১৯৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বর ছিল রবিবার। সেদিন অযোধ্যায় জড়ো হওয়া কয়েক লক্ষ উগ্র হিন্দুত্ববাদী সাড়ে চারশো বছরের বেশি সময় আগে স্থাপিত বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে ফেলে। তাদের ঠেকাতে গিয়ে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে হতাহত হন কয়েক শত হিন্দুত্ববাদী কর্মী।
ঘটনার প্রতিক্রিয়ার দেশটির কয়েকটি রাজ্যে তাৎক্ষণিকভাবে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়। বাংলাদেশে ওই ঘটনার প্রভাব তৈরি হয় পরদিন ৭ই ডিসেম্বর। এর পরের কয়েকটি দিন বেশ ঘটনা বহুল ছিল বাংলাদেশের জন্য।
সেদিন ছিল সোমবার। আগের দিনই ভারতের অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ভেঙ্গেছে সেখানকার হিন্দুত্ববাদীরা। ঢাকার থেকে প্রকাশ হওয়া বাংলা এবং ইংরেজি দৈনিকগুলোর সব কটির প্রধান শিরোনাম ছিল এ বিষয়টি নিয়েই। সেদিন বাংলাদেশের সব কয়টি রাজনৈতিক দল এই ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছিল। মন্ত্রী পরিষদের বৈঠকেও বিষয়টির নিন্দা করা হয়।
কিন্তু সকাল গড়িয়ে দুপুরে পৌঁছানোর আগেই ঢাকার বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয়। বিভিন্ন জেলায়ও একই ধরণের বিক্ষোভ মিছিল হয় বিক্ষুব্ধ ইসলামী জনতার ব্যানারে। দুপুরের মধ্যে সেই বিক্ষোভ পরিণত হয় সহিংসতায়। লাঠিসোটা নিয়ে হিন্দুদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাড়িঘর এমনকি মন্দিরে হামলা ও লুটপাট চালানো হয় এসব মিছিল থেকে।
১৯৯২ সালের ৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশের জাতীয় মন্দির ঢাকেশ্বরী মন্দিরে হামলা করে মুসলিমরা। বাবরী মসজিদ ভাঙ্গার গুজবকে কেন্দ্র করে ১৯৯০ সালেও এই মন্দিরে হামলা করেছিল মুসলিমরা। এছাড়া দুর্বিত্তরা ঢাকার ভোলানাথগিরি আশ্রমেও আক্রমণ, লুটপাট ও ভাংচুর চালায়।
পুরনো ঢাকার হিন্দু মালিকানাধীন স্বর্ণের দোকানগুলোতে লুটপাট করে মুসলিমরা। রায়েরবাজারের হিন্দু বাড়িঘর লুট করে আগুন ধরিয়ে দেয় তারা। দুপুরে পুরনো ঢাকার নামকরা মরনচাঁদ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের বেশ কয়েকটি শাখায় হামলা চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয় বিক্ষোভকারীরা।
একই সঙ্গে পুরনো ঢাকার শাখারীবাজার, তাঁতিবাজার, কোতোয়ালীসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় জুয়েলারি দোকান, মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, হোটেল ও রেস্তরাঁসহ হিন্দু সম্প্রদায়ের মালিকানাধীন দোকানপাটে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। পুরনো ঢাকার জয়কালী মন্দির, নবাবগঞ্জের ঋষিপাড়া মন্দিরসহ অনেক মন্দিরে হামলা হয়। ঢাকশ্বেরী মন্দিরে হামলা করতে গেলে পুলিশ ও এলাকার মানুষ যৌথভাবে তাতে বাধা দেয়।
