ভারতে হিন্দু-মুসলিম মেরুকরণে জর্জরিত উত্তর প্রদেশে চলতি বিধানসভা নির্বাচনের সময় রাজ্যের চার কোটি মুসলিমের ওপর নতুন করে নজর পড়েছে। ভারতে ২০১৪ সালে হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে মুসলিমদের টার্গেট করে বিদ্বেষ ছড়ানো এবং সেইসাথে হত্যার ঘটনার খবর নিয়মিত শিরোনাম হচ্ছে।
সিংহভাগ ক্ষেত্রেই অভিযুক্তরা বিজেপির সমর্থক। অনেক পর্যবেক্ষক এবং সমালোচক বলেন বিজেপি নেতাদের মুসলিম বিরোধী উস্কানিমূলক কথাবার্তা অপরাধীদের লাগামহীন করে তুলেছে। বিজেপি এই অভিযোগ অস্বীকার করে, যদিও তাদের নেতারা এ ধরণের সাম্প্রদায়িক অপরাধের কোনো নিন্দা করেননা বললেই চলে।
নরেন্দ্র মোদির নিয়ন্ত্রণেই হয়েছে অত্যাচার
উত্তর প্রদেশে ২০১৫ সালে ঘরে গরুর মাংস রাখার গুজবে ৫২ বছরের এক মুসলিমকে যখন পিটিয়ে মারা হয় তখন প্রধানমন্ত্রী মোদী একটি কথাও বলেননি, যা নিয়ে তার অনেক সমালোচনা হয়েছে।
হত্যাকাণ্ডের বেশ কয়েক সপ্তাহ পর তিনি বলেন, হিন্দু আর মুসলিমদের উচিৎ নিজেদের মধ্যে লড়াই না করে দারিদ্রের বিরুদ্ধে লড়াই করা। ২০১৭ সালে তিনি গো-রক্ষার নামে বাড়াবাড়ির নিন্দা করেন।
২০১৫ সালের ঐ হত্যাকাণ্ড নিয়ে ভারতের বাইরেও ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। কিন্তু তার পরও ভারতে মুসলিমদের ওপর অনেক হামলা হয়েছে, এবং সবচেয়ে জঘন্য হামলাগুলোর অধিকাংশই হয়েছে উত্তর প্রদেশে যেখানে গেরুয়া পোশাকধারী হিন্দু গুরু যোগী আদিত্যনাথ ২০১৭ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে প্রকাশ্যে মুসলিম বিরোধী বিদ্বেষমূলক কথাবার্তা বলে চলেছেন।
সুনির্দিষ্টভাবে বলা কঠিন ঠিক কত হামলা বছরে হচ্ছে। ২০১৭ সালে ভারতের অপরাধ রেকর্ড ব্যুরো এসব তথ্য জোগাড় করলেও তা প্রকাশ করা হয়নি।
মুসলিম অত্যাচারে নতুন মাত্রা এনেছেন যোগী
মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের শাসনামলে মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক অপরাধের কয়েকটি মামলার বর্তমান অবস্থা আমাদের ওই অঞ্চলের মুসলিমদের করুণ জীবন সম্পর্কে ধারণা দেবে।
আনোয়ার আলীকে ২০১৯ সালের মার্চে একদল কট্টর হিন্দু হত্যা করে বলে অভিযোগ। মৃত আনোয়ার আলী উত্তর প্রদেশের শোনভদ্র জেলায় তার বাড়ির কাছে একটি ইসলাম ধর্মীয় স্থাপনা ভাঙা ঠেকাতে গেলে তার ঐ করুণ পরিণতি হয়।
পুলিশ ১৮ জনকে গ্রেপ্তার করে যাদের সবাই স্থানীয় হিন্দু। তাদের মধ্যে কয়েকজন কিশোর বয়সী। কয়েক মাসের মধ্যে তারা সবাই জামিন পেয়ে যায়।
আনোয়ার আলীর স্ত্রী বিধবা কামরুন আলী বলেন তার পরিবার এখনও এই হত্যার বিচার চায়। তিনি বলেন, কাঁধের ওপর একটি পাতলা তোয়ালে রাখতেন তিনি। সেই তোয়ালে তার মুখের ভেতর ঠেসে ধরে তাকে তারা হত্যা করে।
নিহত আনোয়ার আলীর বড় ছেলে আইনুল হক অভিযোগ করেন তাদের পরসোয়া গ্রামের স্কুলে রবীন্দ্র খারোয়ার নামে এক শিক্ষক আসার পর থেকে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা শুরু হয়।
