আবারও আলোচনায় ত্বকী হত্যায় জড়িত কুখ্যাত আজমেরী ওসমান। নারায়ণগঞ্জের আলোচিত ত্বকী হত্যাকাণ্ড নিয়ে সংবাদ প্রকাশের জেরে অর্ধশতাধিক মোটরসাইকেল নিয়ে মহড়া দিয়ে দৈনিক সময়ের পত্রিকা কার্যালয়ে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। আজমেরী ওসমানের অনুসারীরা এই হামলা চালিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছে পত্রিকা কর্তৃপক্ষ।
২০১৩ সালের ৬ মার্চ নগরীর শায়েস্তা খাঁ রোডের বাসা থেকে বের হওয়ার পর নিখোঁজ হয় মেধাবী ছাত্র তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী। দুই দিন পর ৮ মার্চ শীতলক্ষ্যা নদীর কুমুদিনী শাখা খাল থেকে ত্বকীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
ওই বছরের ১২ নভেম্বর আজমেরী ওসমানের সহযোগী সুলতান শওকত আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেন, আজমেরী ওসমানের নেতৃত্বে ত্বকীকে অপহরণের পর হত্যা করা হয়।
যা ঘটেছিল পত্রিকা অফিসে
শনিবার দুপুর সাড়ে ১২টায় শহরের চাষাঢ়া প্রেসিডেন্ট রোড এলাকায় সিরাজ ম্যানশনের চারতলায় অবস্থিত পত্রিকা কার্যালয়ে এই ঘটনা ঘটে।
পত্রিকাটির সাংবাদিকেরা অভিযোগ করেছেন, হামলাকারীরা সাংবাদিকদের গালাগাল করে এবং মাফ না চাইলে সম্পাদককে গুলি করে হত্যার হুমকি দিয়েছেন।
হামলার পর সেখানকার সিসি ক্যামেরা ভাঙচুর ও হার্ডডিস্ক ডিভাইস খুলে নিয়ে গেছেন সন্ত্রাসীরা। এ সময় শহরে সন্ত্রাসীদের মহড়ায় আতঙ্কের সৃষ্টি হয়।
এদিকে পত্রিকা অফিসে হামলার ঘটনার পর পুলিশ বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে আজমেরী ওসমানের অনুসারী হিসেবে পরিচিত ইব্রাহিম, লিটন দাস, শ্যামল দাস, কৃষ্ণা (২৬), আছিব, ফয়সাল, হিরাসহ ১০ জনকে আটক করা হয়েছে।
তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহজামান। তিনি বলেন, কিছু দুষ্কৃতকারী এসে হামলা চালিয়েছেন। এই ঘটনায় মামলা হবে। জড়িত অন্য ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
সময়ের নারায়ণগঞ্জ পত্রিকার নিজস্ব প্রতিবেদক আরিফ হোসাইন বলেন, শনিবার দুপুর ১২টা ২৫ মিনিটে অফিসের নিচে অর্ধশতাধিক সন্ত্রাসী মোটরসাইকেলে এসে অবস্থান নেন। তারা অফিসে ঢুকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ শুরু করেন।
শুক্রবার সময়ের নারায়ণগঞ্জ পত্রিকার প্রধান সংবাদ ছিল, ‘যা ছিল খসড়া চার্জশিটে’। সংবাদটি কেন প্রকাশ করা হয়েছে, তার কৈফিয়ত জানতে চান হামলাকারীরা।
তারা বলেন, ‘তোরা আজমেরী ওসমানের বিরুদ্ধে নিউজ করস। কালকের মধ্যে পত্রিকায় ক্ষমা না চাইলে পত্রিকা অফিস জ্বালিয়ে দেব ও সম্পাদককে গুলি করে মেরে ফেলব।’
হামলাকারীরা প্রায় ১৫ মিনিট কার্যালয়ে অবস্থান করে হুমকি দিয়ে চলে যান। এ সময় বিদ্যুতের লাইন বন্ধ করে দেন, সিসি ক্যামেরা ভাঙচুর করেন, একটি পিসির হার্ডডিস্কও খুলে নিয়ে গেছেন।
পত্রিকাটির আরেক নিজস্ব প্রতিবেদক মৃত্যুঞ্জয় রায় বলেন, হামলাকারীরা হুমকি দিয়ে বলেন, ‘তোরা সব নেশাখোর। ভাইকে (আজমেরী ওসমান) ইয়াবা আসক্ত লিখছোস কেন? তোরা ভাইয়ের (আজমেরী ওসমান) কাছে গিয়ে পায়ে ধরে ক্ষমা চাইবি, মাফ না চাইলে পত্রিকা অফিস আগুনে জ্বালিয়ে দেব।’
