চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে সংখ্যালঘু উইঘুর মুসলিমদের ওপর দমন-পীড়নের অভিযোগে ১১২ জন চীনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন উইঘুর জনগোষ্ঠীর ১৯ ব্যক্তি। মঙ্গলবার (৪ জানুয়ারি) তারা তুরস্কের একটি প্রসিকিউটর দফতরে মামলা দায়ের করেন।
প্রসঙ্গত, উইঘুর মুসলিম অধ্যুষিক অঞ্চলের আগের নাম ‘পূর্ব তুর্কিস্তান’। এটির বর্তমান জিনজিয়াং প্রদেশে। চীন সরকার এ অঞ্চলকে জিনজিয়াং নাম দিয়েছে। ৯০ লাখ মুসলিম অধ্যুষিত এ অঞ্চলের প্রায় ১০ লাখ উইঘুর নারী-পুরুষ বন্দি রয়েছে সুরক্ষিত বন্দি শিবিরে।
চীন সরকার এ বন্দি শিবিরকে ‘চরিত্র সংশোধনাগার’ নাম দিয়েছে। চীন সরকারের দাবি, উশৃংঙ্খল অবস্থা থেকে নিরাপদ ও সুরক্ষা দিতেই তাদের এ কার্যক্রম। চরিত্র সংশোধনাগারের নামে চীন সরকার এ সব মুসলিমদের প্রতি চরম অত্যাচার ও নির্যাতন করছে বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে তা উঠে এসেছে।
মামলা প্রসঙ্গে
আলজাজিরা বলছে, মঙ্গলবার ইস্তাম্বুলের প্রধান প্রসিউটরের কার্যালয়ে চীনের ১১২ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এই ফৌজদারি অভিযোগ দায়ের করেন ১৯ জন উইঘুর সদস্য।
তবে তাৎক্ষণিকভাবে এ বিষয়ে ওই প্রসিউটরের কার্যালয় থেকে বা তুরস্কে অবস্থিত চীনা দূতাবাস কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
ইস্তাম্বুলের প্রধান আদালতের বাইরে আইনজীবী গুলদেন সনমেজ জানান, ‘এই মামলার বিচারকাজ আরও আগেই শুরু করার উচিত ছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের। কিন্তু চীন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য এবং এ কারণে এই পন্থায় বিচার সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।’
এসময় ইস্তাম্বুলের ওই আদালতের সামনে আইনজীবীকে ঘিরে পতাকা ও প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন অর্ধশতাধিক নারী ও পুরুষ। তারা সবাই তাদের পরিবারের নিখোঁজ সদস্যদের ছবি হাতে সেখানে উপস্থিত ছিলেন। আর তাদের হাতে থাকা প্ল্যাকার্ডে অভিযুক্ত চীনা কর্মকর্তাদের বিচারের দাবি জানানো হয়।
এর আগে গত ডিসেম্বরে সংখ্যালঘু উইঘুর মুসলিমদের ওপর গণহত্যা চালানোর দায়ে চীনকে অভিযুক্ত করে যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি অনানুষ্ঠানিক স্বাধীন ট্রাইব্যুনাল।
সেসময় চীনের বিরুদ্ধে দেওয়া ট্রাইব্যুনালের ওই রায়ে বলা হয়, সংখ্যালঘু উইঘুর মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর জাতিগত নিধন ও নিপীড়ন চালানোর মানসিকতা থেকেই চীনা কর্তৃপক্ষ তাদের ওপর জন্ম নিয়ন্ত্রণসহ অন্যান্য বাধ্যতামূলক বিভিন্ন পদক্ষেপ চাপিয়ে দিচ্ছে। চীনা কর্তৃপক্ষের এমন পদক্ষেপকে কার্যত গণহত্যা হিসেবেই উল্লেখ করেন তারা।
গত বছরের মার্চেও মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের বৈশ্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি প্রতিবেদনে জিনজিয়াংয়ে চীনা নিপীড়নের ব্যাপারে বলা হয়, ২০২০ সালে উইঘুর ও অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে গণহত্যা ও অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেছে চীনের ক্ষমতাসীন সরকার।
মানবতাবিরোধী অপরাধগুলো হলো— যথেচ্ছভাবে উইঘুরদের আটক ও বন্দিশিবিরে পাঠানো, জোরপূর্বক বন্ধ্যাকরণ, ধর্ষণ, নির্যাতন, শ্রমদানে বাধ্য করা এবং ধর্মপালন, মতপ্রকাশ ও চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করা।
যে অভিযোগ আনা হয়েছে
মামলায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে গণহত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে। মঙ্গলবার এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা।
