গত কয়েক বছর ধরে চলে আসা অর্থনৈতিক সংকটের সঙ্গে করোনা অতিমারির প্রভাব যোগ হওয়ায় শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি এখন অনেকটাই বিপর্যস্ত। রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্সে ব্যাপকভাবে কমে আসার পাশাপাশি পর্যটন খাতে ধস নেমেছে। চলতি বছর এরই মধ্যে এক বিলিয়ন ডলারের ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে দেশটিকে। ফলে গত জুন মাস শেষে শ্রীলঙ্কার বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ চার বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে, যা দিয়ে তিন মাসের আমদানি ব্যয়ও মেটানো যাবে না।
শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার নিয়েছে ইতোমধ্যে। তারল্য সংকটের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও। রাজধানী কলম্বোয় পরীক্ষার খাতার কাগজ ফুরিয়ে যাওয়ায় দেশটির পশ্চিম প্রদেশের লক্ষাধিক শিক্ষার্থীর পরীক্ষা বন্ধ হয়ে গেছে। মূলত তারল্য সংকটের কারণেই কাগজের ব্যাপক ঘাটতি দেখা দিয়েছে দেশটিতে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগামী সোমবার শুরু হয়ে স্কুলগুলোতে এক সপ্তাহ সাময়িকী পরীক্ষা চলার কথা ছিল। শ্রীলঙ্কায় প্রায় ৪৫ লাখ স্কুল শিক্ষার্থী রয়েছে। তবে কাগজের অভাবে তাদের তিন ভাগের দুই ভাগই পরীক্ষা দিতে পারবে না।
শ্রীলঙ্কার শিক্ষা কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আগামীকাল সোমবার (২১ মার্চ) থেকে শুরু হতে যাওয়া এক সপ্তাহের নির্ধারিত পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। কাগজের সংকটের কারণে বাধ্য হয়ে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ১৯৪৮ সালে দেশটির স্বাধীনতার পর সবচেয়ে ভয়াবহ আর্থিক সংকটের কবলে পড়েছে শ্রীলঙ্কা।
পশ্চিমাঞ্চলীয় শিক্ষা বিভাগ জানিয়েছে, দেশের স্কুলগুলোর অধ্যক্ষরা কোনও অবস্থাতেই পরীক্ষা নিতে পারবেন না। কারণ কাগজ ছাপানোর জন্য যেই অর্থের প্রয়োজন তা নেই।
নবম, দশম এবং একদাশ শ্রেণীর পরীক্ষাগুলো বছরের শেষ দিকে নেওয়া হয়ে থাকে। শিক্ষার্থীদের পরবর্তী গ্রেডে উন্নীত করা হবে কিনা এর মূল্যায়ন হয়ে থাকে।
দেশের স্কুলগুলোর অধ্যক্ষরা কোনও অবস্থাতেই পরীক্ষা নিতে পারবেন না। কারণ কাগজ ছাপানোর জন্য যেই অর্থের প্রয়োজন তা নেই।
গত সেপ্টেম্বরে অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসে। এর ফলে মৌলিক খাদ্যপণ্য সরবরাহের নিয়ন্ত্রণ ও বাড়তে থাকা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের সুযোগ পায় সরকার। জানুয়ারিতে দেশটির মূল্যস্ফীতি ১৪.২ শতাংশে পৌঁছায়। দক্ষিণ এশীয় দেশটির পর্যটন খাত থেকে আসা ডলারের প্রবাহ কমে গেছে মহামারিতে। কিন্তু অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এর আগে থেকেই শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক ঋণ সর্বোচ্চ ও অস্থিতিশীল পথে ছিল।
অর্থসংকটের জেরে শ্রীলঙ্কায় বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি দেখা দিয়েছে। আমদানি ব্যাহত হওয়ায় কমে এসেছে দেশটির খাদ্যপণ্য, জ্বালানি ও ওষুধের মজুত। পরিস্থিতি সামাল দিতে গত বুধবার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে আর্থিক সহায়তা চেয়েছে কলম্বো। বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে আইএমএফ।
