বিশ্ববাসীর চোখ এখন ইউরোপের পূর্ব সীমান্তে। সেখানে ইউক্রেনকে ঘিরে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া। যেকোনো সময় পারমাণবিক অস্ত্রের মালিক এ দুই পরাশক্তি যুদ্ধে জড়াতে পারে। পাল্টাপাল্টি বক্তব্য ও হুঁশিয়ারিতে কাটছে একেকটি দিন। উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। তবে কি ২০২২ সালে আরেকটি বড় যুদ্ধ দেখবে বিশ্ববাসী? এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে অনেকের মনে।
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বিশ্ব অঙ্গনে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হয়ে উঠেছে রাশিয়া-ইউক্রেন দ্বন্দ্ব। পশ্চিমাদের দাবি, রাশিয়া যেকোনো সময় ইউক্রেন আক্রমণ করতে পারে। এ সংঘাত ঠেকাতে এরই মধ্যে পূর্ব ইউরোপে সেনা মোতায়েন বাড়িয়েছে ন্যাটো সদস্যরা। ইউক্রেন সীমান্তে আনাগোনা বেড়েছে রুশ সেনাদের। অস্ত্র হাতে প্রস্তুত হচ্ছে ইউক্রেনের সাধারণত মানুষও। ফলে গোটা বিশ্বের নজর এখন সাবেক সোভিয়েত দেশটিতে।
তবে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এর আগে জানায়, মহড়া শেষে ইউক্রেন সীমান্ত থেকে কিছু সেনা ঘাঁটিতে ফিরিয়েছে তারা। তাছাড়া ইউক্রেনের কয়েকটি এলাকায় এরই মধ্যে গোলাবর্ষণের ঘটনা ঘটছে। তাই পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতি হচ্ছে। সব কিছু ছাপিয়ে এর প্রভাব পড়েছে সারাবিশ্বে। ইউরোপের পাশাপাশি নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়েছে এশিয়াও। শনিবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) নিক্কেই এশিয়ার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সংকট গভীর হওয়ায় জাপানসহ এ অঞ্চলের প্রধান দেশগুলোর ভূ-রাজনৈতিক ও অন্যান্য প্রভাব বিশ্লেষণ করা উচিত। একই সঙ্গে নীতিগুলো সামঞ্জস্য করা উচিত।
জানা গেছে, এরই মধ্যে জাপান রাশিয়ার ওপর সম্ভাব্য অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার প্রভাবসহ কয়েকটি বিষয়ে আলোচনা শুরু করেছে। তাছাড়া জ্বালানি সরবরাহ স্থিতিশীল রাখার বিষয়েও আলোচনা করছে দেশটি।
ইউক্রেনে হামলার ফলে যুক্তরাষ্ট্র যদি রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় তাহলে এশিয়ায় চ্যালেঞ্জ আরও বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে একটি উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্কের কারণে এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপে সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়ার জন্যও প্রস্তুত হতে হবে টোকিওকে। ইউক্রেন সংকট চীনের বিপরীতে জাপান ও মার্কিন প্রতিরক্ষা কৌশলকেও জটিল করে তুলতে পারে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এশিয়ায় নৌ ও আকাশ পথে চীনের সক্ষমতা এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে গেছে। ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থায় শ্রেষ্ঠত্বের কারণে চীন অনেক এগিয়ে যাবে। যা তাইওয়ান প্রণালীর পাশাপাশি পূর্ব ও দক্ষিণ চীন সাগরের স্থিতিশীলতাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
এশিয়ায় নৌ ও আকাশ পথে চীনের সক্ষমতা এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে গেছে। ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থায় শ্রেষ্ঠত্বের কারণে চীন অনেক এগিয়ে যাবে। যা তাইওয়ান প্রণালীর পাশাপাশি পূর্ব ও দক্ষিণ চীন সাগরের স্থিতিশীলতাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
এদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন উত্তেজনা এশিয়া ও ইউরোপ মহাদেশের বড় বাজার গুলোতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। সোমাবার এশিয়ার প্রায় সব বড় বাজার বন্ধ হয়েছে সূচকের বড় ধরণের পতনের মাধ্যমে। যা মূলত পণ্যের দামকে প্রভাবিত করেছে।
রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে সংকট নিয়ে শুক্রবার মার্কিন কর্মকর্তাদের বক্তব্যের পর, সপ্তাহান্তে নেয়া কূটনৈতিক পদক্ষেপ বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়াতে যথেষ্ট ছিল না।
