পশ্চিমা বিশ্বের সরকারগুলো যখন তাড়াহুড়ো করে আফগানিস্তানে থাকা তাদের দূতাবাসের কর্মী ও নাগরিকদের সরিয়ে নিচ্ছিল, সেখানে চীনের দূতাবাস তখনও খোলা ছিল৷ চীনের কর্মকর্তারা সময় হাতে রেখে সতর্কতা অবলম্বন করেছিলেন এবং তালিবানের সঙ্গে চুক্তিও করে রেখেছিলেন৷ এমনকি আগস্টে (২০২১) তালিবান আফগানিস্তানের ক্ষমতার মসনদে আসীন হওয়ার পর প্রথম দেশ হিসেবে চীন সেখানে জরুরি মানবিক সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দেয়।
যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর সৈন্য চলে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই গোটা দেশ কবজা করে নেয় তালিবান। ওই সময়ে দেশটিতে ছিল চরম খাদ্যসংকট। আর কোভিড পরিস্থিতিতে ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জামের অপ্রতুলতায় বড় ধরনের সংকটে পড়ে তালিবানের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
তালিবানের সঙ্গে চীনের সম্পর্কের সূচনা অবশ্য ১৯৯১ সালে পাকিস্তানের মধ্যস্থতায়। অবশ্য চীন এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে তালিবানকে স্বীকৃতি দেয়নি। চীন কেন, বিশ্বের কোনো দেশই তালিবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি, এমনকি তালিবানের পিতৃভূমি হিসেবে পরিচিত পাকিস্তানও নয়।
তালিবানকে কেউ স্বীকৃতি দিচ্ছে না— এটা যেমন ঠিক, স্বীকৃতি না দিয়েও সম্পর্ক রাখা হচ্ছে, সেটাও ঠিক। তালিবানকে স্বীকৃতি না দিয়েও চীনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
অর্থনৈতিক সহায়তা
এমনিতেই আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব নাজুক। এর ওপর মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোর চাপিয়ে দেওয়া অবরোধ। বিদেশের বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনপুষ্ট আশরাফ গনি সরকার আমলের যে অর্থসম্পদ ছিল, সেগুলো ওই সব দেশের সরকার জব্দ করে রেখেছে, যাতে তালিবান সরকার তা হাতে না পায়। এই সুযোগই নিয়েছে চীন। সুন্নী তালিবান দরজা কমিউনিস্ট চীনের জন্য খুলে দিয়েছে মূলত পশ্চিমা দেশগুলোর ভুল সিদ্ধান্ত।
এ মুহূর্তে অনাবৃষ্টিতে ফসলহানিতে সৃষ্ট খাদ্যসংকটের পাশাপাশি তীব্র শীতে কষ্ট পাচ্ছে আফগানবাসী। অনেক জায়গায় মানুষজন দিনে একবেলা খেয়ে দিনাতিপাত করছে। যুদ্ধে বিধ্বস্ত আফগানিস্তানের অর্থনীতি পুরোপুরি বিদেশি সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। গনি সরকারের বাজেটের চার ভাগের তিন ভাগ ছিল বিদেশি সহায়তাপুষ্ট। এমন সংকটকালে চীনের কাছ থেকে ৩১ মিলিয়ন ডলারের মানবিক সহায়তা তালিবানের জন্য অনেক বড় কিছু। এরই মধ্যে চীন প্রতিশ্রুত সহায়তার অর্ধেক আফগানিস্তানকে বুঝিয়েও দিয়েছে।
মানবিক সহায়তার পাশাপাশি চীন তালিবান প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে। আগস্টের পর থেকে দুই পক্ষই বৈঠক করেছে একাধিকবার। সর্বশেষ গত ৩০ ডিসেম্বর কাবুলে চীনের রাষ্ট্রদূত ওয়াং ইয়ু তালিবানের অন্তর্বর্তী সরকারের ভারপ্রাপ্ত উপপ্রধানমন্ত্রী মোল্লা আবদুল গনি বারাদারের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।
মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি এসব আলোচনায় বারবার এসেছে আফগানিস্তান পুনর্গঠনের বিষয়। একই সঙ্গে চীন পশ্চিমা দেশগুলোর অবরোধ প্রত্যাহার, বিদেশে আফগানিস্তানের জব্দ করে রাখা সম্পদ অবমুক্ত করার আহ্বান জানিয়ে চলেছে।
এসব উদ্যোগের মধ্য দিয়ে চীনের সি চিন পিং সরকার ও তালিবান সরকার কাছাকাছি এসেছে বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ, বিশ্বের বেশির ভাগ রাষ্ট্র ও সরকার যখন তালিবান সরকারকে ‘একঘরে’ করে দিয়েছে, তখন বেইজিংয়ের এমন উদ্যোগকে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকেরা।
খনিজ সম্পদে আগ্রহ