হামলার একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, নাসির উদ্দিনের নেতৃত্বে আক্তার নূর, সুমন, সানি, ইসমাইল, আন্নান, কাজল, রুবেল, সিনাফি, রবিন, মনির, লক্ষ্মণ, কৃষ্ণা, রাতুলসহ শতাধিক ব্যক্তি এই হামলায় অংশ নেন। নাসির উদ্দিন আজমেরী ওসমানের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। নাসির উদ্দিন ও আক্তার নূর এর আগে একাধিকবার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।
যা বললেন পত্রিকার সম্পাদক
পত্রিকা কার্যালয়ে হামলার আগে অর্ধশতাধিক মোটরসাইকেল নিয়ে হর্ন বাজিয়ে শহরে মহড়া দেন সন্ত্রাসীরা। ওই কার্যালয়ের নিরাপত্তা প্রহরী হাফিজউদ্দিন বলেন, হঠাৎ শতাধিক লোক এসে তাকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে ওপরে উঠে যান।
সময়ের নারায়ণগঞ্জ পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদক জাবেদ আহমেদ বলেন, ‘ত্বকী হত্যা নিয়ে র্যাব সংবাদ সম্মেলনে (২০০৪ সালের ৫ মার্চ) সরবরাহ করা খসড়া অভিযোগপত্র আমরা হুবহু পত্রিকায় তুলে ধরেছি। সেখানে আমাদের নিজস্ব কোনো বক্তব্য ছিল না। ওই অভিযোগপত্রে আজমেরী ওসমানকে ইয়াবা আসক্ত উল্লেখ করা হয়েছিল। এ কারণে আজমেরী ওসমানের অনুসারী ক্যাডাররা ক্ষিপ্ত হয়ে পত্রিকা অফিসে হামলা চালায়।’
সম্পাদক জাবেদ আহমেদ বলেন, কার্যালয়ের সিসি ক্যামেরা ভাঙচুর করে ডিভিআর (ডিজিটাল ভিডিও রেকর্ডার) মেশিন ও একটি পিসির হার্ডডিস্ক নিয়ে গেছেন হামলাকারীরা। এ বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) জায়েদুল আলম বলেন, বিষয়টি শুনেছি। তারা যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেবেন, তাদের বিরুদ্ধে মামলা নেওয়া হবে। জড়িত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। তিনি বলেন, এই ঘটনায় ১০ জনকে আটক করা হয়েছে। অন্য ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
কে এই আজমেরী ওসমান?
আজমেরী ওসমান প্রয়াত সাংসদ নাসিম ওসমানের ছেলে ও নারায়ণগঞ্জ-৪ (ফতুল্লা-সিদ্ধিরগঞ্জ) আসনের সাংসদ শামীম ওসমানের ভাতিজা।
নারায়ণগঞ্জ-৫ (শহর-বন্দর) আসনের জাতীয় পার্টির (জাপা) সাংসদ নাসিম ওসমানের একমাত্র ছেলে আজমেরী ওসমান গত ১৮ বছরে সংঘটিত ১২টি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এর মধ্যে বর্তমান সরকারের আমলে সংঘটিত হয় নয়টি হত্যাকাণ্ড। সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে এ তথ্য পাওয়া যায় (২০ নভেম্বর, ২০১৩; প্রথম আলো)।
একের পর এক লোমহর্ষক খুন, টর্চার সেলে অনেক মানুষকে ধরে নিয়ে অকথ্য নির্যাতন চালালেও তার বিরুদ্ধে ভয়ে তখন কেউ কোনো থানায় মামলা বা জিডি করেনি।
নারায়ণগঞ্জের মেধাবী ছাত্র তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া সুলতান শওকত ওরফে ভ্রমর আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় একটি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তাতে তিনি বলেন, ৬ মার্চ শহরের কলেজ রোডের টর্চার সেলে আজমেরী ওসমানের নেতৃত্বেই ত্বকীকে খুন করা হয়। ভ্রমর আজমেরীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পরিচিত।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০৯ সালের এপ্রিলে শহরের আমলাপাড়ায় ১৪ টুকরা লাশ পাওয়া যায়। মামলা হলেও পুলিশ এই খুনের রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেনি। ২০১১ সালে শহরের প্রেসিডেন্ট রোডে একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে জবাই করে খুন করা হয় সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালক জামালকে। অবৈধ অস্ত্র ও মাদক পরিবহনে রাজি না হওয়ায় তাকে খুন করা হয়।
