বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের পর খাদ্যমূল্য ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। ভোজ্যতেল, খাদ্যশস্য, চিনি, আমিষ ও দুগ্ধপণ্যের মতো জরুরি খাদ্যের প্রায় সবের দামই বাড়তির দিকে। এভাবে খাদ্যমূল্যের বৃদ্ধি হতদরিদ্রদের জরুরি খাদ্য চাহিদ পূরণের পথে প্রতিবন্ধক হয়ে উঠেছে। জাতিসংঘ সম্প্রতি জানিয়েছে, করোনাভাইরাসের প্রভাবে বিশ্বে হতদরিদ্রের সংখ্যা ৪০ শতাংশ বেড়ে গেছে। এসব মানুষের খাদ্য ও জরুরি চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে তারা। এর মধ্যেই জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) জানাল, বিশ্বজুড়ে গত ছয় মাস ধরেই খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ছে। তবে গত নভেম্বর মাসে যতটা বেড়েছে, ছয় বছরের মধ্যে এমনটা দেখা যায়নি। প্রতি মাসে খাবারের দাম সারা বিশ্বে কিভাবে ওঠানামা করে, তার হিসাব রাখে জাতিসংঘের এই সংস্থাটি।
এফএও বলছে, করোনা মহামারীর শুরুর দিকে বিশ্বজুড়ে খাবারের দাম তুলনামূলক কম ছিল। সময় যত গড়িয়েছে, খাদ্যপণ্যের দাম ততই লাগামহীনভাবে বেড়েছে। প্রতি মাসেই আগের মাসের তুলনায় খাবার কেনায় বাড়তি অর্থ গুনতে হচ্ছে বিশ্ববাসীকে। সংস্থাটি যে হিসেব হাজির করে সে অনুযায়ী, গত নভেম্বরে খাদ্যপণ্যের বৈশ্বিক গড় মূল্যসূচক আগের মাসের তুলনায় ৩ দশমিক ৯ শতাংশ বেড়ে গেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্বজুড়ে হতদরিদ্র ৩০ কোটি মানুষ এবং আরো প্রায় ৩০০ কোটি নিম্নবিত্তের খাদ্য তালিকায় কাটছাঁট শুরু হয়ে গেছে অনেক আগেই। নভেম্বর মাসের খাদ্যমূল্য বলছে, জরুরি অনেক খাবারই এখন তাদের নাগালের বাইরে।
এফএও’র মাসিক ফুড প্রাইস ইনডেক্সে বলা হয়েছে, চলতি বছরের নভেম্বরে খাদ্যপণ্যের বৈশ্বিক গড় মূল্যসূচক দাঁড়িয়েছে ১০৫ পয়েন্টে, যা আগের মাসের তুলনায় ৪ শতাংশীয় পয়েন্ট বা ৩ দশমিক ৯ শতাংশ বেশি। শুধু আগের মাসের তুলনায় নয়, বরং গত বছরের একই সময়ের তুলনায় চলতি বছরের নভেম্বরে খাদ্যপণ্যের বৈশ্বিক গড় মূল্যসূচক ৬ দশমিক ৫ শতাংশ বেড়েছে। করোনা মহামারীর মধ্যে এটাই খাদ্যপণ্যের সর্বোচ্চ বৈশ্বিক মূল্যসূচক। একই সঙ্গে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরের পর এটাই এ সূচকের সর্বোচ্চ রেকর্ড।
২০২০ সালের শুরুটাও বাড়তি দামে খাবার কেনার মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল। টানা পতন কাটিয়ে জুনে ঘুরে দাঁড়ায় খাদ্যপণ্যের বৈশ্বিক গড় মূল্যসূচক। ওই মাসে খাদ্যপণ্যের বৈশ্বিক গড় মূল্যসূচক ছিল ৯৩ দশমিক ১ পয়েন্ট। এর পর থেকে সূচকমানে আর মন্দাভাব দেখা যায়নি। দাম বেড়েই চলেছে। টানা চাঙ্গা ভাবের ধারাবাহিকতায় অক্টোবরে তা আরো বেড়ে দাঁড়ায় ১০০ দশমিক ৯ পয়েন্টে, যা আগের মাসের তুলনায় ৩ শতাংশীয় পয়েন্ট বা ৩ দশমিক ১ শতাংশ বেশি। প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় গত মাসে খাদ্যপণ্যের বৈশ্বিক গড় মূল্যসূচক আরো বেড়ে প্রায় ছয় বছরের সর্বোচ্চে উন্নীত হয়েছে।
