বেশ বড় একটা সময় জুড়েই বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী বিলুপ্ত হওয়ার খবর নিয়মিতই আসছে। বিপন্ন প্রজাতির তালিকাটাও বেশ দীর্ঘ। বিশেষত বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয় সামনে আসার পর প্রজাতি বিলুপ্তির বিষয়টি সব সময়ই আলোচনায় রয়েছে। এরই মধ্যে ওয়ার্ল্ড ওয়াইডলাইফ ফান্ডের নতুন একটি প্রতিবেদন জানিয়েছে, আগামী ১০ বছরের মধ্যে মানুষের কর্মকাণ্ডে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে ১০ লাখ প্রজাতির প্রাণী। খবর ডয়েচে ভেলে
বিশ্বে আগে কখনো এই ধরনের সংকট আসেনি। একসঙ্গে এত প্রজাতির প্রাণী বিপদগ্রস্ত হয়নি। এই বিপদের মূল কারণ হলো জলবায়ু পরিবর্তন। ওয়ার্ল্ড ওয়াইডলাইফ ফান্ড(ডাব্লিউডাব্লিউএফ)-এর জার্মান শাখা এই বিপদের কথা শুনিয়েছে। তারা একটি তালিকা প্রকাশ করেছে, তার নাম ২০২১ সালের বিজয়ী ও পরাজিতরা। সেখানেই বলা হয়েছে, প্রাণীসংরক্ষণের দিক থেকে কারা জয়ী, কারা বিপদের মুখে।
ডাব্লিউডাব্লিউএফ জার্মানি একটি বিবৃতিতে বলেছে, আগামী দশকে দশ লাখ প্রজাতি বিশ্ব থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে। ডাইনোসর যুগের পর এই প্রথম এত প্রজাতির প্রাণী বিপদের মুখে পড়েছে।
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনসারভেশন অফ নেচার(আইইউসিএন) লাল তালিকা অনুযায়ী, বর্তমানে এক লাখ ৪২ হাজার পাঁচশ প্রাণী ও গাছের প্রজাতি নিশ্চিহ্ন হওয়ার মুখে দাঁড়িয়ে।
ডাব্লিউডাব্লিউএফের ডিরেক্টর জানিয়েছেন, এখন এই প্রাণীকে বাঁচিয়ে রাখতে জরুরি ভিত্তিতে সুরক্ষা নীতি নেয়া দরকার। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে নির্ণায়ক লড়াই করতে হবে। তার মতে, বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী সংরক্ষণের বিষয়টি শুধু একটা পরিবেশগত সমস্যা নয়। এভাবে চলতে থাকলে মানুষও ওই লাল তালিকায় চলে যাবে। তাই জীবনধারণের পদ্ধতি বদল করতেই হবে।
ডাব্লিউডাব্লিউএফের তৈরি করা ২০২১ সালের পরাজিতদের তালিকায় উপরের দিকে আছে আফ্রিকার বুনো হাতি, তাদের সংখ্যা ৩১ বছরে ৮৬ শতাংশ কমেছে।
উষ্ণায়ণের জন্য মেরুতে বরফের স্তর পাতলা হচ্ছে, তাই বিপাকে মেরু ভালুক। বরফ দ্রুত গলছে, কিন্তু ভালুকরা পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারছে না। ডাব্লিউডাব্লিউএফ জার্মানির মতে, ২০৩৫ সালের মধ্যে উত্তর মহাসাগর বা সুমেরু মহাসাগরে বরফ পুরোপুরি গলে যাবে।
জার্মানির ট্রি ফ্রগের সংখ্যাও ৫০ শতাংশ কমে গেছে। তারাও এখন বিপদগ্রস্ত প্রাণী। সমানে বাড়ি তৈরি হওয়ায় এবং জঙ্গলের পরিমাণ কমে যাওয়ায় তাদের এই অবস্থা।
গ্রে ক্রেন বা ধূসর সারসও লাল তালিকায় চলে গেছে।
জার্মানির গ্রেট বাস্টার্ডের সংখ্যা ১৯৯৭ সালে কমে দাঁড়িয়েছিল ৫৭। ২০২১-এ তা বেড়ে হয়েছে ৩৪৭। তারা এই বছর বিজয়ীর তালিকায় আছে।
বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী সংরক্ষণের বিষয়টি শুধু একটা পরিবেশগত সমস্যা নয়। এভাবে চলতে থাকলে মানুষও ওই লাল তালিকায় চলে যাবে। তাই জীবনধারণের পদ্ধতি বদল করতেই হবে।
স্পেন ও পর্তুগালে আবার আইবেরিয়ান লিনক্স দেখা গেছে। ২০০২ সালে মাত্র ৯৪টি লিনক্স ছিল, এখন তার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক হাজার একশতে।
এর আগে বোটানিক গার্ডেন কনভার্সেশন ইন্টারন্যাশনালের (বিজিসিআই) সম্প্রতি প্রকাশিত প্রতিবেদন জানায়, এখন যেসব প্রজাতির গাছ অবশিষ্ট আছে, তার মধ্যে ৩০ শতাংশই বিলুপ্তির হুমকিতে রয়েছে।
ইউরো নিউজ জানায়, পাঁচ বছর গবেষণার পর বিশ্বের ৬০ হাজার প্রজাতির গাছ চিহ্নিত করা হয়, যার মধ্যে ১৭ হাজার ৫০ প্রজাতি বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এতে এটা প্রমানিত হয় যে, বিশ্বে স্থান্যপায়ী প্রাণী, পাখি, উভচর প্রাণী ও সরীসৃপ জাতীয় প্রাণীরা যে হারে বিলুপ্তি ঝুঁকিতে রয়েছে, তার চেয়ে দ্বিগুণ হারে ঝুঁকিতে আছে গাছ।