৭ই ডিসেম্বর সকাল ১০টার পরই ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয়। হাইকোর্টের মোড়ে প্রথম পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ হয়। দিন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সংঘর্ষও বাড়তে থাকে। বিভিন্ন জায়গায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় বিক্ষুব্ধ ইসলামী জনতার।দুপুরে মতিঝিলে এয়ার ইন্ডিয়ার অফিসে আগুন ধরিয়ে দেয় একদল লোক।
ভারতীয় তথ্যকেন্দ্রের লাইব্রেরীতে হামলা চালিয়ে হাজার হাজার বই রাস্তায় ফেলে অগ্নিসংযোগ করে বিক্ষোভকারীরা। সেই সঙ্গে পল্টনে কম্যুনিস্ট পার্টির অফিসে হামলা করে আগুন ধরিয়ে দেয়। বিকেলে হামলা হয় হিন্দু অধ্যুষিত শাখারীবাজর এলাকায়।
ক্রমে ঢাকার বাইরে থেকেও সংঘর্ষ ও হামলার খবর পাওয়া যায়। পরিস্থিতি এমন হয়, সরকার ঢাকার কিছু অংশে এবং ভোলাসহ কয়েকটি জেলার কার্ফ্যু ঘোষণা করে। টাঙ্গাইল ও জামালপুরসহ কয়েকটি জেলায় ১৪৪ ধারা জারি করে।
সার্ক চার জাতির ক্রিকেট টুর্নামেন্ট সমাপ্ত করা সম্ভব হয়নি। ৭ ডিসেম্বর,বাংলাদেশ-এ এবং ভারতীয়-এ দলের মধ্যকার খেলা চলাকালীন সময়ে ঢাকা জাতীয় স্টেডিয়ামে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম) প্রায় ৫,০০০ উন্মত্ত মুসলিম জনতা লোহার রড,বাঁশের লাঠি,ছুরি, রাম দা নিয়ে আক্রমণ করে।
পুলিশ কাঁদানে গ্যাস এবং রবার বুলেট ছুড়েও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। ফলে ৮.১ ওভার খেলার পরেই খেলা পরিত্যাক্ত ঘোষণা করা হয়। আয়োজকেরা ১০ ডিসেম্বরে পুনরায় খেলার সময়সূচী ঘোষণা করে। ১১ ডিসেম্বরে ভারতীয়-এ দল এবং পাকিস্তান- এদলের মধ্যে ফাইনাল ম্যাচ হবার কথা ছিল।কিন্তু উভয় খেলাই পরিত্যাক্ত ঘোষণা করা হয়।
৮ ডিসেম্বরে কক্সবাজার জেলার কুতুবদিয়া উপজেলার হিন্দুরা আক্রান্ত হয়। ১৪ টি হিন্দু মন্দির লুটপাট,অগ্নিসংযোগ ও ধ্বংসের শিকার হয়। ৫১ টি হিন্দু বাড়ি ধ্বংস করা হয় আলী আকবর ডালে ও ৩০ টি ধ্বংস করা হয় চৌফলদানিতে।
চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি ও মীরেরসরাইয়ের প্রত্যেকটি হিন্দু অধ্যুষিত গ্রাম সম্পূর্ণরূপে পুড়িয়ে দেয়া হয়। পঞ্চাননধাম এবং তুলসীধাম সহ পাঁচটি হিন্দু মন্দির ভাংচুর ও ধ্বংস করে দেয় মুসলিমরা। চট্টগ্রামে বাচুলিয়া এবং ইলিয়াস কলোনির হিন্দু মহিলাদেরকে ধর্ষণ ও অপহরণ করে মুসলিমরা।
সেদিন ঢাকাসহ দেশের অন্তত ২১ টি জেলায় বিক্ষুব্ধ ইসলামী জনতার ব্যানারে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং মন্দিরে হামলা চালানো হয়। এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে চলেছিল সেই অবস্থা।
৮ই ডিসেম্বর সারাদেশে হরতাল ডাকে জামায়াতে ইসলামী এবং আরো কয়েকটি ইসলামী দল। এই হরতালে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় ইসলামপন্থী দলসমূহ, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি এবং পুলিশের মধ্যে ত্রিমুখী সংঘর্ষে উভয় পক্ষে বহু মানুষ হতাহত হন।
ঐদিন সারাদেশে সহিংস পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে ১২ ও ১৩ই ডিসেম্বর অনুষ্ঠিতব্য সার্ক শীর্ষ সম্মেলন স্থগিত করে ১৯৯৩ সালে জানুয়ারিতে সম্মেলনের সময় নির্ধারণ করে সরকার।
এসডব্লিউ/এসএস/২২২০
আপনার মতামত জানানঃ