তুরস্কের আইনজীবী গুলদেন সনমেজ জানিয়েছেন, সংখ্যালঘু উইঘুর জনগোষ্ঠীসহ সংখ্যালঘু অন্য আরও মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রায় ১০ লাখ মানুষকে ২০১৬ সাল থেকে বিভিন্ন বন্দিশিবিরে আটকে রেখেছে চীনা কর্তৃপক্ষ। সেখানে তাদের কাছ থেকে জোরপূর্বক শ্রম আদায় করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, দীর্ঘদিন ধরে গুরুতর এই অভিযোগ সামনে আসার পরও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় চীনা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে যথেষ্ট ব্যবস্থা নেয়নি। আর এই কারণেই অভিযুক্ত চীনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগ দায়ের করার প্রয়োজন ছিল।
চীন অবশ্য বরাবরই এ ধরনের বন্দিশিবিরের অস্তিত্বের কথা অস্বীকার করে থাকে। তবে একপর্যায়ে এগুলোকে কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে উল্লেখ করে চীন দাবি করে, উগ্রবাদ দূর করতে সেখানে উইঘুর জাতিগোষ্ঠীর মানুষকে কারিগরি শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া উইঘুরদের ওপর গণহত্যার অভিযোগ অযৌক্তিক, হাস্যকর এবং ডাহা মিথ্যা বলেও দাবি করে থাকে বেইজিং।
তুরস্কে প্রায় ৫০ হাজার উইঘুর বসবাস করে। মধ্য এশিয়ার বাইরে এককভাবে কেবল তুর্কি ভূখণ্ডেই এতো সংখ্যক উইঘুর মুসলিমের বাস রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা, জিনজিয়াং প্রদেশে চীন প্রায় ১০ লাখ উইঘুর মুসলিম এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুদের আটকে রেখেছে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে তাদের মধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণ করা।
এছাড়া চীনের মূলধারার হান জনগোষ্ঠীকে জিনজিয়াংয়ের কিছু এলাকায় বসবাসের জন্য স্থানান্তর করা হয়েছে।
অন্যদিকে উইঘুর শিশুদের তাদের পরিবারের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
গণহত্যা চালিয়েছে চীন
চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে সংখ্যালঘু উইঘুর মুসলিমদের ওপর গণহত্যা চালানোর দায়ে চীনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুর মুসলিমদের টার্গেট করে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা না ঘটলেও মূলত উইঘুর মুসলিমরা যেন তাদের জনসংখ্যা বাড়াতে না পারে সেই লক্ষ্যেই কাজ করছে বেইজিং।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি অনানুষ্ঠানিক স্বাধীন ট্রাইব্যুনাল গত ১০ ডিসেম্বর এ রুল দেয়। উইঘুর ট্রাইব্যুনালের রায়ে বলা হয়েছে, সংখ্যালঘু উইঘুর মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর জাতিগত নিধন ও নিপীড়ন চালানোর মানসিকতা থেকেই চীনা কর্তৃপক্ষ তাদের ওপর জন্ম নিয়ন্ত্রণসহ অন্যান্য বাধ্যতামূলক বিভিন্ন পদক্ষেপ চাপিয়ে দিচ্ছে। চীনা কর্তৃপক্ষের এমন পদক্ষেপকে কার্যত গণহত্যা হিসেবেই উল্লেখ করেছে ট্রাইব্যুনাল।
উইঘুর ট্রাইব্যুনালের প্রধান এবং মানবাধিকার বিষয়ক প্রখ্যাত আইনজীবী স্যার জিওফ্রে নাইস বলেন, উইঘুর মুসলিম সংখ্যালঘুদের জনসংখ্যা কমাতে চীনা সরকার তাদের ওপর জন্ম নিয়ন্ত্রণসহ বাধ্যতামূলক নানা পদক্ষেপ চাপিয়ে দিচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, ট্রাইব্যুনালের সবাই প্রশ্নাতীত ভাবেই এ বিষয়ে একমত হয়েছে যে, নানা অমানবিক পদক্ষেপের মাধ্যমে চীনা সরকার উইঘুর মুসলিমদের ওপর গণহত্যা চালিয়েছে।
তার ভাষায়, ‘চীনা সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে নির্দেশনা বা অনুমোদন না পেলে উইঘুর মুসলিমদের ওপর এ ধরনের ব্যাপক দমনপীড়ন চালানো সম্ভব নয়।’
