২০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে (BC) সেমেটিক ভাষা ব্যবহারকারী উপজাতির একটি গোষ্ঠী কেনান ভূমিতে এসে বসবাস শুরু করেছিল। প্রাচীন নিকট প্রাচ্যে (Near East; যা আধুনিক যুগে Middle East নামে পরিচিত) লৌহযুগে (Iron Age) বসবাসকারী এই গোষ্ঠীকে ইসরাইলি বলা হয়।
হিব্রু বাইবেল অনুযায়ী, ইসরাইলিদের পূর্বপুরুষ হলেন আভরাহাম (ইব্রাহিম) ও তার স্ত্রী সারাহ। তাদের পুত্র ছিলেন ইসহাক এবং ইসহাকের পুত্র ছিলেন ইকাকোভ (ইয়াকুব)। ইয়াকোভের অন্য নাম ইসরাইল। পরবর্তীতে ইয়াকোভের বংশধররা ইসরাইলি বা বনি ইসরাইল নামে পরিচিত হয়। ইংরেজিতে ইসরাইলাইট শব্দটি গ্রিক শব্দ (Ισραηλίτης) থেকে উদ্ভুত, এর অর্থ ‘বনি ইসরাইল’ (בני ישראל) বা ইসরাইলের পুত্র। তবে আধুনিক প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে, শুধুমাত্র ধর্মীয় কাহিনীর সাহায্যে ইতিহাসের সত্যতা যাচাই করা সম্ভব নয়। তবে হিব্রু বাইবেলে বর্ণিত ইতিহাসের সাথে আবিষ্কৃত প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান সমূহের যথেষ্ট মিল থাকার কারণে হিব্রু বা ইসরাইলিদের ইতিহাসের অন্যতম উৎস হিসেবে হিব্রু বাইবেলকে গুরুত্ব দেওয়া হয়।
প্রত্নতাত্ত্বিক নমুনার ভিত্তিতে আধুনিক প্রত্নতত্ত্ববিদগণ বলেন, ইসরাইলিরা কেনানাইটদের ‘প্রধান দেবতার সহযোগী একাধিক দেবতা’র অস্তিত্বের ধারণার বাইরে গিয়ে ইয়াহওয়ে (Yahweh) কেন্দ্রিক নতুন একক ঈশ্বরবাদ ধারণা প্রবর্তন করে। দক্ষিণ লেভান্ট, সিরিয়া, কেনান, এবং ট্রান্সজর্ডান অঞ্চলে দীর্ঘকাল ধরে বসবাসকারী কেনানাইটরা ‘প্রধান দেবতার সহযোগী একাধিক দেবতা’র অস্তিত্বে বিশ্বাস করতো। কেনানাইটরা এক দেবতার অস্তিত্বে বিশ্বাস করতো ঠিকই কিন্তু তারা এটাও বিশ্বাস করতো- সেই দেবতা একা নয় বরং তার কাজে সহযোগীতার জন্য তিনি আরো অনেক দেবতাকে সৃষ্টি করেছেন। প্রথমদিকে ইসরাইলিদের আদিপুরুষ কেনানাইটরা ইয়াহওয়েকে প্রধান দেবতা হিসেবে গণ্য করার পাশাপাশি অন্যান্য দেব-দেবীদের পূজাও করতো। কিন্তু কালের বিবর্তনে অন্যান্য দেবতাদের বাদ দিয়ে সেখানে শুধু ইয়াহওয়ে’র উপাসনা শুরু হয়।
যাযাবর জাতি হওয়ার ফলে বিভিন্ন অঞ্চলের সংস্কৃতি ইসরাইলিদের মাঝে প্রবেশ করে এবং এক নতুন জাতিগত পরিচয়ের জন্ম লাভ করে। মূলত ইয়াহওয়ে ভিত্তিক এক ঈশ্বরবাদী ধর্ম এবং অন্যান্য সব কেনানাইট দেবতাদের অস্তিত্ব অস্বীকারের ফলেই ইসরাইলি নামের নতুন জাতিগোষ্ঠীর জন্ম হয়। তবে ইসরাইলিরা কেনানাইটদের বেশ কিছু সংস্কৃতি ধরে রেখেছিল। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো, হিব্রু ভাষাকে নিজেদের কথ্য ভাষায় হিসেবে গ্রহণ করা। কারণ পূর্বে হিব্রু ছিল কেনানাইটদের একটি উপভাষা। হিব্রুভাষী হওয়ার কারণে ইসরাইলিদের হিব্রু জাতি বলেও অভিহিত করা হয়।