এই ঘটনায় মামলা হলে র্যাব-১১-এর সদস্যরা আজমেরীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী গালপোড়া রঞ্জুকে গ্রেপ্তার করেন। সম্প্রতি জামিনে ছাড়া পাওয়া গালপোড়া রঞ্জুকে আজমেরী ওসমান কসমেটিক সার্জারি করে তার মুখমণ্ডলে পরিবর্তন আনেন।
২০১১ সালের জুনে শীতলক্ষ্যা নদীতে ব্যবসায়ী আশিক ইসলামের লাশ পাওয়া যায়। তার মুখমণ্ডল ঝলসানো ও বিকৃত এবং অণ্ডকোষ থেঁতলানো ছিল। তার ভাই বাদী হয়ে আজমেরীর ঘনিষ্ঠ দুই সহযোগী সিজার ও সিদ্দিককে আসামি করে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় মামলা করেন। আজমেরীর কথা বলে সিজার ও সিদ্দিকই আশিককে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে যান।
এরপর খুন হন টানবাজারের সুতা ব্যবসায়ী ভুলু সাহা। তার লাশও শীতলক্ষ্যা নদীতে পাওয়া যায়। চাঁদা না দেওয়ায় তাঁকে হত্যা করা হয় বলে পুলিশ প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হলেও রহস্যজনক কারণে খুনিদের আজও চিহ্নিত করতে পারেনি। মূলত শহরের ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য, যেন তারা চাওয়ামাত্রই চাঁদা দিয়ে দেন সে জন্য ভুলু সাহাকে হত্যা করা হয়।
এরপর গাবতলী এলাকার বাসিন্দা মিঠুকে শহরের জামতলা এলাকায় প্রকাশ্যে খুন করা হয়। মিঠু গাবতলী এলাকায় আজমেরীর অনুগত মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। মিঠু হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত ছিলেন আজমেরীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী ঢাকাই চলচ্চিত্রের একসময়ের জনপ্রিয় খলনায়ক আদিলের ছেলে হামীম।
খুনের সাক্ষী না রাখার জন্যই তিন দিন পরে হামীমকে কক্সবাজারে নিয়ে মদের সঙ্গে বিষ পান করিয়ে হত্যা করা হয়। সাংস্কৃতিককর্মী চঞ্চলকে খুন করা হয় গত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে শামীম ওসমানের পক্ষে কাজ না করে সেলিনা হায়াৎ আইভীর পক্ষে কাজ করার অপরাধে।
সর্বশেষ ত্বকী হত্যাকাণ্ডের পরপরই ওসমান পরিবারের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন গড়ে ওঠে। মিঠুর বাবা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা খোরশেদুল আলম বলেন, ফতুল্লা থানার তৎকালীন ওসি তাকে উল্টো ভয় দেখান আজমেরীর নাম দিলে মামলাই নেওয়া হবে না।
শুধু খুন নয়, আজমেরী ওসমানের বিরুদ্ধে ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষকে তার টর্চার সেলে ধরে এনে নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই তার বাবা নাসিম ওসমান, দুই চাচা সাবেক সাংসদ শামীম ওসমান ও বিকেএমইএ এবং নারায়ণগঞ্জ চেম্বারের সভাপতি সেলিম ওসমানের প্রশ্রয়ে আজমেরী ওসমান শহরের উত্তর চাষাঢ়ায় একটি ও কলেজ রোডে দুটি টর্চার সেল গড়ে তোলেন। সিসি ক্যামেরা দ্বারা টর্চার সেলের আশপাশের রাস্তায় পথচারী ও যানবাহন চলাচল সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধান করা হতো।
ত্বকী হত্যা মামলা তদন্তের অংশ হিসেবে র্যাব-১১-এর সদস্যরা শহরের কলেজ রোডে আজমেরী ওসমানের একটি টর্চার সেলে অভিযান চালিয়ে রক্তাক্ত জিনসের প্যান্ট, রক্তমাখা গজারির দুটি লাঠি ও বস্তায় ভর্তি নাইলনের রশি জব্দ করেন। গত ১২ নভেম্বর ভ্রমরের দেওয়া জবানবন্দিতে জানা যায়, আজমেরীর নেতৃত্বে ২০১৩ সালের ৬ মার্চ এই টর্চার সেলেই ত্বকীকে খুন করা হয়।
এসডব্লিউ/এসএস/১২২৫
আপনার মতামত জানানঃ