এক দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে মানুষ জোরপূর্বক বা অনিচ্ছাকৃত গুমের শিকার হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে জাতিসংঘের। এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের কাছে জবাব চাইছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এনফোর্সড অর ইনভলান্টারি ডিজ-অ্যাপিয়ারেন্স।
মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর এবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর হাতে জোরপূর্বক নিখোঁজ বা গুমের বিষয়ে জাতিসংঘকে সন্তুষ্টজনক জবাব দিতে চায় বাংলাদেশ। এদিকে, সম্প্রতি গুমের শিকার ব্যক্তিদের বাড়ি গিয়ে হয়রানি করছে পুলিশ। সাক্ষর নিচ্ছে বেআইনিভাবে। বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন, এই ব্যাপারগুলো পারস্পরিক সম্পর্কিত।
গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারে পুলিশের হয়রানি
গুমের শিকার ব্যক্তিদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুলিশের জেরা এবং পরিবারের সদস্যদের থানায় নিয়ে এসে জোর করে স্বাক্ষরসহ নানা হয়রানি করা হচ্ছে।
এমন অভিযোগ করেছেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি ও নির্বাহী সমন্বয়কারী আবুল হাসান রুবেল। তারা এ ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান।
শনিবার (১৫ জানুয়ারি) দুপুরে গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে এ অভিযোগ করেন। বিবৃতিতে বলা হয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নির্যাতনের শিকার পরিবারের পাশে না দাঁড়িয়ে তাদেরকে হুমকি দেওয়া ও হয়রানি করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এনফোর্সড অর ইনভলান্টারি ডিসএপিয়ারেন্স বাংলাদেশে গুম হওয়া ব্যক্তিদের তালিকা প্রকাশ এবং এর প্রতিকারের জন্য সরকারের ওপর চাপ দিয়েছে।
এই চাপ দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের নির্দেশেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা গুম হওয়া পরিবারের সদস্যদের ওপর চাপ প্রয়োগসহ হয়রানি করছে। ভুক্তভোগী নাগরিকদের ওপর এ ধরণের জুলুম করে কেউ কখনো রেহাই পায়নি ইতিহাস সে কথাই বলে।
নেতারা বলেন, ‘গুমের শিকার ব্যক্তি নিখোঁজ হয়েছে’ বা ‘পরিবারের পক্ষ থেকে তথ্য গোপন করা হয়েছে’ এসব বাক্য লিখে গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে স্বাক্ষর নেওয়া শুধু অন্যায় নয় এটা অপরাধ। এই কাজে জড়িত পুলিশ সদস্যদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
কেন জাতিসংঘকে সন্তুষ্ট করতে চায় বাংলাদেশ?
গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ও এর বর্তমান ও সাবেক সাত কর্মকর্তার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর বাংলাদেশে গুম নিয়ে ডব্লিউজিইআইডিকে সন্তুষ্ট করতে প্রস্তুতি নিচ্ছে ঢাকা।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিত সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। এ জন্য গদবাধা জবাবের বাইরে এসে কেস টু কেস ডিটেইলিং বা গ্রাউন্ড রিয়েলিটি এক্সপ্লেইনের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সচিব (পশ্চিম) সাব্বির আহমেদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে বুধবার বাংলাদেশের কাছে ডব্লিউজিইআইডির প্রশ্নের বিষয়ে তাদের অবগত করা নিয়ে আন্তমন্ত্রণালয়ে বৈঠক হয়।
