অনেকেই ইতিহাস বিষয়টিকে অপছন্দ করেন। বিশেষ করে ছাত্রজীবনে ইতিহাস বিষয়ের পরীক্ষায় বিভিন্ন সাল যথাযথভাবে মনে রাখতে কারো কারো গলদঘর্ম হয়ে গেছে। অতীতের বিভিন্ন আমলে জীবন কাটিয়ে যাওয়া বিখ্যাত কিংবা কুখ্যাত ব্যক্তিদের জীবন কাহিনী, বিভিন্ন রাজাদের বীরত্ব গাঁথা বা পরাজয়ের ইতিহাস মুখস্ত করতে করতে ‘ইতিহাস’ রীতিমতো একটি ঘৃণ্য সাবজেক্টে পরিণত হয়েছে অনেকের কাছে। তবে চীনের প্রথম সম্রাট কিন শি হুয়ান সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে ‘ইতিহাস’-এর প্রতি ক্ষিপ্ত ছিলেন এবং তিনি ইতিহাস বিষয়ক যাবতীয় বইপত্র পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
বাবা মারা যাওয়ার সুবাদে ২৪৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে কিন শি হুয়ান মাত্র ১৩ বছর বয়সে কিন প্রদেশের রাজা হিসেবে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হোন। ২১৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে যখন তার বয়স প্রায় ৪৬, তখন তিনি ইতিহাসের সব বই, প্রাচীন নথিপত্র পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। শুধু ইতিহাসের বই-ই নয়; গান, কবিতা সমগ্র, কনফুসিয়াস ও লাওৎ সু’র সব লেখাও তার পুড়িয়ে দেওয়ার তালিকায় ছিল। এসব বইপত্রকে তিনি সমস্যা বলে বলে মনে করতেন। তার কাছে এসব বইপত্র ছিল অর্থহীন, বাজে জিনিস কিংবা আবর্জনা। তিনি যে বইগুলো সংরক্ষণ করার অনুমতি দিয়েছিলেন সেগুলো হলো কৃষিকাজ বা অন্য কোনো কাজের জন্য দরকারি শিক্ষামূলক বইপত্র। কারো কাছে নিষিদ্ধ তালিকার কোনো বই পাওয়া গেলে তার শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড।
‘কিন শি হুয়াং ডি’ তথা কিন শি হুয়ান ছিলেন সমগ্র চীনের প্রথম একক সম্রাট। তিনি সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম যোদ্ধাদের অন্যতম একজন ছিলেন। তবে নিজেকে তিনি শুধু চীনের প্রথম একক সম্রাট হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত করেননি, সেইসাথে একের পর এক অন্যান্য প্রদেশ জয় করে পুরো দেশকে বদলে দিয়েছিলেন। তিনি সকল প্রিন্সকে ক্ষমতাচ্যুত করে তার সাম্রাজ্যকে পুনঃসংগঠিত করেছিলেন।
কিন্তু তিনি ইতিহাসকে কেন তীব্রভাবে ঘৃণা করতেন? কারণ তিনি অতীতের কারো সাথে তার শাসনামলের তুলনা দেওয়া পছন্দ করতেন না। প্রায়ই পন্ডিত এবং সমালোচকগণ অতীতের উদাহরণ টেনে বিভিন্ন আলোচনা সমালোচনা জুড়ে দিতেন, যা কিন শি হুয়ানের খুবই অপছন্দ ছিল। তিনি অতীতের সব চিহ্ন মুছে দিতে চেয়েছিলেন। নিজের মতো করে একদম গোড়া থেকে, নতুন এক চীন গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। নিজের সাম্রাজ্য জুড়ে বহু সড়কপথ নির্মাণ করেছিলেন। তিনিই চীনের মহাপ্রাচীর নির্মাণের প্রকল্প গ্রহণ করেছিলেন। চীনের ইতিহাসে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ এবং বিখ্যাত এই সম্রাটের উল্লেখযোগ্য অর্জন হলো চীনা অক্ষরের প্রমিতকরণ, মুদ্রা এবং পরিমাপক ব্যবস্থার একটি মানদণ্ড প্রণয়ন, কৃষি ব্যবস্থার সংস্কার এবং চীনের দক্ষিণ সীমান্ত অঞ্চলে আত্মরক্ষামূলক দুর্গ নির্মাণ, যা কিনা ‘গ্রেট ওয়াল অফ চায়না’ বা চীনের মহাপ্রাচীর নামে পরিচিত।
