মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের বাস্তুচ্যুত হওয়ার অন্যতম কারণ ছিল দেশটির সেনাবাহিনীর ওপর হামলা। ওই হামলার সঙ্গে জড়িত ছিল আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা)। এখন তারা বাংলাদেশেও আধিপত্য বিস্তার করছে। এছাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরে মাদক বিক্রি, মানবপাচার, অপহরণের পর মুক্তিপণ আদায়, ডাকাতি ও মাদকের টাকায় আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহের কাজ করছে ‘আল-ইয়াকিন’। এই বাহিনী বাংলাদেশিদের অপহরণ করে নির্জন পাহাড়ে নিয়ে যায়। এরপর হাত-পা ও চোখ বেঁধে চলে নির্মম নির্যাতন। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দাবিকৃত টাকা পেলে ছেড়ে দেওয়া হয়, না হলে পাহাড়ে গর্ত করে পুঁতে ফেলে। কক্সবাজারে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) নামেও এরা পরিচিত। কক্সবাজারবাসী এদের ‘জঙ্গি বাহিনী’ বলেও আখ্যা দিয়েছেন।
রোহিঙ্গাদের দুর্গতি পুঁজি করে ক্যাম্পগুলোতে শক্ত ঘাঁটি বানিয়েছে জঙ্গিরা। ৩৪ টি ক্যাম্পের সাড়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে লুকিয়ে আছে ১৪টি সশস্ত্র জঙ্গি গোষ্ঠীর প্রায় ৫ হাজার সক্রিয় ক্যাডার। এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন রোহিঙ্গা প্রতাবাসন সংগ্রাম কমিটির সভাপতি উখিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী।
গত বছর অক্টোবরে রোহিঙ্গা নেতা মুহিব উল্লাহ এবং ৬ রোহিঙ্গা নাগরিককে হত্যার পর, প্রত্যাবাসন বিরোধী জঙ্গী সংগঠন আরসা তাদের অবস্থান আরো শক্ত করেছে।
মুহিব উল্লাহর ভাই হাবিব উল্লাহ বলেন, আরসা কর্মীরা ক্যাম্পে বিভিন্ন ধরনের অপরাধে জড়িত। রাতের বেলায় পুরো ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় তারা। রোহিঙ্গারা তাদের চেনে কিন্তু তারা প্রকাশ্যে কিছু বলতে ভয় পায়।
ক্যাম্পের বাসিন্দারা জানান, মাদক পাচার থেকে শুরু করে চাঁদাবাজি, ত্রাণ সামগ্রী মজুত সবকিছুই আরসার নিয়ন্ত্রণে। তাদের মোকাবিলা করার মতো কেউ নেই এবং তারা রোহিঙ্গা শিবিরে শক্ত অবস্থান প্রতিষ্ঠা করেছে।
রোহিঙ্গাদের চিকিৎসা ও ত্রাণ সামগ্রী গ্রহণের জন্য ক্যাম্পের বাইরে যেতে হয় উল্লেখ করে এক কর্মকর্তা বলেন, তাদের কেউ কেউ এই সুযোগে মাদক ব্যবসায় লিপ্ত। এমনকি তাদের পেট থেকেও আমরা ইয়াবা উদ্ধার করেছি।
সাবেক প্রশাসনের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, আমি যতদূর জানি, মিয়ানমার বলেছে যে, রোহিঙ্গাদের মধ্যে অনেক সন্ত্রাসী আছে এবং তাদের তারা দেশে ফিরিয়ে নিতে চায় না।
এপিবিএন কর্মকর্তারা জানান, মুহিব উল্লাহকে হত্যার পর থেকে ফৌজদারি অভিযোগে পাঁচ শতাধিক রোহিঙ্গাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে অন্তত ১২১ জন আরসা সদস্য বলে দাবি করা হয়। সাধারণ রোহিঙ্গাদের বেশ কয়েকজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরসা সম্পর্কে কথা বলেছেন। কারণ তারা ভয় পায় যে, তাদের নাম জানতে পারলে আরসা এর প্রতিশোধ নেবে।
এক রোহিঙ্গা নেতা বলেন, আরসা কর্মীরা মিয়ানমার প্রশাসনের এজেন্ট হিসেবে প্রত্যাবাসনের বিরুদ্ধে কাজ করছে।
বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা বলেন, আরসা সদস্যরা রোহিঙ্গাদের অধিকারের জন্য লড়াই করার দাবি করেছিলেন এবং অনেক সাধারণ মানুষ প্রাথমিকভাবে তাদের বিশ্বাস করেছিলেন। কিন্তু এখন রোহিঙ্গারা বিশ্বাস করেন, আরসা মিয়ানমার সরকারের এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে এবং তাদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তনে বাধা দিচ্ছে।
আরেক রোহিঙ্গা নেতা আবদুর রহমান বলেন, পরিস্থিতি এতটাই ভীতিকর যে আমরা আমাদের বাড়িতে ফিরতে চাই এটা প্রকাশ্যে বলতে পারি না। যারা প্রত্যাবাসনের কথা বলছেন তাদের হত্যা করা হচ্ছে।
২০১৭ সাল থেকে মুহিব উল্লাহ, আরিফ উল্লাহ, আবদুর রহিম, নূরে আলম, হামিদ উল্লাহর মতো জনপ্রিয় নেতাসহ আরো ৫০ জন রোহিঙ্গা নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। নিহত নেতাদের পরিবারের সদস্যরা জীবনের ভয়ে আত্মগোপনে আছেন।
বালুখালী ক্যাম্পের নুর কামাল বলেন, আরসা মিয়ানমার সরকারের একটি সন্ত্রাসী সংগঠন। তারা এই নাটক মঞ্চস্থ করে ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ঠেলে দিয়েছে। এখন তারা প্রত্যাবাসনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির চেষ্টা করছেন।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি) ২০১৬ সালে এক প্রতিবেদনে বলেছে, সৌদি আরবে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের নেতৃত্বে এই গ্রুপের নেতৃত্ব দেওয়া হয়েছে। আইসিজি বলছে আরসা নেতা আতাউল্লাহ, পাকিস্তানে জন্মগ্রহণ করেছেন এবং সৌদি আরবে বেড়ে উঠেছেন।
মাদক পাচার থেকে শুরু করে চাঁদাবাজি, ত্রাণ সামগ্রী মজুত সবকিছুই আরসার নিয়ন্ত্রণে। তাদের মোকাবিলা করার মতো কেউ নেই এবং তারা রোহিঙ্গা শিবিরে শক্ত অবস্থান প্রতিষ্ঠা করেছে।
আতাউল্লাহর অবস্থান নিয়ে বিভ্রান্তি থাকলেও রোহিঙ্গারা বিশ্বাস করেন তিনি আরাকানে থাকেন এবং সেখান থেকে তিনি তার অনুসারীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন।
কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে বেশ কয়েকটি জঙ্গি সংগঠন সক্রিয়। তবে সব চেয়ে বেশি বিচরণ করছে ‘আরসা’। বাংলাদেশের ৩২টি রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পের মধ্যে ২৭টিতেই রয়েছে আরসার একক আধিপত্য।
সৌদি আরবে বেড়ে ওঠা পাকিস্তানি নাগরিক আবু আম্মর জুনুনি ওরফে আতাউল্লাহ বর্তমানে আরসার একটি অংশের নেতৃত্বে রয়েছে। আতাউল্লার নেতৃত্বাধীন আরসা পাঁচটি শ্রেণিতে বিভক্ত করে শরণার্থী ক্যাম্পে তৎপরতা চালাচ্ছে। এ শ্রেণিগুলি হচ্ছে- ‘ওলামা কাউন্সিল’, ‘ওলামা বোর্ড’, ‘মজলিসে আম’ এবং ‘আরকান আরমট’। তারা শরণার্থী ক্যাম্পে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি কিশোরী-তরুণী থেকে মাদক ও মানব পাচার, ডাকাতি অস্ত্র ব্যবসা, চাঁদাবাজি-সহ নানান অপকর্মে জড়িয়ে পড়েছে। পাশাপাশি ক্যাম্পে নিজেদের অবস্থান আরও সুসংহত করতে নিজস্ব মুদ্রা চালু করেছে।
আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) আগে ইংরেজীতে ‘ফেইথ মুভমেন্ট’ নামে তাদের তৎপরতা চালাতো। স্থানীয়ভাবে এটি পরিচিত ছিল ‘হারাকাহ আল ইয়াকিন’ নামে। মিয়ানমারের সরকার রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মিকে একটি সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী বলে ঘোষণা করে।
