাখার নামই ঋণ অবলোপন। এর আগে সুদাসলে ঋণ আদায়ের জন্য অর্থঋণ আদালতে একটি মামলা দায়ের এবং শতভাগ নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। প্রভিশনের টাকায় অন্য কাউকে ঋণ দেওয়া যায় না।
শুধু ব্যাংক নয়, খেলাপি ঋণ কম দেখাতে কৌশলী অবস্থান নিয়েছে ২২টি নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানও। এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যালেন্সশিট (হিসাবের খাতা) কাগজে-কলমে স্বচ্ছ দেখালেও ভেতরের চিত্র উল্টো।
কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলো যে ভালো অবস্থানে নেই, তা দেখে বোঝা যাবে না। অথচ কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান ঋণ অবলোপন করেছে প্রায় ২০০ থেকে ৩০০ কোটি টাকা। আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে এ পর্যন্ত অবলোপনের অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানগুলোর বার্ষিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য।
বর্তমানে দেশে ৩৪টি নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান আছে। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত এসব প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৩৫৩ কোটি টাকা। এর সঙ্গে উল্লিখিত অবলোপন যোগ করলে নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে প্রকৃত খেলাপি ঋণ ১২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন-অনিয়ম, দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনায় ভেঙে পড়েছে নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) খাতের শৃঙ্খলা। ব্যাপক লুটপাটের কারণে ৬টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যেই প্রায় দেউলিয়া হয়ে গেছে। আমানতকারীর টাকা ফেরত দিতে পারছে না এসব প্রতিষ্ঠান। ব্যাংক যেমন বড় বাজার ধরে রেখেছে, নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান তেমন নয়; এসব প্রতিষ্ঠানের বাজার খুবই ছোট। সেই ছোট বাজারে যদি কোনো প্রতিষ্ঠানের শত শত কোটি টাকা অবলোপন করা হয়। তবে সেটা নিঃসন্দেহে অশনি সংকেত।
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২১ সালে অবলোপনের মাধ্যমে ব্যাংকের ব্যালেন্স শিট থেকে দুই হাজার ৪৪১ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ বাদ দেওয়া হয়েছে। এর আগের বছরের তুলনায় যা আড়াই গুণ বেশি। ২০২০ সালে অবলোপন করা হয় ৯৭১ কোটি টাকা।
২০১৯ সালে কাগজে–কলমে খেলাপি ঋণ বাদ দিতে অবলোপন করা হয়েছিল দুই হাজার ৫৯৭ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে এর পরিমাণ ছিল তিন হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। সবমিলিয়ে গত চার বছরে ব্যাংকগুলো অবলোপনের মাধ্যমে নয় হাজার ৩৭৭ কোটি টাকার মন্দ ঋণ ব্যালেন্স শিট থেকে বাদ দিয়েছে।
ঋণ আদায় না করে যদি ‘রাইট অফ’ কৌশল বেছে নেওয়া হয় তাহলে একসময় ব্যাংকের মূলধনও শেষ হয়ে যায়। তাই এটাকে ভালোভাবে নেওয়া যাচ্ছে না।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঋণ আদায় না করে যদি ‘রাইট অফ’ কৌশল বেছে নেওয়া হয় তাহলে একসময় ব্যাংকের মূলধনও শেষ হয়ে যায়। তাই এটাকে ভালোভাবে নেওয়া যাচ্ছে না।
তিনি বলেন, যদি এমন হতো ব্যাংকগুলো ‘রাইট অফ’ করে জোর দিয়ে ঋণ আদায় করছে, তাহলে এ উদ্যোগ আমরা ইতিবাচক হিসেবে দেখতাম। কিন্তু তারা শুধু ব্যালেন্স শিট ঠিক রাখতেই ‘রাইট অফ’ করছে। ফলে বাইরে থেকে লোকজন মনে করছে তাদের আর্থিক অবস্থা ভালো। আসলে কিন্তু তা নয়।
‘খেলাপি ঋণ কমাতে অবশ্যই ঋণ আদায়ে জোর দিতে হবে’— এমন পরামর্শ দিয়ে সাবেক এ গভর্নর আরও বলেন, ব্যাংকগুলোকে ঋণ আদায়ের টার্গেট দিতে হবে। টার্গেট পূরণ করতে না পারলে ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা কমিয়ে দিতে হবে। তাদের বলতে হবে, যতটুকু ঋণ আদায় করতে পারবে ততটুকু ঋণ দিতে পারবে। তা না হলে খেলাপি ঋণ কমানো সম্ভব নয়।
ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় মন্দ বা ক্ষতিকর মানের খেলাপি ঋণের বিপরীতে শত ভাগ প্রভিশন রেখে স্থিতিপত্র (ব্যালেন্স শিট) থেকে বাদ দেওয়াই হলো ঋণ অবলোপন। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, ২০০৩ সাল থেকে ব্যাংকগুলো ঋণ অবলোপন করে আসছে।