হিব্রু বাইবেলে নবী আভরাহামকে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে হিব্রু শব্দটি প্রথম ব্যবহৃত হয়। পরে এই শব্দটি নবী ইউসেফ, ইসহাক ও ইয়াকোভের মাধ্যমে আভরাহামের অন্যান্য বংশধরদের অভিহিত করার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। অবশ্য আভরাহামকে কেন হিব্রু বলা হলো তা এখনো সঠিকভাবে জানা যায়নি। কোনা কোনো ঐতিহাসিক বলেন, হিব্রু শব্দটি মূলত ‘ইভার’ শব্দ হতে এসেছে। যার অর্থ ‘পার হয়ে আসা’। এজন্য নবী আভরাহামের ক্ষেত্রে শব্দটি প্রযোজ্য। কারণ আভরাহাম ব্যাবিলনের উর নামক নগরী ত্যাগ করে ফোরাত নদী পার হয়ে কেনান ভূমিতে এসেছিলেন। পরবর্তীতে হিব্রু বলতে আভরাহামের বংশধরদের দ্বারা সৃষ্ট জাতিকে অভিহিত করা শুরু হয়। আবার কারো কারো মতে, হিব্রু শব্দটি প্রথমে ইসরাইলিরা নিজেরাই নিজেদের নাম হিসেবে ব্যবহার করেছিল। পরবর্তীতে বিদেশীরা তাদের হিব্রু বলে সম্মোধন করতে শুরু করে।
হিব্রু বাইবেল অনুসারে, জীবদ্দশায় নবী ইসহাকের পুত্র ইয়াকোভ ইয়াহওয়ে কর্তৃক প্রেরিত এক ব্যক্তির (ফেরেশতা বা মাল’আখ) সাথে লড়াই করেছিলেন। লড়াই শেষে সেই ব্যক্তি ইয়াকোভকে আশীর্বাদ করেন এবং নাম রাখেন ইসরাইল। ইসরাইল শব্দটি ‘ইসরা’ এবং ‘এল’ শব্দদ্বয় থেকে এসেছে। কারণ তিনি ইয়াহওয়া’র সাথে লড়াই করে জয়ী হয়েছেন। ‘ইসরা’ শব্দের অর্থ ‘লড়াই’ এবং ‘এল’ শব্দের অর্থ ‘ঈশ্বর’। যা দ্বারা ইয়াহওয়েহকে বোঝায়। অর্থাৎ, নবি আভরাহামের বংশধর নবী ইসহাক এবং ইয়াকোভের মাধ্যমে যে জাতির আবির্ভাব হয় তারা ইসরাইলি নামে পরিচিত।
সহজভাবে বলতে গেলে ‘হিব্রু’ এবং ‘ইসরাইলি’ শব্দের মূল পার্থক্য হলো হিব্রু শব্দটি দ্বারা ইসরাইলিদের সেই পূর্বপুরুষদের বোঝায় যারা একসময় কেনান ভূমিতে বাস করতো। তাদের বংশধর ইসরাইলিরা এবং ইসরাইলিদের প্রাচীন ও আধুনিক সব বংশধরদের (ইহুদি ও সামেরিয়ানসহ) বোঝাতে ‘হিব্রু’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। আর ‘ইহুদি’ শব্দটি দ্বারা ব্যাবিলন নির্বাসনের পরে যেসব ইসরাইলি জুদাহ রাজ্যে বসবাস করতো তাদের এবং তাদের বংশধরদেরকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়।