ফলে পণ্যের দাম সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ স্তরে উঠেছে। এই পরিস্থিতি অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারকে প্রভাবিত করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এই অঞ্চলের ব্লু-চিপ কোম্পানি গুলো ‘দ্য এশিয়া ডাও’ এর অন্তর্ভুক্ত। সোমবার এটি ৪৭.৫৮ পয়েন্ট কমে ৩ হাজার ৭৪৪ পয়েন্টে বন্ধ হয়েছে।
টোকিওর নিককি ২২৫ স্টক এক্সচেঞ্জ ৬১৬.৫ পয়েন্ট কমে ২৭ হাজার ০৭৯ পয়েন্টে পৌঁছেছে।
হংকং স্টক এক্সচেঞ্জের ব্লু-চিপ স্টক ট্রেডিংয়ে থাকা ‘হ্যাং সেং’-এর ইনডেক্স ৩৫০ পয়েন্ট কমে ২৪ হাজার ৫৫৬ পয়েন্টে দাড়িয়েছে।
চীনের সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জ ৩৪ পয়েন্ট কমে ৩ হাজার ৪২৮ পয়েন্টে নেমেছে।
ভারতীয় সেনসেক্স বেঞ্চমার্ক ১ হাজার ৭৪৭ পয়েন্ট কমে ৫৬ হাজার ৪০৫ পয়েন্টে বন্ধ হয়েছে। এবং সিঙ্গাপুর ৭.৭৫ পয়েন্ট হারিয়ে ৩ হাজার ৪২১ পয়েন্টে পৌঁছেছে।
কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, মস্কো ও কিয়েভের মধ্যে যদি নতুন একটা যুদ্ধ শুরু হয়, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে কি খাদ্যঘাটতি দেখা দেবে? রাশিয়া ও ইউক্রেন বিশ্বের বড় দুটি শস্য রপ্তানিকারক দেশ। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, দেশ দুটি যে পরিমাণ গম রপ্তানি করে, তা বিশ্বের মোট উৎপাদিত গমের (২০৬ দশমিক ৯ মিলিয়ন মেগা টন) চার ভাগের একভাগ।
ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে যদি সত্যি সত্যি সংঘাত শুরু হয় এবং তাতে করে যদি বৈশ্বিক খাদ্য সরবরাহব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হয়, তাহলে বড় দুই গম আমদানিকারক দেশ তুরস্ক ও মিসরকে বড় ধরনের খাদ্যসংকটে পড়তে হবে।
২০১৪ সালের পর থেকে পূর্ব ইউরোপে স্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করেছে। এরপরও ২০২১ সালে বিশ্বের খাদ্যপণ্যের দাম আগের বছরের চেয়ে ৩০ শতাংশ বেড়েছে। গত বছরের গ্রীষ্মে চাষ করা বেশির ভাগ খাদ্যশস্য এরই মধ্যে রপ্তানি করে ফেলেছে ইউক্রেন। রাশিয়ার আগ্রাসন শুরু হলে এ বছর চাষাবাদ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। জ্বালানিমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও বাণিজ্য বিধিনিষেধের কারণে দেশ দুটির কৃষকেরা সারসংকটে পড়ায় এখনই বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন।
সামরিক আগ্রাসনের কারণে যদি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় মিত্ররা রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়, তাহলে রাশিয়া থেকে পশ্চিম এশিয়ায় খাদ্য সরবরাহ সীমিত হয়ে আসবে। তখন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় ইউক্রেনের গমের চাহিদা বাড়বে। ইউক্রেনের খাদ্যশস্যের বাজার সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যে সম্প্রসারিত হয়েছে। খাদ্যশস্য উৎপাদনে ইউক্রেনের এ সক্ষমতা অবশ্য নতুন নয়। সোভিয়েত জমানায় অভ্যন্তরীণ শস্যের বড় সরবরাহকারী ছিল ইউক্রেন। এখন ব্ল্যাক সি অঞ্চলে আরেকটি যুদ্ধ বাধলে ইউক্রেনের শস্য উৎপাদনসক্ষমতাতেই শুধু প্রভাব ফেলবে না, তাদের গম ও খাদ্যশস্য সরবরাহের সামর্থ্যও কমবে। লেবানন, মিসর, ইয়েমেন, ইসরায়েল ও ওমান—যারা ইউক্রেনের খাদ্যশস্যের প্রধান ক্রেতা, তাদের ওপর এ ঘটনায় বড় প্রভাব পড়বে। লেবানন ও ইয়েমেন ইতিমধ্যে খাদ্যনিরাপত্তার ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। খাদ্য সরবরাহব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হলে দেশ দুটিতে বড় মানবিক বিপর্যয় হতে বাধ্য।
আরব উপসাগরীয় দেশগুলোতেও এর প্রভাব পড়বে। ২০২০ সালে ইউক্রেন থেকে মুরগি আমদানি করা দেশগুলোর শীর্ষ ১১টির মধ্যে ৫টিই ছিল মধ্যপ্রাচ্যের। ইউক্রেনের মুরগির মাংসনির্ভর খাদ্যপণ্যের প্রধান ক্রেতা কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরব।
