বড় ধরনের আর্থিক ও মানবিক সংকটের মুখোমুখি শ্রীলঙ্কা। আশঙ্কা করছে, ২০২২ সালে দেউলিয়া হতে পারে দেশটি। রেকর্ডমাত্রায় মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি, দ্রব্যমূল্যের আকাশছোঁয়া দাম এবং কোষাগার শূন্য হয়ে পড়ায় এমন আশঙ্কা প্রবল হচ্ছে।
শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে বড় ঋণদাতা চীন। চীনের কাছে তাদের অপরিশোধিত ঋণের পরিমাণ অনেক বেশি। বেইজিং-এর কাছে কলম্বোর ৫০০ কোটি ডলার দেনা রয়েছে। গত বছর আরও ১০০ কোটি ডলার ঋণ নিয়েছে কলম্বো। আগামী ১২ মাসে সরকারি ও বেসরকারি খাতকে দেশি ও বিদেশি ঋণ শোধ করতে হবে ৭৩০ কোটি ডলার। এরমধ্যে জানুয়ারিতেই আন্তর্জাতিক বন্ডের জন্য ৫০ কোটি ডলার পরিশোধ করতে হবে। যদিও নভেম্বর পর্যন্ত দেশটির বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ছিল মাত্র ১৬০ কোটি ডলার।
ঋণের ঝোঝায় শ্রীলঙ্কা যখন জর্জরিত, তখন দেশটিতে সফরে এসেছেন চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী। সাক্ষাৎ করেছেন লঙ্কা প্রেসিডেন্ট গোটাবাইয়া রাজাপাকসের সঙ্গে। বিবৃতিতে প্রেসিডেন্ট গোটাবাইয়া রাজাপাকসে ও প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দ রাজাপাকসের কার্যালয় জানিয়েছে, করোনা মহামারি পরবর্তী অর্থনৈতিক সংকট কারণে ঋণ পরিশোধে আরও সময় বাড়ানো হলে এটি বড় স্বস্তির কারণ হবে। এ বিষয়ে রাজধানী কলম্বোয় অবস্থিত চীনের দূতাবাস থেকে কোনও প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
অর্থনৈতিক সঙ্কট ক্রমশ গ্রাস করছে দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কাকে। এ অবস্থায় তাদেরকে উদ্ধারে ‘বেইলআউট’ প্রস্তাব দিয়েছিল আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল আইএমএফ। কিন্তু সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে শ্রীলঙ্কা। পক্ষান্তরে তারা আরো বেশি ঋণ নেয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে। বিশেষ করে অর্থনৈতিক সঙ্কট সমাধানের জন্য তারা চীনসহ আরো কিছু দেশের কাছ থেকে আরও ঋণ নেবে। সঙ্গে সঙ্গে দ্রুততার সঙ্গেই আন্তর্জাতিক রেটিংয়ে আরেকদফা অবনমন ঘটেছে দেশটির। এ খবর দিয়েছে বার্তা সংস্থা এএফপি।
চীনের কাছ থেকে তারা আরো ঋণ নেয়ার বিষয়ে আলোচনা করছে। কলম্বো থেকে এ ঘোষণা দেয়ার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল দেশটিকে সিসিসি+ ক্যাটাগরি থেকে এক ধাপ নামিয়ে সিসিসি’তে ফেলেছে।
এই দ্বীপরাষ্ট্রটির অর্থনীতি নির্র্ভরশীল পর্যটনের ওপর। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে সেই অর্থনীতি একেবারে পর্যুদস্ত। সুপারমার্কেট থেকে পণ্যসামগ্রী দেয়া হচ্ছে রেশনিং করে। বিদ্যুত বিভাগ থেকে ব্লাকআউট বা লোডশেডিং দেয়া হচ্ছে। সেখানে তেল আমদানির মতো অর্থ নেই।
এ অবস্থায় শ্রীলঙ্কার ওই অবনমন ঘটালো এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল। তারা বলেছে, দেশটির এমন অবনতিশীল পরিস্থিতিতে বৈদেশিক রিজার্ভ ধরে রাখতে সক্ষম হবে বলে মনে হয় না। ফলে দেশটির সার্বভৌমত্ব ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
এসঅ্যান্ডপি এক বিবৃতিতে বলেছে, আগামী এক বছর বা ১২ মাসে ঋণের বিপরীতে অর্থ পরিশোধ শ্রীলঙ্কার জন্য ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়বে। কারণ, বাইরের কাছে তাদের চেহারা দুর্বল হয়ে পড়েছে। বড় মাপের রাজস্ব ঘাটতি দেখা দিয়েছে। সরকারের ঋণ ভারি হয়েছে। মোটা সুদ দিতে হচ্ছে। অন্য আন্তর্জাতিক রেটিং বিষয়ক এজেন্সিগুলোও সতর্ক করেছে শ্রীলঙ্কার সার্বভৌমত্ব নিয়ে। কারণ, তারা বিদেশের কাছ থেকে ৩৫০০ কোটি ডলার ঋণ নিয়েছে। কোষাগার বৈদেশিক বিনিময় রিজার্ভ নিয়ে লড়াই করছে।
কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর অজিত নিবার্ড ক্যাব্রাল স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক অর্থনীতিবিদদের জোরালো আহ্বানকে প্রত্যাখ্যান করে আসছেন। এসব অর্থনীতিবিদ আইএমএফের বেইলআউট এবং ঋণ পুনর্গঠন প্রস্তাব করেছেন। কিন্তু তা নিয়ে ভাবতে নারাজ নিবার্ড ক্যাব্রাল।
পক্ষান্তরে কলম্বোতে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, আইএমএফ কোনো জাদুর কাঠি নয়। আইএমএফের কাছে যাওয়ার চেয়ে এই মুহূর্তে অন্য বিকল্পগুলো ভাল।
তিনি জানান, নতুন একটি ঋণ নিয়ে চীনের সঙ্গে আলোচনা অনেকটা অগ্রবর্তী অবস্থায় রয়েছে। একটি চুক্তি হলে বেইজিং ঋণ দেবে। তার ভাষায়, ঋণ পরিশোধের জন্য তারা আমাদের সহায়তা করবে। চীনের কাছ থেকে আসা নতুন ঋণ দিয়ে তাদের ঋণের পাওনাই পরিশোধ করা হবে।
ঋণ পরিশোধের জন্য তারা আমাদের সহায়তা করবে। চীনের কাছ থেকে আসা নতুন ঋণ দিয়ে তাদের ঋণের পাওনাই পরিশোধ করা হবে।
দরিদ্র দেশগুলোকে চীন যেভাবে ঋণ দিচ্ছে তার কারণে দেশটির সমালোচনা হচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে যে এই ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে সেসব দেশ হিমশিম খাচ্ছে এবং এর ফলে তারা বেইজিং-এর কাছ থেকে চাপের মুখেও পড়ছে।
তবে চীন এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলছে, তাদের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করার জন্য পশ্চিমের কিছু কিছু দেশ এধরনের বক্তব্য প্রচার করছে।
তারা বলছে, ‘এমন একটি দেশও নেই যারা চীনের কাছ থেকে অর্থ ধার করার কারণে তথাকথিত ‘ঋণের ফাঁদে’ পড়েছে’।
দাবি করা হয় যে চীন অন্যান্য দেশকে ঋণ হিসেবে অর্থ সহায়তা দিয়ে থাকে যারা সেই ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে তাদের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ বা অধিকার ছেড়ে দেয়। তবে চীন এই অভিযোগ বহু কাল ধরে অস্বীকার করে আসছে।
চীনের সমালোচকরা এব্যাপারে প্রায়শ যে দেশটির উদাহরণ দেয় তা হচ্ছে শ্রীলঙ্কা। এই দেশটি কয়েক বছর আগে চীনা বিনিয়োগের মাধ্যমে হাম্বানটোটায় একটি বৃহৎ আকারের বন্দর নির্মাণের প্রকল্প শুরু করেছে।
কিন্তু কয়েক’শ কোটি ডলারের এই প্রকল্প, যাতে চীনের ঋণ এবং ঠিকাদার ব্যবহার করা হচ্ছে, সেটিকে ঘিরে ইতোমধ্যে বহু বিতর্ক তৈরি হয়েছে। এই প্রকল্প কতোটা বাস্তবায়নযোগ্য সেটা প্রমাণ করাও এখন বেশ কঠিন। এর ফলে শ্রীলঙ্কা ক্রমবর্ধমান ঋণের চাপে জর্জরিত হয়ে পড়েছে।
শেষ পর্যন্ত, ২০১৭ সালে, শ্রীলঙ্কা আরো চীনা বিনিয়োগের বিনিময়ে এই বন্দরের ৭০% শতাংশ নিয়ন্ত্রণ চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চায়না মার্চেন্টস কোম্পানির কাছে ৯৯ বছরের জন্য ছেড়ে দিতে সম্মত হয়েছে।
এই বন্দর প্রকল্পের উপর যুক্তরাজ্যের গবেষণা প্রতিষ্ঠান চ্যাটাম হাউজের বিশ্লেষণে এটিকে ‘ঋণের ফাঁদ’ বলা যাবে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। বলা হচ্ছে, স্থানীয় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এই চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে, এবং চীন কখনোই আনুষ্ঠানিকভাবে এই বন্দরের মালিকানা গ্রহণ করেনি।
চ্যাটাম হাউজের গবেষণায় বলা হচ্ছে, শ্রীলঙ্কার মোট ঋণের একটা বড় অংশ চীনের বাইরে অন্যান্য ঋণদাতাদের কাছ থেকে নেয়া হয়েছে। এছাড়াও চীন যে এই বন্দরের অবস্থান থেকে কৌশলগত সামরিক সুবিধা নিয়েছে তার পক্ষেও কোনো প্রমাণ নেই।
তা সত্ত্বেও গত এক দশকে শ্রীলঙ্কায় যে চীনের অর্থনৈতিক বিনিয়োগ বেড়েছে তা নিয়ে খুব সামান্যই সন্দেহ রয়েছে। এবং এই অঞ্চলে চীন তার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণে যে এটিকে ব্যবহার করতে পারে—দেশটিতে এমন উদ্বেগও রয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৪০
আপনার মতামত জানানঃ