এতে স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয় ছাড়াও পুলিশ, র্যাবসহ সরকারি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (পশ্চিম) সাব্বির আহমেদ চৌধুরী।
তিনি বলেন, ‘জোরপূর্বক বা অনিচ্ছাকৃত গুম নিয়ে জাতিসংঘ বাংলাদেশের কাছে যা জানতে চেয়েছে, সে বিষয়ে তাদের অবগত করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে ঢাকা।’
গত এক দশকে বাংলাদেশের কাছে ৮৩ জনের গুম হওয়া নিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে জানতে চেয়েছে ডব্লিউজিইআইডি। এ নিয়ে আগে বৈঠক করে জাতিসংঘকে উত্তর দিয়েছে বাংলাদেশ। তবে কোনোবারই জাতিসংঘ বাংলাদেশের উত্তরে সন্তুষ্ট হতে পারেনি। তাই বিষয়টি এবার গুরুত্ব সহকারে নিয়েছে বাংলাদেশ।
২০১৯ সালে ডব্লিউজিইআইডির প্রতিবেদনে গুম প্রশ্নে বাংলাদেশ নিয়ে বেশ নেতিবাচক তথ্য তুলে ধরা হয়। সেখানে বলা হয়, জোরপূর্বক নিখোঁজ হওয়া থেকে সব নাগরিককে সুরক্ষা দেয়ার যে ঘোষণা, তা লঙ্ঘন এবং এই ঘোষণা বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ব্যর্থতা নিয়ে উদ্বিগ্ন ওয়ার্কিং গ্রুপ।
প্রতিবেদনে বাংলাদেশে গুম অব্যাহত আছে বলে উল্লেখ করা হয়। সেই সঙ্গে ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে ৫০৭ জন জোরপূর্বক নিখোঁজ হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে, যার মধ্যে ৬২ জন নিহত হয়েছে। নিখোঁজ ব্যক্তিদের মধ্যে ২৮৬ জন ফিরে এলেও ১৫৯ জনের কোনো খোঁজ এখনও মেলেনি।
এর আগে একই ধরনের প্রতিবেদন ২০১৭ সালে প্রকাশ করেছিল ডব্লিউজিইআইডি। এবার ইউনিভার্সেল পিরিয়ডিক রিভিউর পর ডব্লিউজিইআইডি আবার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করবে।
আগের দুই প্রতিবেদনের মতো এমন অভিযোগের উল্লেখ করে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর নামে যাতে কোনো নেতিবাচক বিষয় যাতে উঠে না আসে, সে বিষয়ে ঢাকা এবার বিশেষভাবে সচেতন।
গত বছরের বিভিন্ন সময়ে গুম হওয়া ৩৪ জন ব্যক্তির অবস্থান ও ভাগ্য জানতে চেয়ে বাংলাদেশের কাছে চিঠি দিয়েছিল জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল।
ডব্লিউজিইআইডি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এ-সংক্রান্ত একটি চিঠি পাঠিয়েছিল। সেই চিঠির সূত্র ধরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২০২১ সালের জুন মাসের মাঝামাঝি পুলিশের বিশেষ শাখা এসবিতে একটি চিঠি পাঠায়।
নিষেধাজ্ঞার পর বন্দুকযুদ্ধে মারা যায়নি কেউ
বাংলাদেশে নিষেধাজ্ঞা এসেছে বিশেষ বাহিনী র্যাব এবং এর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। দেখা যাচ্ছে, মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর একমাসে দেশে কেউ বন্দুকযুদ্ধে মরেনি।
মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নয়নকেও গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। এ বাস্তবতায় র্যাবের কার্যক্রমে একটা সংস্কারের সুযোগ আছে বলেও মনে করেন সাবেক আইজিপি শহীদুল হক।
তিনি বলেন,সংস্কার করতে হলে বেপরোয়াভাবে যেন কিছু না হয়। সবকিছু কন্ট্রোলের মধ্যে রাখতে হবে।
তিনি বলেন, আপনি গুলি করবেন এনকাউন্টার, আপনি বিপদে পড়েছেন, দুস্কৃতিকারীরা আপনাকে হামলা করছে সেক্ষেত্রে ব্রাশ ফায়ার করে মানুষ মারতে থাকলেতো হবে না। আপনাকে বাঁচানোর জন্য যতটুকু করার দরকার অতটুকুই করতে হবে। এই সংস্কারটা আনতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি বাংলাদেশের রাজনীতিকে প্রভাবিত করেছে বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫২০
আপনার মতামত জানানঃ