প্রতিবেদনে জানানো হয়, গাছের ৪৪০টির বেশি প্রজাতি বিলুপ্তির একেবারে দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। এ প্রজাতিগুলোর মাত্র কয়েক সদস্য (৫০টিরও কম) বণাঞ্চলে বিদ্যমান আছে। পৃথিবী থেকে একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে অন্তত ১৪২টি প্রজাতির গাছ।
বিজিসিআই’য়ের এ প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন বিশ্বের ৬০টি প্রতিষ্ঠানের ৫০০ বিশেষজ্ঞ। প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্রাজিলে বিলুপ্তির হুমকিতে পড়া গাছের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। লাতিন আমেরিকার এ দেশটিতে সব মিলিয়ে ৮ হাজার ৮৪৭টি প্রজাতির গাছ রয়েছে, যার মধ্যে ১ হাজার ৭৮৮টি গাছই বিলুপ্তির ঝুঁকিতে।
গবেষকেরা বলছেন, এই বিলুপ্তির পেছনে মানুষ অনেকাংশে দায়ী। প্রাকৃতিকভাবে প্রজাতি বিলুপ্তির গতি শুধু মানুষের উপস্থিতির কারণেই বেড়ে গেছে ৫০০ গুণ। উদাহরণ হিসেবে বলছেন, দক্ষিণ আমেরিকার দেশ চিলি থেকে চন্দনগাছ হারিয়ে গেছে শুধু প্রসাধনকাজে অতিমাত্রায় ব্যবহারের কারণে।
তাদের মতে, এমনকি বিলুপ্ত উদ্ভিদের যে সংখ্যা উঠে এসেছে, তাও বর্তমান বিলুপ্তির গতি বোঝার জন্য যথেষ্ট নয়। কারণ, বর্তমানে মানুষের প্রকৃতি-ধ্বংসী কাজ আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেড়ে গেছে। তবে আশার কথাও আছে। এমন অনেক প্রজাতিরই সন্ধান পাওয়া গেছে, যা বিলুপ্ত বলে ধরে নেওয়া হয়েছিল।
গত ৩০০ বছরে পৃথিবীর মোট বনের ৪০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। ২৯টি দেশ তাদের বনের ৯০ শতাংশ হারিয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রধান সাতটি পণ্য তৈরিতে বিশ্বের অর্ধেকের বেশি বন উজাড় হয়েছে।
পূর্বের এক গবেষণা থেকে জানা যায়, গত আড়াই শ’ বছরের পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে প্রায় ৬০০ প্রজাতির গাছ। এ সংখ্যা একই সময়ে বিলুপ্ত পাখি, স্তন্যপায়ী প্রাণী ও সরীসৃপের মিলিত সংখ্যার দ্বিগুণ।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, সাধারণ ধারণার চেয়ে ৫০০ গুণ দ্রুতগতিতে গাছ বিলুপ্তির ঘটনা ঘটছে। কিন্তু বিষয়টি সেভাবে মনোযোগ পাচ্ছে না। একটি শতকে বিলুপ্ত হওয়া পশুপাখির সম্পর্কে হয়তো মানুষ মোটাদাগে একটি ধারণা রাখে। কিন্তু গাছের ক্ষেত্রে তেমনটি ঘটে না। অনেকেই বলতে পারবে না, কোন গাছটি এখন আর দেখা যায় না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, তাৎক্ষণিক সংকট বাদ দিয়ে ভবিষ্যতের দিকে তাকানো এবং মহৎ ভাবনা মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। মানুষ হিসেবে নিজেদের এই দক্ষতা নিয়ে আমরা গর্বিত। অন্য প্রাণীরা ব্যস্ত থাকে খাবারের অন্বেষণে, নীড়ের খোঁজে অথবা নীড় তৈরির কাজে। সেখানে মানুষ বোঝে সময়ের গুরুত্ব। এই মহাজগতে নিজ অবস্থান খুঁজে নিতে চাই আমরা। অথবা ডাইনোসরের মতো বৃহৎ প্রাণীর অবলুপ্তি কেন ঘটল, সেই প্রশ্ন নিয়ে বিব্রত থাকি। কোনো কোনো সময় আমরাও বাস্তবতা বুঝতে পারি না বা সে চেষ্টা করি না। আমাদের তেমনই ঘাটতি বা অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে বিশ্ব থেকে বহু প্রজাতি বিলুপ্ত হতে চলেছে, যার দায় অনেকাংশেই আমাদের।
তারা বলেন, জনসংখ্যা বাড়ছে। একই সঙ্গে বাড়ছে আমাদের খাদ্যগ্রহণ। এই বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ জলবায়ু পরিবর্তন। এর কারণেই বর্ণহীন হয়ে পড়ছে শৈবাল। আবাস হারাচ্ছে তারা। পরিবেশের জরুরি অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে দায়িত্বপূর্ণ পরিকল্পনা অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে। তবে বন্য জীবনের ক্ষেত্রেও বিশেষ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বনভূমি কেটে পরিষ্কার করে গবাদি পশুর চারণভূমি তৈরি করা হচ্ছে। কীটনাশক ও সারের ব্যবহারে দূষিত হচ্ছে বায়ু, পানি ও মাটি। একই সঙ্গে সমুদ্র ও আমাদের খাদ্যশৃঙ্খলায় ঢুকে পড়েছে প্লাস্টিক। রাষ্ট্রপ্রধানদের উচিত ব্যক্তিগতভাবে এসব ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮০৮
আপনার মতামত জানানঃ