বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলো চলছে লাভে। এর মধ্যে বারবার বিদ্যুৎ-এর দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। অথচ সরকার নিজেই ৯ হাজার কোটি টাকার বিদ্যুৎবিল খেলাপি। অর্থাৎ নিজের দায় জনগণের কাঁধে চাপানোর রাস্তা খুঁজছে সরকার।
ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) এবং পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) একটি যৌথ জরিপে সম্প্রতি জানানো হয়, দেশে করোনাকালে তিন কোটি ২৪ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে সরকারের বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির উদ্যোগ জনজীবনকে স্থবির করে দেবে। শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রবৃদ্ধিকে থামিয়ে দেবে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিদ্যুৎ-এর মূল্য বৃদ্ধি কৃষি, পরিবহন, দ্রব্যমূল্য, শিল্প উৎপাদন থেকে শুরু করে দেশের প্রায় সব সেক্টরে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। থমকে যায় অর্থনীতির অগ্রযাত্রা।
সরকার নিজেই ৯ হাজার কোটি টাকার বিদ্যুৎবিল খেলাপি
বিদ্যুৎ বিল পরিশোধের পর্যাপ্ত বাজেট থাকলেও সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকার বিদ্যুৎ বিল বকেয়া রেখেছে।
সূত্র মতে, এসব বিল আদায়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। প্রয়োজনে বিল আদায়ে সংযোগ বিচ্ছিন্নেরও নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় তিনি এ নির্দেশ।
শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত একনেক সভায় গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী। সভায় জানানো হয়, সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে এখন প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকার বেশি বিদ্যুৎ বিল বকেয়া রয়েছে। এ ছাড়া বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেরও বিল বকেয়া রয়েছে।
একনেক সভা শেষে প্রধানমন্ত্রীর দেয়া নির্দেশনাগুলো গণমাধ্যমকে জানান পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। তিনি বলেন, ‘পর্যাপ্ত বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠান গ্যাস-বিদ্যুতের বকেয়া পরিশোধ করছে না। এমনকি অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও প্রচুর বকেয়া রয়েছে। এ জন্য এসব বকেয়া আদায়ের জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। প্রয়োজনে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন।’
একনেকে উপস্থিত একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা বলেন, ‘একনেক সভায় বকেয়া বিল আদায়ে কঠোর হতে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এমনকি তিনি বলেছেন, বকেয়া পরিশোধ না করলে প্রয়োজনে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।’
গ্যাসের বিলও কয়েক হাজার কোটি টাকা বকেয়া থাকার কথা জানানো হয়। সম্প্রতি সংসদে জানানো হয়, বর্তমানে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রায় সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা গ্যাসের বিল বকেয়া রয়েছে।
একনেক সভায় প্রধানমন্ত্রী বিদ্যুৎ ও গ্যাসে ভর্তুকির পরিমাণ কমিয়ে আনার কথা বলেন। তিনি চান এই দুই খাতে ভর্তুকি কমিয়ে আনতে, তাই সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় কর্মকৌশল প্রণয়নের নির্দেশ দেন তিনি।
সরকারকে বিদ্যুৎ ও গ্যাসে একটা বড় অঙ্কের অর্থ ভর্তুকি দিতে হয়। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি খাতে ভর্তুকি ধরা রয়েছে সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা।
জ্বালানি ও বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারের যে অবস্থা তাতে এই ভর্তুকিতে কুলানো সম্ভব হবে না। কারণ চলতি অর্থবছরের শুরুতে যেখানে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের ব্যারেলপ্রতি দাম ছিল ৪৫ ডলার সেখানে সেই তেল এখন বিক্রি হচ্ছে ৮০ ডলারে।
জ্বালানি ও বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে বছর শেষে জ্বালানি খাতে বাড়তি ১০ হাজার কোটি টাকা এবং এলএনজি খাতে ৬ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকির প্রয়োজন হবে।
তবু বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি
বিদ্যুতের ক্ষেত্রে সরকার আরও এক ধাপ এগিয়ে রয়েছে। গত ১১ বছরে সরকার ১০ বার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে। গ্রাহক পর্যায়ে দাম বেড়েছে ৯০ শতাংশ।
২০১০ সালে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের গড় খুচরা মূল্য ছিল তিন টাকা ৭৬ পয়সা। সর্বশেষ ২০২০ সালের মার্চে তা বাড়িয়ে ৭ টাকা ১৩ পয়সা করা হয়। এখন আরেক দফা দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এক দশক ধরে একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে যাচ্ছে সরকার। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা গেলেও কাজে লাগানো যায়নি বিদ্যুৎ। ফলে বিদ্যুৎ খাতের সক্ষমতা ও উৎপাদনের মধ্যে ব্যবধান থেকেই যাচ্ছে। এর উপর মহামারীকালে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা ও উৎপাদনের অসামঞ্জস্যতা বাড়ছে প্রতিদিনই। সক্ষমতার বড় একটি অংশ অব্যবহৃত থেকে যাওয়ায় আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে দেশের বিদ্যুৎ খাত।
তথ্যমতে, বিদ্যুতের লোকসান মেটাতে ২০১৪ সালের জুন থেকে গত বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত সাড়ে ৬ বছরে সরকার মোট ভর্তুকি দিয়েছে ৪২ হাজার ৮৫১ কোটি ৭৩ লাখ টাকা।
গত ১০ বছরে সরকার ৫২ হাজার কোটি টাকার বেশি ক্যাপাসিটি চার্জ দিয়েছে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয়। ভাড়ায় চালিত এসব কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনে তা ভর্তুকি দিয়ে বিতরণ করা হচ্ছে গ্রাহকের কাছে। প্রতি বছর ভর্তুকির পরিমাণ দফায় দফায় বাড়ছে।
অথচ বিদ্যুতের কোম্পানিগুলোর অধিকাংশই লাভজনক। তারা প্রতি বছর সরকারি কোষাগারে কয়েক হাজার কোটি টাকা জমা দিচ্ছে।
উদ্বৃত্ত অর্থ, ট্যাক্স-ভ্যাট ও বিভিন্ন ফি হিসেবে ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা বিদ্যুৎ ও গ্যাস খাত থেকে আয় করেছে সরকার। গ্যাস খাতের কোম্পানিগুলো শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশও দিয়েছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-বোনাসও বাড়ছে ফি বছর।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি এবং নীতিনির্ধারকদের অদূরদর্শী সিদ্ধান্তের কারণে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের ব্যয় বাড়ছে দিন দিন। চাহিদার অতিরিক্ত বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হওয়ায় বসিয়ে বসিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা দিতে হচ্ছে উদ্যোক্তাদের।
এসডব্লিউ/এসএস/২১১৫
আপনার মতামত জানানঃ