চলতি বছরের নভেম্বরে বিশ্বজুড়ে সব ধরনের খাবারের দাম বাড়তির পথে ছিল। এফএও ফুড প্রাইস ইনডেক্স অনুযায়ী, এ সময় ভোজ্যতেলের বৈশ্বিক গড় মূল্যসূচক দাঁড়িয়েছে ১২১ দশমিক ৯ পয়েন্টে, যা আগের মাসের তুলনায় ১৫ দশমিক ৪ শতাংশীয় পয়েন্ট বা ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ বেশি। ২০১৪ সালের মার্চের পর গত মাসে বিশ্ববাজারে সবচেয়ে বেশি দামে বিক্রি হয়েছে ভোজ্যতেল। করোনা মহামারীর দীর্ঘসূত্রিতায় পাম অয়েল ও সয়াবিন তেলের উৎপাদন নিয়ে সংকটে পড়েছেন শীর্ষ উৎপাদনকারীরা। চাহিদা কমে আসার আশঙ্কা করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। এ প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক বাজারে দুই ধরনের ভোজ্যতেলের দাম বাড়তির পথে রয়েছে।
করোনাকালে বিশ্বজুড়ে শস্যের চাহিদা বাড়তির দিকে। চীনও ভুট্টা, গম, চালসহ বিভিন্ন শস্যের আমদানি বাড়িয়েছে। অনেক দেশ সংকটকালীন পরিস্থিতি সামাল দিতে বাড়তি শস্য মজুদ করছে। এসব কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে চাল, গমসহ বিভিন্ন শস্যের দাম বেড়েছে। ছয় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ দামে বিক্রি হচ্ছে ভুট্টা। এর ঊর্ধ্বমুখী প্রভাব পড়েছে খাদ্যশস্যের বৈশ্বিক গড় মূল্যসূচকে।
নভেম্বরে বাড়তির পথে ছিল দুগ্ধপণ্যের দাম। এফএওর তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের নভেম্বরে দুগ্ধপণ্যের বৈশ্বিক গড় মূল্যসূচক ১০৫ দশমিক ৩ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে, যা আগের মাসের তুলনায় দশমিক ৯ শতাংশীয় পয়েন্ট বা দশমিক ৯ শতাংশ বেশি। এর মধ্য দিয়ে গত ১৮ মাসের সর্বোচ্চে উন্নীত হয়েছে দুগ্ধপণ্যের গড় দাম। টানা ছয় মাস ধরে বিশ্ববাজারে দুগ্ধপণ্যের দামে চাঙ্গা ভাব বজায় রয়েছে।
একই চিত্র দেখা গেছে চিনির দামেও। চলতি বছরের নভেম্বরে চিনির বৈশ্বিক গড় মূল্যসূচক ৮৭ দশমিক ৫ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে বলে প্রতিবেদনে জানিয়েছে এফএও, যা আগের মাসের তুলনায় ২ দশমিক ৮ শতাংশীয় পয়েন্ট বা ৩ দশমিক ৩ শতাংশ বেশি। টানা দুই মাস ধরে চিনির দাম বাড়তির দিকে রয়েছে।
এদিকে গত মাসে আমিষপণ্যের বৈশ্বিক গড় মূল্যসূচক আগের মাসের তুলনায় দশমিক ৮ পয়েন্ট বা দশমিক ৯ শতাংশ বেড়ে ৯১ দশমিক ৯ পয়েন্টে উন্নীত হয়েছে। শুধু আগের মাসের তুলনায় নয়, বরং গত বছরের একই সময়ের তুলনায় চলতি বছরের নভেম্বরে আমিষপণ্যের বৈশ্বিক গড় মূল্যসূচক ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ বেড়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারির পর গত মাসে প্রথম আমিষপণ্যের এ সূচকমানে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা গেছে।
এসডাব্লিউ/বিবি/আরা/১৮২০
আপনার মতামত জানানঃ