তিনি বলেন, ঐ শিক্ষক অল্প বয়সী হিন্দুদের একজোট করে ইমাম চকের (যে জায়গায় ইসলামি স্থাপনাটি ছিল) বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে উৎসাহিত করেছেন। আইনুল হক বলেন, ঐ দলটি দুবার স্থাপনাটি ভেঙ্গে ফেলে। দুবারই পুলিশ এসে সেটি পুনর্নির্মাণের ব্যবস্থা করে।
২০১৯ সালের ২০শে মার্চ, মামলার এজাহারে পুলিশ লিখেছে, তৃতীয়বার স্থাপনাটি ভাঙার সময় আলী তাদের হাতেনাতে ধরে ফেললে তিনি হামলার শিকার হন।
আইনুল হক বলেন, সেসময় তার বাবাকে তারা হত্যা করে। ময়না তদন্তের রিপোর্টে বলা হয়েছে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে তার মৃত্যু হয়েছে। পুলিশের তদন্তে প্রধান সন্দেহভাজন হিসাবে রবীন্দ্র খারোয়ারের নাম করা হয়। তারা ঐ শিক্ষকের বাড়িতে তল্লাশি চালায়, কিন্তু তাকে পাওয়া যায়নি। পুলিশের খাতায় তিনি এখন পলাতক।
তবে রবীন্দ্র খারোয়ার এই হত্যাকাণ্ডে তার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ অস্বীকার করেন, এবং পরে পুলিশের চার্জশিটে তার নাম বাদ পড়ে। জেলা পুলিশ সুপার অমরেন্দ্র সিং জানান, আমরা রবীন্দ্র খারোয়ারের বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ পাইনি।
আলীর হত্যাকাণ্ডের পর রবীন্দ্র খারোয়ার, যিনি কট্টর হিন্দু সংগঠন আরএসএস-এর সদস্য, তিনি অন্য এক গ্রামের স্কুলে বদলি হয়ে চলে যান। ঐ মামলার অন্যতম একজন আসামী রাজেশ খারোয়ার বিবিসিকে বলেন, ঐ শিক্ষক আমাদের বলতেন যে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের জন্য একটি হুমকি। আমরা এখন মহা ঝামেলায় জড়িয়েছি। মামলায় পড়েছি। কিন্তু তাকে রক্ষা করা হয়েছে।
আইনুল হক বলেন তার বাবার হত্যাকাণ্ডের তিন বছর পরও ১৮ জন আসামীর সবাই জামিনে মুক্ত। বিচার কবে শুরু হবে তার কোনো ঠিক নেই।
পুলিশ এখানে কাঠের পুতুল
একই হতাশা প্রকাশ করেন শাহরুখ খান, যার বাবা শের খানকে মথুরা জেলায় ২০২১ সালের জুন মাসে গুলি করে হত্যা করা হয়। হত্যাকাণ্ডের সাত মাস পরও কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।
কেন কেউ গ্রেপ্তার হননি; এই প্রশ্নে মথুরার পুলিশ সুপার শিরিষ চন্দ্র বলেন সাংবাদিকদের সাথে তার কথা বলার এখতিয়ার নেই। পুলিশের ভাষ্যমতে, গবাদি পশু পরিবহন নিয়ে “অজ্ঞাতনামা” গ্রামবাসীদের সাথে হাতাহাতির সময় ৫০ বছরের শের খান নিহত হন।
কিন্তু তার ছেলে বলেন, চন্দ্রশেখর বাবা নামে এক হিন্দু গুরু তার বাবার হত্যাকারী। চন্দ্রশেখর, যিনি একটি গোশালা চালান, অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করেন।
শাহরুখ বলেন ধস্তাধস্তির সময় তিনি নিজেও গুলির ছররার আঘাতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন। পরদিন পুলিশ স্টেশনে জ্ঞান ফিরলে তিনি জানতে পারেন তার বাবা মারা গেছেন। শাহরুখ বলেন তিনি আসামী হিসাবে চন্দ্রশেখরের নাম ঢোকানোর কথা বারবার পুলিশকে বললেও পুলিশ শোনেনি। পুলিশ সুপার শিরিষ চন্দ্র একথা অস্বীকার করেন।