আফগানিস্তান বিষয়ে প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানের সম্পর্কটি বেশ পুরনো। তবে চীন কেন হঠাৎ করে দেশটির বিষয় এতো আগ্রহ দেখাচ্ছে? সে বিষয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক বিশ্লেষণ বলছে, এর নেপথ্য কারণ আফগানিস্তানের খনিজ সম্পদ। বিশেষ করে লিথিয়ামের বিপুল মজুত দেশটির ব্যাপারে চীনকে আগ্রহী করে তুলেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
বর্তমান বিশ্বের অপরিহার্য উপাদান লিথিয়াম। কারণ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প হিসেবে বৈদ্যুতিক শক্তিকে কাজে লাগাতে চাইছে মানুষ। অর্থাৎ তেল-কয়লার বদলে ব্যাটারিচালিত প্রযুক্তির দিকে ঝুঁকছে পৃথিবী। আর এই ব্যাটারি তৈরি করতেই প্রয়োজন লিথিয়াম ধাতুটি। বলা হচ্ছে, দুষ্প্রাপ্য এই ধাতু এখন সোনার চেয়েও দামি।
চীন ইলেকট্রিক যানবাহন তৈরির বিষয়ে জোর দিচ্ছে। এই যানবাহনের অন্যতম প্রধান উপকরণ লিথিয়াম। পাশাপাশি চীনের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক রাজনীতির নতুন প্রেক্ষাপট আফগানিস্তানের ব্যাপারে বেইজিংকে আগ্রহী করে তুলেছে।
যুদ্ধবিধ্বস্ত এই আফগানিস্তানের মাটির নিচেই রয়েছে রাশি রাশি ‘গুপ্তধন’, যা অল্প সময়েই ঘুরিয়ে দিতে দেশটির অর্থনীতির চাকা। সূত্র জানায়, আফগানিস্তানের মাটির অভ্যন্তরে ১ লাখ কোটি ডলার মূল্যের ‘গুপ্তধন’ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম খনিজ লিথিয়াম মৌল।
দূষণহীন যান চলাচলের ব্যাটারি, মোবাইল ফোনের ব্যাটারির জন্য এ খনিজ আধুনিক বিশ্বের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত। কিন্তু প্রকৃতিতে দুর্লভ এবং খনি থেকে সেই মৌলের নিষ্কাশনের পদ্ধতি অত্যন্ত জটিল। তাই এর বহুল ব্যবহারের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তাছাড়াও রাশি রাশি তামা, সোনা, আকরিক লোহাসহ নানা ধরনের বিরল মৌল রয়েছে দেশটির বিভিন্ন প্রদেশের মাটির নিচে।
ইকোলজিক্যাল ফিউচার্স গ্রুপ-এর প্রতিষ্ঠাতা বিজ্ঞানী ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ রড শুনোভার জানিয়েছেন, আফগানিস্তানের মাটির তলায় কী পরিমাণ ‘গুপ্তধন’ রয়েছে তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। ব্যাটারি রিচার্জ করার জন্য জরুরি লিথিয়াম, তামা, অ্যালুমিনিয়াম ও নিওডিয়াম মৌল আছে সেখান। খনিজ লিথিয়াম সবচেয়ে বেশি মজুত রয়েছে এখন বলিভিয়ায়। আফগানিস্তানের ভাণ্ডার তার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে। আর এই খনিজগুলো ব্যবহার করে এক দশকের মধ্যেই এশিয়ার এই অঞ্চলের ধনীতম দেশ হয়ে উঠতে পারে আফগানিস্তান।
বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, আফগানিস্তানের ৯০ শতাংশই দারিদ্র্যপীড়িত। এই সব দুর্লভ ‘গুপ্তধন’ তোলার সক্ষমতা নেই দেশটির। আর এই খনিজ সম্পদই আফগানিস্তানের ব্যাপারে চীনকে বিশেষ আগ্রহী করে তুলেছে।
যদিও আফগানিস্তানে মজুদ লিথিয়ামের বিষয়টি একেবারেই এড়িয়ে গেছে চীন। চীন বলছে, তালিবানের সঙ্গে তাদের যোগাযোগের মূল লক্ষ্য পশ্চিমাঞ্চলীয় জিনজিয়াং অঞ্চলকে বেইজিংবিরোধী তুর্কিস্তান ইসলামিক মুভমেন্টের (ইটিআইএম) হাত থেকে রক্ষা করা।
গ্লোবাল টাইমসের বরাতে পাকিস্তানি গণমাধ্যম দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউন জানিয়েছে, অন্তত পাঁচটি চীনা কোম্পানি আফগানিস্তানে লিথিয়ামের খনি অনুসন্ধান করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। সম্প্রতি এসব কোম্পানির প্রতিনিধিদের একটি দল বিশেষ ভিসা নিয়ে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত আফগানিস্তানের মাটিতে পা রেখেছেন। তারা দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে লিথিয়ামের খনি অনুসন্ধান করবেন।
বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ
অনেক পর্যবেক্ষক বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র চলে যাওয়ার পর আফগানিস্তানকে তাদের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বি আর আই) প্রকল্পে যুক্ত করার মোক্ষম সুযোগ পেয়েছে চীন।