ঋণখেলাপির সংখ্যা মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ায় ওই সময় ব্যাংকের স্থিতিপত্র ঠিক রাখতে অবলোপনের নীতিমালা জারি হয়। এরপর ২০১৯ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি অবলোপন সংক্রান্ত নতুন নীতিমালা জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সেই নীতিমালা অনুযায়ী, এখন থেকে তিন বছর হলেই মন্দ মানের (কু-ঋণ) খেলাপি ঋণ অবলোপন করতে পারবে ব্যাংকগুলো। আগে পাঁচ বছর না হলে খেলাপি ঋণ অবলোপন করা যেত না। এছাড়া আগে মাত্র ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত খেলাপি ঋণ মামলা ছাড়াই অবলোপনের সুযোগ ছিল। এখন তা বাড়িয়ে দুই লাখ টাকা করা হয়েছে। মূলত, কাগজে–কলমে খেলাপি কম দেখাতে এ সুবিধা নিয়ে থাকে ব্যাংকগুলো। তাই অবলোপন করে খেলাপি ঋণ কম দেখানোর প্রক্রিয়া নিয়ে সমালোচনা রয়েছে নানা মহলে।
ব্যাংকাররা বলছেন, ঋণ অবলোপনের নীতিমালা শিথিল করায় খেলাপিরা উৎসাহিত হয়েছেন। এখন তাদের ঋণ পরিশোধ না করার প্রবণতা বেড়ে গেছে। অন্যদিকে, ব্যালেন্স শিট ভালো দেখাতে ব্যাংকগুলো এ সুবিধা নিতে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে। ফলে আড়াল হচ্ছে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র।
তাদের মতে, অবলোপন থেকে ঋণ আদায়ের পরিমাণ খুবই কম। তারপরও অবলোপনে ব্যাংকগুলোকে নীতি-সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখার জন্যও অতিরিক্ত সময় পাচ্ছে ব্যাংকগুলো। গত কয়েক বছর ধরে প্রভিশন সংরক্ষণে অতিরিক্ত সময় নিচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। এছাড়া বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, আইসিবি ইসলামী ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংকসহ এ সুবিধা নিয়েছে বেশ কয়েকটি ব্যাংক।
২০২১ সালের নয় মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) আগের অবলোপন করা ঋণ থেকে আদায় হয়েছে ৪৭২ কোটি টাকা। ২০২০ সালে এর পরিমাণ ছিল ৭৩৬ কোটি টাকা। ২০১৯ সালে দুই হাজার ৫৯৭ কোটি টাকার ঋণ অবলোপন হলেও আদায় হয় মাত্র ৮৩১ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঋণ অবলোপন হলো খেলাপিরই একটি পরিণতি। যতক্ষণ খেলাপি বন্ধ না হবে, ততক্ষণ ঋণ অবলোপন চলতে থাকবে। ব্যাংক কখনও ব্যালেন্স শিট অপরিষ্কার রাখবে না, এটাই স্বাভাবিক। আগে গোড়ায় হাত দিতে হবে। ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি কীভাবে বন্ধ করা যায়, সেদিকে নজর দিতে হবে। ঋণ আদায় বাড়াতে হবে। তা না হলে এসব বন্ধ হবে না।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কার্পেটের নিচে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চিত্রও একই। এখানে কোনো শাস্তি কার্যকর হয় না। পিপলস লিজিং দেউলিয়া হয়ে গেল। যারা দেউলিয়া করল তাদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, ভবিষ্যতেও নেওয়ার কোনো লক্ষণ নেই।
তারা বলেন, ঋণ অবলোপন একটি বৈধ প্রক্রিয়া। আন্তর্জাতিকভাবে এটার চর্চা হয়। কিন্তু একসঙ্গে বিপুল অঙ্কের ঋণ অবলোপন কিছুটা প্রশ্ন তৈরি করে। বিশেষ করে শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করেছে কিনা। নিয়মিত প্রভিশনে টান পড়লে মুনাফা থেকে প্রভিশন রাখতে হয়। এসব নিয়ম মানা হয়েছে কিনা। এছাড়া সহায়ক জামানত না থাকলে সেটা আরেকটা প্রশ্ন।
এদিকে, অবলোপনের সঙ্গে খেলাপি ঋণের সুদ মওকুফের উৎসবে নেমেছে ব্যাংকগুলো। গত চার বছরে প্রায় সাত হাজার কোটি টাকার সুদ মওকুফ করা হয়েছে। এর মধ্যে গত বছর (২০২১ সাল) ঋণের সুদ মওকুফ হয়েছে এক হাজার ৮৫৫ কোটি টাকার। ২০২০ সালে এক হাজার ৫৭৮ কোটি টাকার। ২০১৯ সালে সুদ মওকুফ হয়েছে দুই হাজার ২৯৩ কোটি টাকার এবং ২০১৮ সালে এক হাজার ১৯৮ কোটি টাকার। সবমিলিয়ে গত চার বছরে ছয় হাজার ৯২৪ কোটি টাকার সুদ মওকুফ করেছে ব্যাংকগুলো।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫০০
আপনার মতামত জানানঃ