গত কয়েক বছর ধরে চলে আসা অর্থনৈতিক সংকটের সঙ্গে করোনা অতিমারির প্রভাব যোগ হওয়ায় শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি এখন অনেকটাই বিপর্যস্ত। রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্সে ব্যাপকভাবে কমে আসার পাশাপাশি পর্যটন খাতে ধস নেমেছে। চলতি বছর এরই মধ্যে এক বিলিয়ন ডলারের ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে দেশটিকে। ফলে গত জুন মাস শেষে শ্রীলঙ্কার বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ চার বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে, যা দিয়ে তিন মাসের আমদানি ব্যয়ও মেটানো যাবে না।
বড় ধরনের আর্থিক ও মানবিক সংকটের মুখোমুখি শ্রীলঙ্কা। আশঙ্কা করছে, ২০২২ সালে দেউলিয়া হতে পারে দেশটি। রেকর্ডমাত্রায় মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি, দ্রব্যমূল্যের আকাশছোঁয়া দাম এবং কোষাগার শূন্য হয়ে পড়ায় এমন আশঙ্কা প্রবল হচ্ছে।
অর্থসংকটে এবার ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে শ্রীলঙ্কা। জ্বালানি কিনতে না পারায় চাহিদামতো বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে না দেশটি। সে কারণেই প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে লঙ্কান কর্তৃপক্ষ। খবর অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের।
শ্রীলঙ্কার পাবলিক ইউটিলিটি কমিশন জানিয়েছে, সোম ও মঙ্গলবার দুই ঘণ্টা করে বন্ধ থাকার পর বুধবার টানা সাড়ে চার ঘণ্টা বৈদ্যুতিক গ্রিড বন্ধ রাখবে তারা। অঞ্চলভেদে সকাল সাড়ে ৮টা থেকে রাত সাড়ে ১০টার মধ্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হবে।
লঙ্কান নীতিনির্ধারণী কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, জ্বালানি ঘাটতির কারণে জাতীয় গ্রিডে ৭০০ মেগাওয়াট কম যোগ হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রায়াত্ত সিলন ইলেক্ট্রিক বোর্ড বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়ে দেওয়ার অনুমতি চেয়েছে।
ইউটিলিটিজ কমিশনের চেয়ারম্যান জনাকা রত্নায়েকে বলেছেন, জ্বালানি ঘাটতির কারণে এই সমস্যা হচ্ছে। এটা জ্বালানির সংকট, বিদ্যুতের নয়।
জ্বালানি সংকটে ভুগছে শ্রীলঙ্কা। সংকট মেটাতে অতীতের মতো ভারতেরই দ্বারস্থ হচ্ছে এই প্রতিবেশী দেশ। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ৪০ হাজার মেট্রিক টন করে পেট্রোল এবং ডিজেল আমদানি করবে শ্রীলঙ্কা। ২০০২ সাল থেকেই শ্রীলঙ্কায় তেল সরবরাহ করছে আইওসি।
সম্প্রতি শ্রীলঙ্কার বিদ্যুৎমন্ত্রী জানিয়েছেন, শ্রীলঙ্কায় জ্বালানি সংকট দেখা দিয়েছে। ঘাটতি মেটাতে ইন্ডিয়ান অয়েল কর্পোরেশনের সঙ্গে আলোচনা চলছে। তারপরই শ্রীলঙ্কায় আইওসির নতুন করে তেল সরবরাহের কথা জানা গেল।
অর্থসংকটে এবার ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে শ্রীলঙ্কা। জ্বালানি কিনতে না পারায় চাহিদামতো বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে না দেশটি। সে কারণেই প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে লঙ্কান কর্তৃপক্ষ।
শ্রীলঙ্কার মন্ত্রী উদয় গাম্মানপিলা জানিয়েছেন, বৈদেশিক মুদ্রার অভাবেই শ্রীলঙ্কায় জ্বালানির সংকট দেখা দিয়েছে। বহু পাম্পেই তেল নেই। সংকট মেটাতে বাধ্য হয়ে ইন্ডিয়ান অয়েলের শ্রীলঙ্কান সংস্থা ‘দ্য লঙ্কা আইওসি’র দ্বারস্থ হয় কলম্বো।
তবে ইন্ডিয়ান অয়েলের এই শ্রীলঙ্কান সংস্থাও প্রথমে দ্বীপরাষ্ট্রে তেল সরবরাহে রাজি হয়নি। কারণ, শ্রীলঙ্কার অন্যান্য সংস্থার মতো ‘দ্য লঙ্কা আইওসি’ও বৈদেশিক মুদ্রার অভাবে ভুগছে। আর, সেই কারণে তেল আমদানিও করতে পারেনি। শেষপর্যন্ত অবশ্য নয়াদিল্লীর আশ্বাসে শ্রীলঙ্কায় জ্বালানি সরবরাহে রাজি হয়েছে আইওসির শ্রীলঙ্কান সংস্থাটি।