৭৯৭ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে, অভ্যন্তরীণ গন্ডগোলের কারণে প্রাচীন ইসরাইল রাজ্য বিভক্ত হয়ে গেলে রাজ্যের উত্তর অংশের ১০টি গোত্র ইসরাইল রাজ্য এবং রাজ্যের দক্ষিণ অংশের ২টি গোত্র জুদাহ রাজ্য নামে গঠিত হয়েছিল। পরবর্তীতে উভয় রাজ্যের বাসিন্দাগণ নির্বাসিত হয়। প্রথমে ৭২২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে অ্যাশেরিয়দের দ্বারা উত্তর অংশের ইসরাইল রাজ্যের পতনের পর অধিকাংশ হিব্রু পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে এবং কিছু হিব্রু জনগোষ্ঠী দক্ষিণ জুদাহ রাজ্যে আশ্রয় নেয়। পরবর্তীতে ৫৯৭ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে জুদাহ রাজ্যের বাসিন্দারাও ব্যাবিলনীয়দের দ্বারা নির্বাসিত হয়।
নির্বাসনের পূর্বে যখন প্রাচীন ইসরাইল রাজ্য বিভক্ত ছিল, তখন ‘ইসরাইলি’ শব্দটি কেবলমাত্র উত্তর ইসরাইল রাজ্যের বাসিন্দাদের অভিহিত করার জন্য এবং রাজ্যের দক্ষিণ অংশ অর্থাৎ জুদাহ রাজ্যের বাসিন্দাদের বোঝাতে ‘ইহুদি’ শব্দটি ব্যবহৃত হতো। কিন্তু ৫৩৯ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে ব্যাবিলনীয় নির্বাসন থেকে ফিরে আসার পরে ইহুদি শব্দটি সব হিব্রুদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। কারো কারো মতে, সব হিব্রুদের ইহুদি নামে অভিহিত করার কারণ হলো- ফিরে আসা হিব্রুদের অধিকাংশই ছিলেন পূর্বেকার জুদাহ রাজ্যের অধিবাসী এবং তাদের বংশধর। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে বলা যায়, আধুনিক ইহুদিদের পূর্বপুরুষ ছিলেন দক্ষিণ অঞ্চলের জুদাহ রাজ্যের জুদাহ, বেনজামিন, শিমিয়োন এবং আংশিক লেভি গোত্রের হিব্রুগণ। পরবর্তী কালে ‘ইহুদি’ শব্দটিকে সাধারণত ইসরাইলি তথা হিব্রুদের ভেতরে সামারিটান, নন-ইহুদি বা ধর্মান্তরিত ব্যক্তিদের থেকে পৃথক করতে ব্যবহার করা হয়। কারণ সামারিটানরা নিজেদেরকে ইহুদি হিসেবে আখ্যায়িত করে না। তবে তারা সাধারণত নিজেদের সহ সব ইহুদিকে সম্মিলিতভাবে ইসরাইলি হিসেবে উল্লেখ করে এবং শুধুমাত্র নিজেদের সামারিটান ইসরাইলি হিসেবে অভিহিত করে। বিভিন্ন ইহুদি আইনগ্রন্থ যেমন : মিশনাহ ও গেমারায় ইহুদি শব্দটি খুব কমই ব্যবহৃত হয় এবং তার পরিবর্তে ইহুদিদের বোঝানোর জন্য ‘যিসরাইলি’ বা ‘ইসরাইলি’ শব্দটি বেশি ব্যবহৃত হয়।
বাইবেলের বাইরের বিভিন্ন উৎসের মাঝে ১২০৯ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের মিশরীয় ফারাও মারনেপ্টা’র একটি শিলালিপিতে ইসরাইল নামটি প্রথম দেখা যায়।
শিলালিপিটি খুব সংক্ষিপ্ত এবং এতে বলা হয়েছে : ইসরাইল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং ইসরাইলের খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গেছে। (Israel is laid waste and its seed is not)। এখানে ইসরাইল বলতে কোনো ব্যক্তি নয় বরং জনগোষ্ঠীকে বোঝানো হয়েছে।
তথ্যসূত্র:
https://christiananswers.net/q-abr/abr-a015.html
https://www.jstor.org/stable/1357179
জুদাইজম; লেখক: মাসরুর ইশরাক
আপনার মতামত জানানঃ