মিয়ানমারের সূত্র মতে, এই গ্রুপটির নেতৃত্বে রয়েছে রোহিঙ্গা জিহাদীরা, যারা বিদেশে প্রশিক্ষণ পেয়েছে। তবে সংগঠনটি কত বড়, এদের নেটওয়ার্ক কতটা বিস্তৃত, তার কোন পরিস্কার ধারণা তাদের কাছেও নেই।
আরাকানে যারা এই সংগঠনটির সঙ্গে যুক্ত, তাদের আধুনিক গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ আছে বলে মনে করা হয়। স্থানীয় রোহিঙ্গাদের মধ্যে এই সংগঠনটির প্রতি সমর্থন এবং সহানুভূতি আছে।
আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বা ‘আরসা’ ২০১৭ সালের মার্চে এক বিবৃতিতে একেবারে খোলাখুলিই জানিয়েছিল, তারা মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের অধিকার রক্ষায় কাজ করছে এবং তাদের ‘আত্মরক্ষা-মূলক’ হামলার মূল টার্গেট হচ্ছে মিয়ানমারের ‘নিপীড়নকারী শাসকগোষ্ঠী’।
আরসার প্রধান দাবি হচ্ছে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের নাগরিকত্ব এবং সমান মর্যাদা দিতে হবে। ‘আরসা’ তাদের এই বিবৃতিতে আরও জানায়, তারা বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে কোন ধরণের সন্ত্রাসবাদী কাজে লিপ্ত নয়। তাদের অধিকার আদায়ের জন্যও তারা সন্ত্রাসবাদে বিশ্বাসী নয়। বিশ্বের কোন সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গেও তাদের কোন সম্পর্ক নেই। এমনকি তারা রাখাইনের বিভিন্ন ধর্মের ও জাতির মানুষকে এবং তাদের ধর্মীয় উপাসনার স্থানের নিরাপত্তার নিশ্চয়তাও দিচ্ছে।
সূত্র মতে, বর্তমানে আল-ইয়াকিনের প্রায় দুই হাজার সদস্য রয়েছে কক্সবাজারে। দেড়শ’র মতো নারী সদস্যও রয়েছে তাদের। কক্সবাজার ও টেকনাফের প্রতিটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে তারা। তবে কুতুপালং ও বালুখালিতে তাদের সদস্য সংখ্যা বেশি।
কক্সবাজার পুলিশের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, গত কয়েক বছরে আল-ইয়াকিনের হাতে কমপক্ষে ২৫ রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি নাগরিক খুন হয়েছেন। প্রায়ই স্থানীয়দের (বাংলাদেশি) অপহরণ করে তারা। নির্জন পাহাড়ে নিয়ে মুক্তিপণ আদায়ের সংবাদও শোনা যায়। ভুক্তভোগী এমন বেশ কয়েকটি পরিবারের অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ পাহাড়ে অভিযান চালায়। তবে এখন পর্যন্ত এ চক্রের একজন সদস্যকেও গ্রেফতার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
বিশ্লেষকরা বলেন, ‘সরকারের উচিত মাথাচাড়া দেওয়ার আগে রোহিঙ্গা জঙ্গি সংগঠনগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা। নইলে এসব সংগঠন বাংলাদেশের জন্য হুমকি হয়ে উঠবে।’
রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ এখনও কঠোর অবস্থান না নিলে পরিস্থিতি আরও জটিল হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোকে ঘিরে নানা ধরনের সন্ত্রাসী ও জঙ্গি তৎপরতা, দেশি-বিদেশি বিভিন্ন গোষ্ঠীর উস্কানি ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের খবর ইতোমধ্যেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে আসতে শুরু করেছে। এসব অপতৎপরতা দীর্ঘমেয়াদে এই অঞ্চলের জন্য হুমকি হয়ে উঠবে।
আরও বলেন, এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে রোহিঙ্গা ক্যাম্পকে আরও বেশি গোয়েন্দা নজরদারির আওতায় আনা এবং তাদের প্রত্যাবাসনে যথাযথ ভূমিকা গ্রহণ করতে সরকারের সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫১০
আপনার মতামত জানানঃ