গোপনীয়তার জলে ভরা সুইস ব্যাংকিং। এক্ষেত্রে সুইস ব্যাংকের নাম বেশি শোনা যায়। সারা দুনিয়ার বিত্তশালী এবং বিখ্যাত মানুষদের অঢেল অর্থ রাখার প্রথম পছন্দ সুইস ব্যাংক।
ব্যাংকিং এর ক্ষেত্রে একজন গ্রাহক সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটি আশা করে তা হলো গোপনীয়তা। যদি অবৈধ টাকা বা কালোটাকা হয় তবে গোপনীয়তাই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়৷ আর সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকিং এর সুনাম ঠিক এখানেই। ডাক্তারের সঙ্গে রোগীর বা উকিলের সঙ্গে মক্কেলের যে বিশ্বাসযোগ্য সম্পর্ক ঠিক তেমনি সুইস ব্যাংক এর সঙ্গে তাদের গ্রাহকদের সম্পর্ক চরম বিশ্বাসের। সুইস ব্যাংক তাদের গ্রাহকদের ব্যক্তিগত কোনো তথ্য কাউকেই দিতে বাধ্য নয়।
বিশ্বের সবচেয়ে সুরক্ষিত ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান হিসেবে সুনাম রয়েছে সুইজারল্যান্ডের ক্রেডিট সুইস ব্যাংকের যা সুইস ব্যাংক নামেই বেশি প্রচলিত। হিসাবের তথ্য গোপন শুধু নয়, হিসাবধারীর পরিচয় বা অন্য কোনো তথ্যের সর্বোচ্চ গোপনীয়তা রক্ষায় তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সেই সুইস ব্যাংকের ১৮ হাজারের বেশি হিসাবের তথ্য ফাঁস হয়েছে। এসব ব্যাংক হিসাবের ক্ষেত্রে নানা সতর্কবার্তা থাকলেও তা গ্রাহ্য করা হয়নি।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমসের তথ্যমতে, বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের সম্পদ গচ্ছিত রাখার পাশাপাশি এ সম্পদ অর্জনের পথ সবই গোপন রাখে সুইস ব্যাংক। সুইজারল্যান্ডের এই ক্রেডিট সুইস ব্যাংক বিশ্বের অন্যতম আইকনিক ব্যাংক। মূলত তথ্য গোপন রাখার কারণেই তারা বেশি আলোচিত। এখন এই ব্যাংকের গ্রাহকদের সম্পর্কে তথ্য ফাঁস হলো, যেখানে বেরিয়ে এল বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে গোয়েন্দা কর্মকর্তা, নিষেধাজ্ঞার আওতাধীন ব্যবসায়ী, মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী থেকে শুরু করে অনেকেই।
এই তথ্য ফাঁস করেছেন ব্যাংকটির এক স্বঘোষিত হুইসেল-ব্লোয়ার। তিনি ব্যাংকটির ১৮ হাজারের বেশি হিসাব সম্পর্কিত তথ্য জার্মান সংবাদমাধ্যম সুডয়চে যায়টংকে দেন, যেখানে জমা রয়েছে মোট ১০ হাজার কোটি ডলারের বেশি অর্থ। সংবাদপত্রটি এই তথ্য সংবাদ বিষয়ক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রোজেক্টসহ (ওসিসিআরপি) আরও ৪৬টি সংবাদমাধ্যমকে দেয়, যার মধ্যে রয়েছে নিউইয়র্ক টাইমস।
ব্যাংকের গ্রাহকদের সম্পর্কে তথ্য ফাঁস হলো, যেখানে বেরিয়ে এল বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে গোয়েন্দা কর্মকর্তা, নিষেধাজ্ঞার আওতাধীন ব্যবসায়ী, মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী থেকে শুরু করে অনেকেই।
নিউইয়র্ক টাইমস জানায়, ফাঁস হওয়া এই তথ্যের মধ্যে ১৯৪০-এর দশক থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত সময়ের তথ্য রয়েছে। ক্রেডিট সুইস ব্যাংকের যে গ্রাহকদের তথ্য ফাঁস হয়েছে, তাদের মধ্যে রয়েছেন জর্ডানের রাজা দ্বিতীয় আবদুল্লাহ এবং মিসরের সাবেক একনায়ক হুসনি মোবারকের দুই ছেলে। রয়েছেন পাকিস্তানের গোয়েন্দা প্রধান, যিনি ১৯৮০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ থেকে শত শত কোটি ডলার আফগানিস্তানের মুজাহিদীনদের পাঠিয়েছিলেন। রয়েছে ভেনেজুয়েলার সরকারি কর্মকর্তাদের নামও।
ফাঁস হওয়া তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, শুধু অতি ধনীদেরই সেবা দিচ্ছে না ক্রেডিট সুইস ব্যাংক। তারা এমনকি নানা মাধ্যম থেকে সতর্কতা জারি করার পরও বিভিন্ন মানুষকে সেবা দিয়ে গেছে, যাদের নাম শুনলে যে কেউ তাদের সঙ্গে লেনদেনের সম্পর্ক তৈরিতে দুবার ভাববে। কিন্তু সুইস ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এ নিয়ে ভাবার প্রয়োজন বোধ করেনি।