সূত্র মতে, চীন এরই মধ্যে চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোরের (সিপেক) সাথে আফগানিস্তানকে যুক্ত করার কথা বলছে। পেশোয়ার এবং কাবুলের মধ্যে একটি মহাসড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে কাবুল সরকারের সাথে বছর দু’য়েক ধরে কথা বলছে চীন, যদিও যুক্তরাষ্ট্র নাখোশ হবে এই ভয়ে আফগান সরকার তাতে সায় দেয়নি। তাছাড়া, শিনজিয়াং প্রদেশের ওয়াকান করিডোর দিয়ে আফগানিস্তানের সীমান্ত পর্যন্ত একটি সড়ক নির্মাণ করছে চীন।
আফগানিস্তানকে বিআরআই-এর সাথে সম্পৃক্ত করে নিজের প্রভাবে বলয়ে ঢোকানোর একটি পরিকল্পনা বাস্তবায়নে চীন তৎপর হয়ে উঠেছে। আফগানিস্তানে সরাসরি অর্থনৈতিক এবং ব্যবসায়িক স্বার্থ হাসিলের পাশাপাশি আফগানিস্তানের স্থিতিশীলতা এখন চীনের কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
আফগানিস্তান এখন আর চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পের জন্য অতি আবশ্যক নয়। মধ্য এশিয়ায় ঢোকার জন্য বা তাদের জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য আফগানিস্তানকে চীনের খুব বেশি প্রয়োজন নেই। পাকিস্তান এবং ইরানের সাথে চুক্তি করে সেই লক্ষ্য তারা হাসিল করছে।
কিন্তু চীনের এখন প্রধান চিন্তা যে আফগানিস্তানে যেকোন অরাজকতা হয়তো পাকিস্তানে এবং ইরানে তাদের শত শত কোটি ডলারের প্রকল্প; যা ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যের সাথে বিকল্প একটি বাণিজ্য রুট তাকে হুমকিতে ফেলতে পারে।
সাগর তীরবর্তী গোয়াদার গভীর সমুদ্র বন্দর এবং সেখান থেকে চীন পর্যন্ত একটি জ্বালানি পাইপলাইন বসানোসহ পাকিস্তানে ডজন ডজন অবকাঠামো প্রকল্পে চীন ২০২৫ সাল পর্যন্ত প্রায় ৬০ বিলিয়ন (৬,০০০ কোটি) ডলার ব্যয় করবে।
সেই সাথে, চীন ইরানের সাথে একটি চুক্তি করেছে যার আওতায় তারা বন্দর আব্বাসের আধুনিকায়ন এবং সম্প্রসারণসহ সেদেশের একগাদা অবকাঠামো এবং জ্বালানি প্রকল্পে আগামী ২৫ বছরে ৪০০ বিলিয়ন (৪০,০০০ কোটি) ডলার বিনিয়োগ করবে।
ফলে, পাকিস্তান এবং ইরানের স্থিতিশীলতা এবং নিরাপত্তা চীনের কাছে এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু চীনের ভয় হলো যে আফগানিস্তানে নতুন কোনও অস্থিতিশীলতার ধাক্কা ও দুই দেশে গিয়ে পড়তে বাধ্য।
আফগানিস্তান এবং উইঘুর বিচ্ছিন্নতাবাদ
চীনের অবশ্য নিজের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিয়েও চিন্তা শুরু হয়েছে। কারণ আফগানিস্তানের সঙ্গে চীনের যে ৯০ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে, তার ঠিক ওপাশেই রয়েছে উইঘুর মুসলিম অধ্যুষিত চীনা প্রদেশ জিনজিয়াং।
উইগুর বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী ইস্ট তুর্কেস্তান ইসলামিক মুভমেন্ট (এটিম) অনেক বছর ধরে এই সীমান্ত এলাকায় তৎপর। সীমান্ত পেরিয়ে তারা আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও আশ্রয়-প্রশ্রয় পায়, এবং চীন বিশ্বাস করে পাকিস্তানে বিভিন্ন সময়ে চীনা নাগরিক এবং চীনা প্রকল্পে হামলার পেছনে এটিমের হাত রয়েছে।
জাতিসংঘের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, এটিমের সাড়ে তিন হাজার সক্রিয় যোদ্ধা রয়েছে, যাদের সাথে আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানে তৎপর কিছু সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর যোগাযোগ রয়েছে।
তআই এটিম এবং অন্য সব সন্ত্রাসী সংগঠন যাতে আফগানিস্তানে ঘাঁটি না গাড়তে পারে ,তা নিশ্চিত করতে চায় চীন। গ্লোবাল টাইমসের রিপোর্ট অনুযায়ী, মোল্লাহ বারাদার এক বৈঠকে চীনা মন্ত্রীকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে আফগানিস্তানের ভূমি ব্যবহার করে চীনের বিরুদ্ধে কাউকে কোনও তৎপরতা তালিবান চালাতে দেবে না।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫৩০
আপনার মতামত জানানঃ