চলতি বছরে শ্রীলঙ্কাকে ৬৯০ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে হবে। তবে গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশটির হাতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল মাত্র ২৩০ কোটি ডলার। সংকট মোকাবিলায় বছরের শুরুতে চীনের কাছে ঋণ পরিশোধের বিষয়ে সহায়তা চায় শ্রীলঙ্কা। তবে এ নিয়ে এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো সাড়া দেয়নি বেইজিং।
করোনাভাইরাস মহামারির আঘাতে কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে শ্রীলঙ্কা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, গত জানুয়ারিতে ৫০ কোটি ডলারের বন্ড পরিশোধের পর তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২৩৬ কোটি ডলার। অথচ এ বছর তাদের ঋণের কিস্তি রয়েছে ৭০০ কোটি ডলারের বেশি, এর মধ্যে জুলাইয়েই আরও ১০০ কোটি ডলারের বন্ড পরিশোধ করতে হবে লঙ্কানদের।
এমন সংকটের মুখে শ্রীলঙ্কায় নিত্যপণ্যের চরম ঘাটতি দেখা দিয়েছে। দুধ, গ্যাস, কেরোসিন কিনতে দোকানগুলোর সামনে মানুষের লম্বা লাইন দেখা গেছে। পণ্যের দামও বাড়ছে অস্বাভাবিক গতিতে।
লঙ্কান কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, দেশটিতে মাত্র এক মাসের ব্যবধানে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে গত ডিসেম্বরে ১২ দশমিক ১ শতাংশে পৌঁছেছে। একই সময়ে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে অন্তত ২২ শতাংশ।
কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রা ঘাটতির কারণে আমদানিকারকরা বিদেশ থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আনতেও পারছেন না। ফলে দেশটি ঘুরেফিরে আবারও সেই ‘বিদেশি ঋণের ফাঁদে’ পড়তে যাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি কঠিন সংকটে ক্রমে তলিয়ে যাচ্ছে। দেশটিতে আমদানি করা পণ্যের ক্রমবর্ধমান ঘাটতি জনজীবনকে পর্যুদস্ত করে দিচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর সংঘবদ্ধ মজুতদারি এতই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহে সৃষ্ট কৃত্রিম সংকট তদারকের জন্য একজন মিলিটারি জেনারেলের নেতৃত্বে ‘কন্ট্রোলার অব সিভিল সাপ্লাইজ’ নামের কঠোর নজরদারি সংস্থা গড়ে তুলেও অবস্থা সামাল দেওয়া যাচ্ছে না।
করোনাভাইরাস মহামারি শ্রীলঙ্কায় খুব বেশি মানুষের মৃত্যু না ঘটালেও সর্বনাশ ডেকে আনল শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের গুরুত্বপূর্ণ খাত পর্যটন খাতকে প্রায় ধসিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে। দুই বছর ধরে সারা বিশ্বের পর্যটন খাতে এমন বিপর্যয় গেড়ে বসেছে, যা থেকে উত্তরণ এখনো সুদূরপরাহত। শ্রীলঙ্কার রপ্তানি আয়ের আরও দুটি প্রধান সূত্র এলাচি ও দারুচিনিও বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মহামারির এই দুই বছরে। এ কারণে শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক আয়ে বড়সড় ধস নামল। এর সঙ্গে যুক্ত হলো ২০০৯ সাল থেকে বৈদেশিক ঋণের অর্থে যেখানে–সেখানে প্রকল্প গ্রহণের বদখাসলতের চরম মূল্য চুকানোর পালা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক দেউলিয়াত্ব থেকে শিক্ষণীয় হলো, রাজাপক্ষে পরিবার ভোটের রাজনীতিকে যেভাবে ‘পারিবারিক একনায়কত্বে’ পর্যবসিত করেছে, সেটা একটা সমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশকেও গভীর সংকটের গিরিখাতে নিক্ষেপ করতে পারে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৪০
আপনার মতামত জানানঃ