এ বিষয়ে সুইজারল্যান্ডের অর্থপাচার বিষয়ক সংস্থার সাবেক প্রধান ডেনিয়েল থেলেসক্লাফ নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি বা এমন উৎস থেকে পাওয়া অর্থ জমা করার ক্ষেত্রে সুইস ব্যাংকের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কিন্তু এই আইন সাধারণত অনুসরণ করা হয় না।
এ সম্পর্কিত এক বিবৃতিতে ক্রেডিট সুইস ব্যাংকের মুখপাত্র ক্যানডিস সান বলেন, ‘এ ধরনের সব অভিযোগ ক্রেডিট সুইস পুরোপুরি অস্বীকার করছে। একই সঙ্গে উদ্দেশ্যমূলক কিছুর সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগও খারিজ করে দিচ্ছে।’
তার ভাষ্যমতে, ফাঁস হওয়া ব্যাংক হিসাবগুলোর অধিকাংশই কয়েক দশক আগের, যখন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে চাওয়া এবং এ সম্পর্কিত আইন, বিধি ও চর্চা এখনকার চেয়ে একেবারেই আলাদা ছিল।
এদিকে পাকিস্তানের গণমাধ্যম দ্য নিউজের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফাঁস হওয়া হিসাবের তথ্যে দেখা গেছে, অন্তত ৬০০ ব্যাংক হিসাবের সঙ্গে ১৪০০ পাকিস্তানির নাম জড়িত।
দ্য নিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়, ফাঁস হওয়া তথ্যে এমন হিসাবও পাওয়া গেছে যেগুলো এখন বন্ধ কিন্তু অতীতে চালু ছিল। তবে ফাঁস হওয়া হিসাবে এমন ব্যক্তিদের নাম পাওয়া গেছে যাদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টিবিলি ব্যুরো (এনএবি) তদন্ত করছে। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, এনএবি যখন তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছিল, তখনই তারা সুইস ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলেছেন। অথচ বিষয়টি আমলে নেয়নি সুইস ব্যাংক। যদিও মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তি বা অপরাধীদের সুইস ব্যাংকে হিসাব খোলার ব্যাপারে বিধিনিষেধ আছে।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে গ্রাহকের গোপনীয়তা বজায় রাখার জন্য সুইজারল্যান্ড আইন সবচেয়ে কঠোর। সাধারণত ব্যাংকে অর্থ জমা রাখতে গেলে অর্থের উৎস জমা দেয়া ছাড়াও কর জমা দেয়ার ছাড়পত্র, ব্যক্তিগত খুঁটিনাটি এবং বিদেশি হলে পূর্বের একাউন্ট বা লেনদেনের ইতিহাস জানতে চাওয়া হয় কিন্তু সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে অর্থ জমা রাখতে হলে গ্রাহকের অর্থের উৎস নিয়ে কোনো প্রশ্নই করা হয় না। ন্যূনতম ১৮ বছর এবং একটি বৈধ পাসপোর্ট, শুধুমাত্র এই দু’টি জিনিস থাকলেই সুইজারল্যান্ডের একটি ব্যাংকে অর্থ জমা রাখা যায়। এরকম কোনো বাধ্যবাধকতা নেই যে গ্রাহককে খুব উচ্চবিত্ত বা আভিজাত্যপূর্ণ হতে হবে। মাত্র ৫ হাজার সুইস ফ্রাঁ থাকলেই যে কেউ একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে পারে। সুইস ব্যাংকিং ব্যবসায় আফ্রিকার স্বৈরশাসক বা ল্যাটিন মাদক সম্রাট সকলকেই চিহ্নিত করা হয় একটি অদ্বিতীয় নাম্বার দিয়ে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সুইস ব্যাংকের দুনিয়াজুড়ে খ্যাতির তুলনায় কুখ্যাতি হয়ত বেশি। আইনের সুযোগ নিয়ে সুইস ব্যাংকগুলো হয়ে উঠেছে কর ফাঁকির স্বর্গ।
অনেকেরই ধারণা সুইস আইন তৈরি করা হয়েছে কালো টাকার মালিকদের জন্য। এটি কিন্তু একদম ভুল তবে হ্যাঁ এটা সত্য লুকোচুরির এই আইনের ব্যবহার করে যাচ্ছে আমেরিকার ধনকুবের থেকে শুরু করে তামাম এশিয়ার কর ফাঁকিবাজরা। সুইসরা তাদের ব্যাংকিং ঐতিহ্য ধরে রাখতে যেমন তৎপর তেমনি অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোও চাপ দিয়ে সুইসদেরকে তাদের আইন সংস্কার করাতেও তৎপর। ইতিমধ্যে সুইস ব্যাংক ইউরোপ এবং এর বাইরের কিছু দেশের সাথে পূর্ণ মাত্রায় তথ্য বিনিময় শুরু করেছে। তাহলে কি সুইস ব্যাংকের গোপনীয়তার অধ্যায় শেষ হতে চলেছে? সত্যি কথা বলতে সময়ই সেটা বলে দেবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৫৪
আপনার মতামত জানানঃ