জিওফ্রে নাইস বলেন, ট্রাইব্যুনালের প্যানেল বিশ্বাস করেন, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংসহ দেশটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জিনজিয়াং অঞ্চলে মুসলিম সংখ্যালঘুদের নির্যাতন-নিপীড়নের প্রাথমিকভাবে দায়ভার বহন করেন।
জিওফ্রে নাইস বলেন, জিনজিয়াংয়ে নির্বিচারে মানুষ হত্যার কোনো প্রমাণ তারা পাননি। কিন্তু সেখানে জন্ম রোধের যে কথিত রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টা, তা গণহত্যার শামিল।
ট্রাইব্যুনালের প্যানেল আরও বলেন, তারা উইঘুর জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ, নির্যাতন ও যৌন সহিংসতা সংগঠনের প্রমাণ পেয়েছেন।
উইঘুর মুসলিমদের হত্যা করে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিক্রি
সূত্র মতে, চীনে সংখ্যালঘুদের হত্যা করে তাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিক্রি করা হচ্ছে। এ ঘটনাকে শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ নৃশংসতার সঙ্গেও তুলনা করেছে বিশ্লেষকরা।
অস্ট্রেলিয়ার একটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন জানাচ্ছে, আন্তর্জাতিক চোরাবাজারে বিক্রি হওয়া ওই সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বড় অংশের মালিক চীনের বন্দিশিবিরে আটক হতভাগ্য উইঘুর মুসলিমরা!
আনন্দবাজার পত্রিকা জানায়, জিনজিয়াং প্রদেশের বাসিন্দা উইঘুর মুসলিমদের পাশাপাশি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী তিব্বতি এবং ফালুন গং গোষ্ঠীর বন্দিদের থেকেও জোর করে অঙ্গ সংগ্রহ করা হচ্ছে বলে ওই প্রতিবেদনে অভিযোগ তোলা হচ্ছে।
বলা হয়েছে, একদলীয় শাসনাধীন চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সরকার বেআইনিভাবে বছরে অন্তত ১০০ কোটি ডলারের (প্রায় সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা) অঙ্গপ্রত্যক্ষের ব্যবসা চালাচ্ছে।
চলতি বছরের গোড়াতে কয়েকটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা চিন সরকারদের বিরুদ্ধে উইঘুর, তিব্বতি এবং ফালুন গং বন্দিদের অঙ্গ কেটে বিক্রির অভিযোগ তুলেছিল। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে।
সম্মতি ছাড়াই জোর করে আটককৃতদের রক্ত ও অঙ্গ পরীক্ষা যেমন আলট্রাসাউন্ড, এক্সরে ইত্যাদি পরিচালনা করার নির্ভরযোগ্য তথ্য পেয়েছেন বিশেষজ্ঞ দল। সকল কারাবন্দিদের ক্ষেত্রে এসব পরীক্ষা করানো হয় না।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, মেডিকেল পরীক্ষার এসব ফলাফল অঙ্গদানের জন্য তৈরি ‘লিভিং অর্গান সোর্সে’র তালিকায় নথিভুক্ত করা হয়।
অভিযোগ অনুসারে, বন্দিদের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি নেওয়া অঙ্গগুলোর মধ্যে আছে হৃৎপিণ্ড, কিডনি, লিভার, কর্নিয়া এবং লিভারের কিছু অংশ (অপেক্ষাকৃত কম)।
অঙ্গ-পাচারের এই প্রক্রিয়ায় সঙ্গে সার্জন, এনেস্থেটিস্টসহ চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ ও দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীদের পাশাপাশি বিভিন্ন সরকারি খাতের কর্মকর্তারাও যুক্ত।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, কারাবন্দিদের অনেকে নিজেদের বিশ্বাস ত্যাগ করতে সম্মত না হলে বা পুলিশকে সহযোগিতা করতে রাজি না হলে, তাদের হত্যা এবং অঙ্গ-অপসারণের হুমকি দেয় পুলিশ।
এর আগেও চীনে সংখ্যালঘুদের হত্যা করে তাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিক্রি করা হয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল৷ এ ঘটনাকে শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ নৃশংসতার সঙ্গেও তুলনা করেছে তারা৷
এসডব্লিউ/এসএস/১৫৪০
আপনার মতামত জানানঃ