বিশ্বে রাশিয়া শুধু অস্ত্র ও জ্বালানি রপ্তানি করে, এমন একটা ধারণা সবার মধ্যে আছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে রাশিয়া এখন অনেক বড় খাদ্য রপ্তানিকারক দেশ।
যদি পশ্চিমারা রাশিয়ার খাদ্যপণ্য রপ্তানির ওপর নিষেধজ্ঞা দেয় কিংবা আন্তর্জাতিক লেনদেনব্যবস্থা সুইফট থেকে দেশটির ব্যাংকগুলোকে বাদ দিয়ে দেয়, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে খাদ্যের দাম রকেটগতিতে বাড়তে থাকবে। বিশ্বের ষষ্ঠ গম রপ্তানিকারক দেশ ইউক্রেন যদি তাদের দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন এবং সেগুলো রপ্তানি করতে না পারে, তাহলেও বিশ্ব খাদ্যনিরাপত্তায় হুমকি তৈরি হবে।
ইউক্রেন নিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে। পরিস্থিতি ঘোলাটে করার জন্য একে অপরকে দায়ী করলেও দুই দেশই নিজেদের মধ্যে কোনো সংঘাত চায় না। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও বলেছেন, ক্রিমিয়া ইস্যুতে নিজের নাগরিকদের উদ্ধারেও সেনা পাঠাতে চায় না দেশটি। কারণ যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া যদি একে অপরকে গুলি করতে শুরু করে তবে তা হবে বিশ্বযুদ্ধ।
আপাতদৃষ্টিতে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার পারমাণবিক যুদ্ধের সম্ভাবনা ক্ষীণ হলেও গবেষকরা আগে থেকেই বোঝার চেষ্টা করে আসছেন, ঠিক কী হবে যদি দুই দেশ পারমাণবিক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।
২০১৯ সালে ইনডিপেনডেন্ট ইউকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির গবেষকরা সায়েন্স অ্যান্ড গ্লোবাল সিকিউরিট প্রোগ্রামের (এসজিএস) আওতায় এক গবেষণায় সিম্যুলেশন কাজে লাগিয়ে দেখতে পেয়েছেন, ন্যাটো ও রাশিয়ার সর্বাত্মক পারমাণবিক যুদ্ধে প্রথম ঘণ্টায়ই প্রাণ হারাবে ৩ কোটি ৪০ লাখ মানুষ এবং আহত হবে প্রায় ৫ কোটি ৭০ লাখ। তবে তেজস্ক্রিয় বিকিরণে অসুস্থ হওয়া কিংবা মৃত্যুবরণ করা, দীর্ঘ মেয়াদে এর প্রভাবের কারণে মারা যাওয়াকে এর মধ্যে বিবেচনা করা হয়নি।
ইউক্রেন সীমান্তে দীর্ঘদিন ধরেই প্রায় এক লাখ সেনাসদস্য মোতায়েন রেখেছে প্রতিবেশী রাশিয়া। এর মধ্যে ট্যাংক ও কামানসহ যুদ্ধবিমানের বহরও ইউক্রেন সীমান্তে পাঠিয়েছে দেশটি। যেকোনো মুহূর্তে রুশ সেনারা দেশটিতে আক্রমণ করতে পারে বলেও আশঙ্কা রয়েছে। যদিও ইউক্রেনে হামলার কোনো পরিকল্পনা নেই বলে বরাবরই দাবি করে আসছে মস্কো।
তবে যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই বলছে যে, যেকোনো মুহূর্তে ইউক্রেনে হামলা করে বসতে পারে রাশিয়া। একই আশঙ্কা প্রকাশ করছে ওয়াশিংটনের অন্যান্য মিত্র দেশগুলোও। এই পরিস্থিতিতে গত মঙ্গলবার রাশিয়া জানায়, সামরিক মহড়া শেষে ইউক্রেনে সীমান্ত থেকে ঘাঁটিতে ফিরতে শুরু করেছে রুশ সেনারা।
কিন্তু পশ্চিমা দেশের কর্মকর্তারা বলছেন, মস্কোর এই দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ তারা পাননি। বরং ইউক্রেন সীমান্তে সেনা সংখ্যা আরও বাড়িয়েছে মস্কো। অবশ্য ইউক্রেনে হামলার কোনো পরিকল্পনা নেই বলে বরাবরই দাবি করে আসছে মস্কো। এছাড়া রুশ সেনারা ওই অঞ্চলে সামরিক মহড়া চালাচ্ছে বলেও জানিয়েছে রাশিয়া।
এই পরিস্থিতিতে গত সপ্তাহে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে রুশ সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং ইউক্রেনের সেনাদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। সংঘর্ষের তৃতীয় দিনে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হামলায় শনিবার দুই ইউক্রেনীয় সেনা নিহতের কথা জানানো হয়।
এছাড়া ইউক্রেন সরকার এবং রুশপন্থি বিদ্রোহীদের মধ্যে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ায় শুক্রবার এই দুই স্বঘোষিত প্রজাতন্ত্র থেকে বাসিন্দাদের রাশিয়ায় সরিয়ে নেওয়া শুরু হয়েছে। লুহানস্ক ও দোনেতস্ক থেকে আসা মানুষদের রাশিয়ায় আশ্রয় ও খাবারের ব্যবস্থা করার নির্দেশ দিয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩১৮
আপনার মতামত জানানঃ