করোনাভাইরাস মহামারির আঘাতে কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে শ্রীলঙ্কা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, গত জানুয়ারিতে ৫০ কোটি ডলারের বন্ড পরিশোধের পর তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২৩৬ কোটি ডলার। অথচ এ বছর তাদের ঋণের কিস্তি রয়েছে ৭০০ কোটি ডলারের বেশি, এর মধ্যে জুলাইয়েই আরও ১০০ কোটি ডলারের বন্ড পরিশোধ করতে হবে লঙ্কানদের।
এমন সংকটের মুখে শ্রীলঙ্কায় নিত্যপণ্যের চরম ঘাটতি দেখা দিয়েছে। দুধ, গ্যাস, কেরোসিন কিনতে দোকানগুলোর সামনে মানুষের লম্বা লাইন দেখা গেছে। পণ্যের দামও বাড়ছে অস্বাভাবিক গতিতে।
লঙ্কান কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, দেশটিতে মাত্র এক মাসের ব্যবধানে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে গত ডিসেম্বরে ১২ দশমিক ১ শতাংশে পৌঁছেছে। একই সময়ে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে অন্তত ২২ শতাংশ।
কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রা ঘাটতির কারণে আমদানিকারকরা বিদেশ থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আনতেও পারছেন না। ফলে দেশটি ঘুরেফিরে আবারও সেই ‘বিদেশি ঋণের ফাঁদে’ পড়তে যাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি কঠিন সংকটে ক্রমে তলিয়ে যাচ্ছে। দেশটিতে আমদানি করা পণ্যের ক্রমবর্ধমান ঘাটতি জনজীবনকে পর্যুদস্ত করে দিচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর সংঘবদ্ধ মজুতদারি এতই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহে সৃষ্ট কৃত্রিম সংকট তদারকের জন্য একজন মিলিটারি জেনারেলের নেতৃত্বে ‘কন্ট্রোলার অব সিভিল সাপ্লাইজ’ নামের কঠোর নজরদারি সংস্থা গড়ে তুলেও অবস্থা সামাল দেওয়া যাচ্ছে না।
গাড়ি, স্যানিটারি আইটেম, কিছু ইলেকট্রনিক পণ্যের আমদানি সরাসরি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি শ্রীলঙ্কার সরকার দেশে ‘অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থা’ ঘোষণা করেছে। কারণ, দেশটি এখন ‘অর্থনৈতিক ধস’-এর সম্মুখীন। বেশ কয়েক মাস ধরে ভয়ংকর খাদ্যসংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশটি। অথচ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ একেবারে তলানিতে পৌঁছে যাওয়ায় বিদেশ থেকে খাদ্যদ্রব্য আমদানি করে সংকট মোকাবিলার সামর্থ্য এখন তাদের নেই বললেই চলে।
করোনাভাইরাস মহামারি শ্রীলঙ্কায় খুব বেশি মানুষের মৃত্যু না ঘটালেও সর্বনাশ ডেকে আনল শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের গুরুত্বপূর্ণ খাত পর্যটন খাতকে প্রায় ধসিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে। দুই বছর ধরে সারা বিশ্বের পর্যটন খাতে এমন বিপর্যয় গেড়ে বসেছে, যা থেকে উত্তরণ এখনো সুদূরপরাহত। শ্রীলঙ্কার রপ্তানি আয়ের আরও দুটি প্রধান সূত্র এলাচি ও দারুচিনিও বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মহামারির এই দুই বছরে। এ কারণে শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক আয়ে বড়সড় ধস নামল। এর সঙ্গে যুক্ত হলো ২০০৯ সাল থেকে বৈদেশিক ঋণের অর্থে যেখানে–সেখানে প্রকল্প গ্রহণের বদখাসলতের চরম মূল্য চুকানোর পালা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক দেউলিয়াত্ব থেকে শিক্ষণীয় হলো, রাজাপক্ষে পরিবার ভোটের রাজনীতিকে যেভাবে ‘পারিবারিক একনায়কত্বে’ পর্যবসিত করেছে, সেটা একটা সমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশকেও গভীর সংকটের গিরিখাতে নিক্ষেপ করতে পারে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১২০৭
আপনার মতামত জানানঃ