২০১৭ সাল থেকে এপর্যন্ত রাখাইনে নির্যাতনের শিকার হয়ে কমপক্ষে ১২ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আসেন৷ এতোগুলো বছরে অনেক কাঠখড় পোড়ানোর পর অবশেষে ৭০০ রোহিঙ্গাকে ফেরত নিতে চেয়েছে মিয়ানমার৷
সূত্র মতে, এর আগে দুইবার ফেরত নেয়ার দিনক্ষণ ঠিক হলেও তাদের ফেরত পাঠানো যায়নি৷ তাই প্রশ্ন উঠৈছে এবার সফল হবে কী না৷ মূলত রোহিঙ্গা শরণার্থী সঙ্কট বাংলাদেশের জন্য অব্যাহতভাবে গলার কাঁটা হয়ে উঠেছে।
রোহিঙ্গা নিয়ে চিরস্থায়ী ফাঁদে
পরারাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম সংবাদমাধ্যমকে বলেন, মিয়ানমার প্রথম দফায় ৭০০ রোহিঙ্গাকে ফেরত নিতে চায়৷ কিন্তু আমরা চাই এক হাজার ১০০ রোহিঙ্গাকে প্রথম দফায় ফেরত নেয়া হোক৷ এটা হলে একই পরিবারের সবাই যেতে পারবেন৷ তা না হলে পরিবারের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হবে৷
শাহ রেজওয়ান হায়াত জানান, এ সংক্রান্ত কোনো অফিসিয়াল ডকুমেন্ট আমরা পাইনি৷ আমরা পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য শুনেছি৷ ফলে আমাদের দিক থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু হয়নি৷
মিয়ানমারে সামরিক জান্তা ক্ষমতায় আসার পর প্রথম চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি দুই দেশের টেকনিক্যাল কমিটির মধ্যে ভার্চুয়াল বৈঠক হয়৷ এর আগে আরো দুইবার রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হলেও শেষ পর্যন্ত তা ভেস্তে যায়৷
শাহ রেজওয়ান হায়াত বলেন, আমরা এখন পর্যন্ত ৯ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গার তালিকা পাঠিয়েছি৷ ওরা তাদের পরিচিতি পরীক্ষা করছে, যদি সত্যি বলে থাকে৷ তারা ২৯ হাজারের পরিচিতি এখন পর্যন্ত নিশ্চিতের কথা বললেও আমাদের কাছে কোনো তালিকা পাঠায়নি৷
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, আমরা এক হাজার ১০০ জনকে ফেরত পাঠাতে চাই এটা মন্ত্রী মহোদয় বলেছেন৷ কিন্তু কিসের ভিত্তিতে বললেন তা আমার জানা নেই৷ আর মিয়ানমার যে ৭০০ জনকে ফেরত নিতে চায় তাও অফিসিয়ালি আমরা জানি না৷
তবে মিয়ানমার যদি এখন ৭০০ জনকে ফেরত নিতে চায় সে ব্যাপারে বাংলাদেশকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্লেষকরা৷ তারা মনে করেন এটা মিয়ানমারের একটি ফাঁদ বা নতুন কোনো চাল হতে পারে৷
সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং মিয়ানমারে বাংলাদেশ দূতাবাসের সাবেক সামরিক অ্যাটাশে মেজর জেনারেল (অব.) শহীদুল হক মনে করেন, একটি রোড ম্যাপ ছাড়া ৭০০ জন রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানো ঠিক হবে না৷ আগে মিয়ানমার নিশ্চিত করবে যে সর্বমোট কত জনকে তারা কতদিনে ফেরত নেবে৷ নয়তো তারা এই ৭০০ জনকে ফেরত নিয়ে বলবে আমরা তো ফেরত নিয়েছি৷ আর নেবে না৷
তিনি বলেন, ১৯৯৩ সালে তারা একই কাজ করেছিলো৷ কিছু রোহিঙ্গাকে ফেরত নিয়ে আর নেয়নি৷ ২০১১ সালে রোহিঙ্গাদের একটি তালিকা হস্তান্তর করা হয় মিয়ানমারকে৷ তখন তারা মাত্র ছয় হাজারকে রোহিঙ্গা বলে মেনে নেয়৷ তারা আসলে টোকেন হিসেবে কিছু রোহিঙ্গাকে নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বকে দেখাতে চায় আর কিছু নয়৷
তার মতে, ইউক্রেনে রাশিয়ারা হামলার পর ইউরোপে এখন শরণার্থী সংকট তৈরি হয়েছে৷ ইউরোপের নজর এখন ওদিকে৷ এই সুযোগকে মিয়ানমার কাজে লাগাতে চায়৷