চন্দ্রশেখর বলেন, শের খান এবং কজন গ্রামবাসীর মধ্যে মারামারিতে তিনি হস্তক্ষেপ করেছিলেন, এবং আহতদের হাসপাতালে পাঠিয়েছিলেন।
কী নিয়ে বিরোধের সূচনা হয়েছিল তা অস্পষ্ট, তবে গরু-মহিষ পরিবহনের সময় কট্টর হিন্দুদের দলবদ্ধ হামলার অনেক ঘটনা ঘটেছে। উত্তর প্রদেশসহ ভারতের অধিকাংশ রাজ্যেই গরু জবাই নিষিদ্ধ হলেও মহিষের ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। তারপরও মহিষ পরিবহনের সময়েও এমন অনেক হামলা হয়েছে।
শের খানের হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িতদের গ্রেপ্তার তো দূরে থাক, চন্দ্রশেখরের করা গরু পাচারের এক মামলায় শাহরুখ এবং আরো পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। শাহরুখ বলেন, আমি আমার বাবার জানাজাতেও যেতে পারিনি কারণ আমাকে জেলে পাঠানো হয়।
নিহত শের খানের স্ত্রী সিতারার প্রশ্ন, যদি তারা (আসামীরা) মনে করেও থাকে যে আমার স্বামী পশু পাচার করছিল, তাকে ধরে পুলিশে দিতে পারতো, তারা তার ওপর গুলি চালালো কেন?।
‘ভাইরাল না হলে কিছুই হতো না’
গত বছর মে মাসে একটি ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয় যাতে দেখা যায় রাজ্যের মোরাদাবাদ জেলায় একদল লোক এক ব্যক্তিকে বেধড়ক পেটাচ্ছে। ঐ পিটুনির শিকার শাকির কোরেশি। ক্রেতার জন্য মহিষের মাংস নিয়ে যাওয়ার সময় ধরে বেধড়ক পেটানো হয় তাকে।
শাকির কোরেশি, যার পরিবার কয়েক পুরুষ ধরে মাংসের ব্যবসা করেন, যখন তার স্কুটারে করে তার এক খরিদ্দারের জন্য কিছু মহিষের মাংস নিয়ে যাচ্ছিলেন, একদল মানুষ তাকে থামিয়ে বলে সে গরুর মাংস নিয়ে যাচ্ছে।
আমি কাঁদতে কাঁদতে তাদের বললাম আমার কাছে যে মাংস তা গরুর নয়, মহিষের। কিন্তু তারপরও তারা আমাকে পেটাতে থাকলো।
তিনি বলেন ভয়ে তিনি পুলিশের কাছে নালিশ করতেও যাননি। ভিডিওটি ভাইরাল হওয়ার পরই তিনি সাহস করে গেছেন।
পুলিশ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে যার মধ্যে রয়েছে মনোজ ঠাকুর, যিনি স্থানীয় একটি গো-রক্ষা দলের সাথে যুক্ত। দুমাস কারাগারে থাকার পর তিনি জামিন পান। এই মামলার সর্বশেষ অবস্থা জানতে চাইলে কথা বলতে চাননি মোরাদাবাদের সিনিয়র পুলিশ সুপার বাবলু কুমার।
তবে মনোজ ঠাকুর স্বীকার বলেন তিনি ঐ পিটুনিতে অংশ নিয়েছিলেন। তার কথা ছিল। ভিডিওটি ভাইরাল না হলে তার কিছুই হতো না। ঐ মারধোরের পর, শাকির কোরেশি মাংস বিক্রি বন্ধ করে দেন। তিনি এখন দিনমজুরের কাজ করেন।
হত্যা-নির্যাতনের শিকার পরিবারগুলোর মধ্যে এমন আতংক স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা মনে করেন, সহ্য করা ছাড়া তাদের সামনে এখন আর কোনো বিকল্প নেই।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩০৫
আপনার মতামত জানানঃ