এবার চীনে উইঘুরদের অবস্থা পরিদর্শনে যাচ্ছে জাতিসংঘ। সূত্র মতে, ২০০৫ সালের পর এই প্রথমবার জাতিসংঘের একটি মানবাধিকার দল উইগুরদের অবস্থা দেখতে চীনে যাবে।
উইঘুর মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলের আগের নাম পূর্ব তুর্কিস্তান, এটি বর্তমানে জিনজিয়াং প্রদেশে। চীন সরকার এ অঞ্চলকে জিনজিয়াং নাম দিয়েছে। ৯০ লাখ মুসলিম অধ্যুষিত এ অঞ্চলের প্রায় ১০ লাখ উইঘুর নারী-পুরুষ বন্দি রয়েছে সুরক্ষিত বন্দিশিবিরে।
চীন সরকার এ বন্দিশিবিরকে চরিত্র সংশোধনাগার নাম দিয়েছে। চীন সরকারের দাবি, উচ্ছৃঙ্খল অবস্থা থেকে নিরাপদ ও সুরক্ষা দিতেই তাদের এ কার্যক্রম।
চরিত্র সংশোধনাগারের নামে চীন সরকার এই মুসলিমদের ওপর চরম অত্যাচার ও নির্যাতন করছে বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের বিভিন্ন প্রতিবেদনমতে, জিনজিয়াং প্রদেশে বসবাসরত উইঘুর মুসলমানদের ওপর চীন সরকারের বর্বরতা সীমা ছাড়িয়ে গেছে।
চীন যাচ্ছেন জাতিসংঘের কর্মকর্তা
চীনে উইগুর মুসলিমদের অবস্থা দেখতে যাবেন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই-কমিশনার মিশেল বাশেলেট। আগামী মে মাসে চীনের পশ্চিম শিনজিয়াং প্রদেশে যাবেন মিশেল। উদ্দেশ্য সেখানে উইগুরদের অবস্থা দেখা।
প্রসঙ্গত, চীনের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের অভিযোগ, তারা শিনজিয়াং প্রদেশে উইগুরদের সংশোধনাগারে রাখার নাম করে কার্যত বন্দি করে অকথ্য অত্যাচার চালায়।
পশ্চিমা দেশগুলি এবং বেশ কিছু মানবাধিকার সংস্থা দীর্ঘদিন ধরে এই অভিযোগ নিয়ে সোচ্চার। চীন অবশ্য প্রতিবারই এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
এ প্রসঙ্গে জাতিসংঘের মানবাধিকার সংক্রান্ত হাই কমিশনের বৈঠকের পর মিশেল বলেছেন, চীন সরকারের সঙ্গে তাদের সমঝোতা হয়েছে। মে মাসে তিনি চীনে যাবেন। ২০০৫ সালের পর এই প্রথমবার জাতিসংঘের একটি মানবাধিকার দল উইগুরদের অবস্থা দেখতে চীনে যাবে।
মিশেল বলেছেন, এপ্রিলে জাতিসংঘের একটি দল চীনে যাবে। সেটা হবে অ্যাডভান্সড টিম। তারা পরবর্তী সফরের প্রস্তুতি খতিয়ে দেখবে।
জাতিসংঘের মুখপাত্র জানিয়েছেন, চীন সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, জাতিসংঘের প্রতিনিধি দল যাতে অনেকের সঙ্গে কথা বলতে পারে, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে যাতে তারা মতবিনিময় করতে পারে, সবকিছু ঘুরে দেখতে পারে, তার ব্যবস্থা করা হবে।
চীনের বিরুদ্ধে অভিযোগ
মিশেল বলেছেন, তিনি একটি বিষয় নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন। সেটা হলো, অভিযোগ উঠেছে, চীনে কেউ মানবাধিকারের কথা তুললে, ব্যক্তির উপর অবিচারের কথা তুললে, হয় তাকে জেলে পুরে দেয়া হয় অথবা গৃহবন্দি করে রাখা হয়। বেজিংয়ের উচিত মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা করা।
জাতিসংঘে চীনের দূত চেন শু দাবি করেছেন, চীন সবসময়ই মানবাধিকার এবং মতপ্রকাশের অধিকার রক্ষা করে। তবে একটা কথা মনে রাখতে হবে, কেউই আইনের উপরে নয়।