এখানে উল্লেখ্য যে, চীনের মহাপ্রাচীর মানুষের হাতে তৈরি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় স্থাপত্য এবং এটি পৃথিবীর সাতটি আশ্চর্য নির্মাণ (7 Wonders of the World) এর অন্তর্ভূক্ত। এই প্রাচীরের উচ্চতা প্রায় ৫ থেকে ৮ মিটার এবং দৈর্ঘ্য ২১,১৯৬ কিলোমিটার। ২০৮ খ্রিষ্টাব্দে এর মূল অংশের নির্মাণ শুরু হয়েছিল। লোকমুখে প্রচলিত আছে, চীনের মহাপ্রাচীরকে নাকি চাঁদ থেকে দেখা যায়! যদিও তা মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়েছে। গবেষকদের মতে, মানুষের মাথার একটি চুলকে ২ থেকে ৩ কিলোমিটার দূর থেকে দেখলে যেমন দেখা যাবে চাঁদ থেকে চীনের মহাপ্রাচীরকেও তেমনটা দেখা যাবে।
চীনের প্রচণ্ড পরিশ্রমী, শান্তিপ্রিয় কৃষক ও শহরবাসীদের উত্তরাঞ্চলের বুনো গোত্রগুলো থেকে রক্ষা করার জন্য কিন শি হুয়ান এই প্রাচীর নির্মাণ করেছিলেন। সেই গোত্রগুলোর যুদ্ধপ্রিয় অশ্বারোহী দস্যুরা মধ্য-এশিয়ার বিস্তৃত সমতলে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছিল। বিরতিহীন আক্রমণ, লটতরাজ এবং হত্যাকাণ্ড প্রতিহত করার কথা মাথায় রেখে তিনি প্রাচীরটিকে অত্যন্ত শক্তিশালীভাবে নির্মাণ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। তার পরিকল্পনা সফল হয়েছিল। পরবর্তী বহু শতাব্দী জুড়ে প্রায়ই প্রাচীরটিকে সংস্কার ও পুণঃনির্মাণ করে আরো শক্তিশালী করে গড়ে তোলা হয়েছিল। সময়ের কষাঘাতে বর্তমানে প্রাচীরের বেশ কিছু অংশ ধ্বংসের সম্মুখীন হলেও আজো প্রাচীরটি তার অস্তিত্ব পৃথিবীর বুকে জানান দিয়ে যাচ্ছে।
তবে তিনি দীর্ঘকাল ব্যাপি রাজত্ব করতে পারেননি। তার পরবর্তী সময়ে হান-পরিবার শাসনভার গ্রহণ করেন। কিন্তু তারা কিন শি হুয়ান-এর উন্নয়নমূলক প্রকল্প সমূহ বাতিল করার কোনো প্রয়োজন অনুভব করেননি। তাদের অধীনে চীন শক্তিশালী এবং একতাবদ্ধ ছিল। তবে হানরা ইতিহাসকে ঘৃণা করতেন না। উপরন্তু তারা স্বীকার করেছিলেন, শিক্ষার ক্ষেত্রে কনফুসিয়াসের কাছে চীন ঋণী হয়ে রয়েছে। তারা যাবতীয় প্রাচীন লেখা উদ্ধার করার জন্য দেশব্যাপী অভিযান পরিচালনা করেছিলেন। সেই অভিযানে দেখা গেল, অনেকেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বইপত্র সংরক্ষণ করে রেখেছিল। কারো কারো বই পোড়ানোর সাহস হয়নি। তাদের কাছ থেকে বইগুলো দ্বিগুণ মূল্যে সংগ্রহ করা হয়েছিল। সেই সময়ে সরকারি কর্মকর্তা হওয়ার ক্ষেত্রে যাবতীয় ইতিহাস জানা আবশ্যক ছিল।
চীন হচ্ছে পৃথিবীর একমাত্র দেশ যা কিনা শত শত বছর ধরে পন্ডিত ও বিদ্বান কর্তৃক শাসিত হয়েছে। অন্যান্য দেশ বা রাজ্যের মতো অভিজাত শ্রেণি, সৈন্য বা পুরোহিত দ্বারা শাসিত হয়নি। মানুষের বংশ পরিচয় যা-ই হোক না কেন, ধনী হোক বা গরীব; চীনে সরকারি কর্মকর্তা হতে গেলে ইতিহাস সংশ্লিষ্ট কঠিন পরীক্ষায় ভাল ফলাফল করলে তবেই কাজ করার সুযোগ মেলে। যারা সর্বোচ্চ নাম্বার অর্জন করে, তাদেরকে উচ্চপদগুলোতে কাজ করার সুযোগ দেওয়া হয়। তাদের জন্য হাজার হাজার অক্ষর চেনা, লিখতে পারা, প্রাচীন বইপত্র সম্পর্কে জানা, কনফুসিয়াসের নিয়মনীতি ও শিক্ষা এবং প্রাচীন পন্ডিতদের লেখাসমূহ আত্মস্থ করা আবশ্যক।
সম্রাট কিন শি হুয়ান-এর বই পোড়ানো প্রকল্পটি ব্যর্থ হয়েছিল। মানুষকে তাদের নিজেদের ইতিহাস জানতে না দেওয়াটা খুবই নেতিবাচক একটি চিন্তা। নতুন কিছু করতে চাইলে অতীত ইতিহাস জানা জরুরি। নতুন কিছু করার আগে মানুষকে অবশ্যই জানতে হবে অতীতে মানুষ কী কী চেষ্টা করেছিল।
তথ্যসূত্র:
https://www.bbc.com/news/magazine-19922863
A Little History of the World by E. H. Gombrich
পৃথিবীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস; ই.এইচ. গমব্রিখ
আপনার মতামত জানানঃ