তার কথা রোহিঙ্গা নিয়ে মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের একটি চুক্তি হওয়া প্রয়োজন যেখানে তৃতীয় পক্ষ থাকবে৷
বিশ্লেষকদের মতে
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ মনে করেন, মিয়ানমার যে চীনের কথায় ওঠবস করে তা ঠিক নয়৷ তারা তো ইউক্রেন ইস্যুতে চীনের বিপক্ষে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে গিয়ে ভোট দিয়েছে৷ তারা এখন প্রমাণ করতে চায় যে মিয়ানমারে গণহত্যা হয়নি৷
আন্তর্জাতিক আদালতকেও এটা বোঝাতে চায়৷ তাই তারা কিছুৃ রোহিঙ্গাকে এখন মিয়ানমারে ফেরত নিতে চায়৷ কিন্তু সব রোহিঙ্গাকে কবে ফেরত নেবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই৷
তার মতে, বাংলাদেশকে খুব সতর্কতার সাথে বিষয়টি দেখতে হবে৷ আগে মিয়ানমারের কাছ থেকে নিশ্চয়তা পেতে হবে তারা কত রোহিঙ্গাকে ফেরত নেবে৷ তারপর এটার রোড ম্যাপ করতে হবে৷ তারাতো ঠিক করে বলছেই না যে কত রোহিঙ্গাকে ফেরত নেবে৷ যদি এটা নিশ্চি না হয় তাহলে দেখা যাবে হাজার খানেক নিয়ে আর নেবে না৷ তাদের যা উদ্দেশ্য তা কিন্তু তারা করে নেবে৷
কমে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক সহায়তা
এদিকে তথ্য উপাত্ত বলছে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আগ্রহ দিন দিন কমে আসছে৷
বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সার্বিক বিষয় দেখাশোনা করে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন৷ জাতিসংঘের ইউএনএইচসিআর এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে৷ ২০২১ সালে জয়েন্ট রেসপন্স প্লান-এর যে হিসাব তাতে দেখা যায় ১০ লাখ ৩৬ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীর জন্য মোট ডোনারদের সহায়তা প্রয়োজন ছিলো ৯৪৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার৷ দিয়েছে ৬৭৪ মিলিয়ন ডলার যা প্রয়োজনের তুলনায় ২৮ ভাগ কম৷ ২৬৯ মিলিয়ন ডলার সহায়তা পাওয়া যায়নি৷
এর আগেও কোনো বছরই প্রত্যাশিত সহায়তা পাওয়া যায়নি৷ ২০১৭ সালে প্রয়োজন ছিলো ৪৩৪ মিলিয়ন ডলার, পাওয়া গেছে ৩১৭ মিলিয়ন ডলার৷ ২০১৮ সালে ৯৫১ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে পাওয়া গেছে ৬৫৫ মিলিয়ন ডলার৷ ২০১৯ সালে ৯২০ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে পাওয়া গেছে ৬৯৯ মিলিয়ন ডলার৷ ২০২০ সালে ১০৫৮ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে পাওয়া গেছে ৬২৯ মিলিয়ন ডলার৷
এখানে স্পষ্ট যে ২০২০ সালের পর থেকে প্রতিশ্রুত সহায়তাও কমছে এবং প্রতিশ্রুত সহায়তার গড়ে ৭০ ভাগের বেশি পাওয়া যাচ্ছে না৷ এদিকে, ইউক্রেনে হামলার পর শনিবার পর্যন্ত ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ৩০ লাখের বেশি শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে৷
এই দুই বিশ্লেষক মনে করেন, ইউরোপে শরণার্থী বেড়ে যাওয়ায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রতি তাদের মনোযোগ কমে যাওয়াই স্বাভাবিক৷ আর এই সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করতে পারে মিয়ানমার৷ তাই বাংলাদেশকে কূটনৈতিক যোগাযোগ বাড়াতে হবে৷ রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিভিন্ন ফোরামে আরো শক্ত অবস্থানে গিয়ে কথা বলতে হবে৷
এসডব্লিউ/এসএস/১৪৩০
আপনার মতামত জানানঃ