মানবাধিকার সংস্থাগুলি বহুবার অভিযোগ করেছে, শিনজিয়াং প্রদেশে ১০ লাখ উইগুর মুসলিমদের শিবিরে রাখা হয়েছে। তাদের উপর অত্যাচার করা হয়। তাদের নির্বীর্যকরণ হয়। উইগুর মুসলিমদের অনেকে এই অভিযোগ সমর্থন করেছেন। বেজিংয়ের দাবি, যে শিবিরের কথা বলা হচ্ছে, সেগুলি আসলে ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার। সেখানে প্রশিক্ষণ দেয়া ছাড়া আর কিছুই করা হয় না।
চীনে কেমন আছেন উইঘুরেরা
চীনের শিনজিয়াং রাজ্যের বিভিন্ন ক্যাম্পে প্রায় দশ লাখ মুসলমান বন্দি রয়েছেন৷ এসব ক্যাম্প কীভাবে পরিচালিত হবে, সে বিষয়ে ২০১৭ সালে একটি নির্দেশনা দিয়েছিল কর্তৃপক্ষ৷
গত রবিবার ১৭টি গণমাধ্যমে একযোগে সেটি প্রকাশিত হয়েছে৷ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্র ‘ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অফ ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস’ আইসিআইজে-কে এই নির্দেশনাটি দিয়েছে৷
চীন সরকারের দাবি, এসব ক্যাম্পে মুসলমানরা স্বেচ্ছায় প্রশিক্ষণ নিতে যান৷ কিন্তু প্রকাশিত নির্দেশনা বলছে, ক্যাম্পে বন্দিদের প্রথমে আদর্শ ও আচরণগত প্রশিক্ষণ দেয়ার মাধ্যমে তাদের মনোজগতে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করা হয়৷ এরপর অন্য জায়গায় তাদের জন্য কারিগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়৷
সূত্র মতে, বন্দিদের কেউ যেন পালাতে না পারেন সেজন্য ২৪ ঘণ্টাই তাদের নজরে রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে ক্যাম্প কর্মীদের৷ এমনকি টয়লেটে যাওয়ার সময়ও তাদের নজরে রাখতে বলা হয়েছে৷ এছাড়া নিরাপত্তা টাওয়ার নির্মাণ, ডাবল-লক দরজা, অ্যালার্ম ও প্রবেশ দরজাসহ সব জায়গায় ভিডিও নজরদারির ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছে৷
জানা যায়, বন্দিদের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তোলার ব্যাপারে ক্যাম্পের কর্মীদের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে৷ এছাড়া গোপনীয়তা রক্ষার স্বার্থে কর্মীরা মোবাইল ফোন কিংবা ক্যামেরা নিয়ে ক্যাম্পে ঢুকতে পারেন না৷
প্রসঙ্গত, বেইজিংয়ের বিরুদ্ধে প্রায় বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন উইগুর সম্প্রদায়ের মানুষ৷ ২০০৯ সালে শিনজিয়াং-এর রাজধানী উরুমকিতে বিক্ষোভে প্রায় ২০০ জন প্রাণ হারিয়েছিলেন৷ এরপর ২০১৪ সালে উইগুর বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ছুরি হামলায় ২৯ জন নিহত হন৷ এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে মুসলমানদের জন্য ক্যাম্প চালু করে চীন৷
যদিও প্রকাশিত নথির তথ্য ঠিক নয় বলে দাবি করেছেন চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র গেং শুয়াং৷ সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে চীনের লড়াইকে কলঙ্কিত করার চেষ্টা করায় গণমাধ্যমের সমালোচনা করেন তিনি৷
এসডব্লিউ/এসএস/১৮৫৫
আপনার মতামত জানানঃ