সংবিধান, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা ও সংশ্লিষ্ট আইনে শাস্তির বিধান থাকলেও দেশে থেমে নেই হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু। এরই ধারাবাহিকতায় রাজধানীর কোতোয়ালি থানা হেফাজতে এক স্বর্ণ ব্যবসায়ীকে নির্যাতনের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগে কোতয়ালী থানার তিন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে করা মামলা পুলিশ ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন’কে (পিবিআই) তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। একই সাথে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালকে মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মামলার বাদী স্বর্ণ ব্যবসায়ী রাজিব কর রাজুকে সেখানে সাত দিনের মধ্যে স্বাস্থ্য পরীক্ষার আদেশ দেন আদালত।
ঢাকা মহানগর দায়রা জজ কে এম ইমরুল কায়েশের আদালত গত বৃহস্পতিবার এ আদেশ দেন।
সোমবার (১৪ মার্চ) সংশ্লিষ্ট আদালত সূত্র আদেশের বিষয়টি জানায়।
এর আগে, গত ২ মার্চ রাজু আদালতে মামলার আবেদন করেন। আদালত বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ শেষে আদেশ পরে দেবেন বলে জানান।
আসামিরা হলেন— কোতয়ালী থানার এসআই মিজানুর রহমান ও জলিল এবং এ এসআই ফরিদ ভূঁইয়া।
গত ২ মার্চ এই তিন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলার আবেদন করা হয়। রাজিব কর রাজু নামে এক স্বর্ণ ব্যবসায়ী একই আদালতে মামলার আবেদন করেন। আদালত বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে পরবর্তীতে আদেশ দেবেন বলে জানান।
মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, ২০১৯ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি রাত আড়াইটার দিকে কোনো অভিযোগ ছাড়াই এসআই মিজান ও এএসআই ফরিদ ভূঁইয়া সাদা পোশাকে ভিকটিমের ৬৯ নং গোয়ালনগর কোতয়ালীর বাসায় সিলিং ভেঙে প্রবেশ করেন। কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আসামিরা ভিকটিম রাজুকে হাতকড়া পরিয়ে চড়-থাপ্পর মারতে থাকেন।
এ সময় ভিকটিমের বাসা তল্লাশি করে ১১ লাখ ৫৮ হাজার ৩৩৮ টাকার স্বর্ণ এবং তার মায়ের চোখ অপারেশন করার ৪১ হাজার ৩০০ টাকা ছাড়াও বাসা থেকে মোবাইল, ল্যাপটপ কোতয়ালী থানায় নিয়ে যান। সেখানে নিয়ে আসামিরা তার ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালান। নির্যাতনে ভিকটিম অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখান থেকে চিকিৎসা শেষে আসামিরা তাকে আবার থানায় নিয়ে আসেন এবং ৫ লাখ টাকা দিতে বলেন। না হলে অস্ত্র ও মাদক মামলার আসামি বানিয়ে ক্রসফায়ারের হুমকি দেন।
টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে তাকে আবারও নির্যাতন করেন আসামিরা। পরবর্তীতে ভিকটিমের পরিবার দুই দফায় দুই লাখ টাকা দেন আসামিদের। নির্যাতনে অসুস্থ হয়ে ভিকটিম প্রায় এক বছর হাসপাতালে চিকিৎসা নেন।
এ বিষয়ে ভিকটিম কোতয়ালী থানায় মামলা করতে যান। কিন্তু থানা কর্তৃপক্ষ মামলা না নিয়ে তাকে ঘোরাতে থাকেন। আসামিদের বিরুদ্ধে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের কাছে বিচার প্রার্থনা করেন বলে আর্জিতে উল্লেখ করেন ভিকটিম। থানা কর্তৃপক্ষ মামলা না নেওয়ায় আদালতে এ মামলা করলেন রাজু কর রাজু।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাল্লা ক্রমশ বেড়েই চলছে। আর এসবের সবকটাই ক্ষমতার অপব্যবহারকে কেন্দ্র করেই হয়ে থাকে বলে মনে করেন তারা।
তারা বলেন, পুলিশে ঢোকার পর স্বাভাবিক একজনের ভেতরেও আশ্চর্য এক পরিবর্তন আসে। স্থানীয় পর্যায়ে ক্ষমতার চূড়ান্ত ভেবে তারা যা ইচ্ছা তা করার মানসিকতা নিয়ে দাপটের সাথে চলতে থাকেন। ফলে ঘর থেকে বাহির কেউ তাদের কুৎসিত হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। আইনের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধাশীল না হলে পুলিশের বিরুদ্ধে এমন আরও অসংখ্য অভিযোগ আসতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন তারা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমাজে হত্যাকে বৈধতা দেওয়ার ক্ষেত্রে এই ধরনের মানসিকতাই যে সহযোগী, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই কাজে পরোক্ষ ভূমিকা পালনে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনও যে পিছিয়ে নেই, তা এই প্রতিষ্ঠানের নির্লিপ্ততাতেই স্পষ্ট। কমিশন একবার বলেছিল যে বেছে বেছে কয়েকটা ঘটনার তদন্ত করবে, সেই কথা হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। কমিশনের জবাবদিহির অভাব পুলিশ এবং সরকারের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।
আরও বলেন, পুলিশের কর্মকর্তারা একাধিকবার প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি করেছেন, যেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু (নিবারণ) আইন বাতিল করে দেওয়া হয়। এই দাবি একেবারে নাকচ করে দেওয়া হয়েছে এমন নয়। তদুপরি, পুলিশ বাহিনীকে যেভাবে রাজনীতির হাতিয়ারে পরিণত করা হয়েছে, তাতে এই বাহিনীর সদস্যরা যে নিজেদের আইনের ঊর্ধ্বেই ভাববেন, তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই; হেফাজতে মৃত্যু, বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা সেগুলো প্রতিদিন প্রমাণ করে দিচ্ছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০৪৮
আপনার মতামত জানানঃ