তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে নভেম্বর মাস জুড়ে সারা দেশে পরিবহন ভাড়া ছাড়াও দফায় দফায় বেড়েছে সব ধরনের পণ্য ও সেবার দাম। দ্রব্যমূল্য নিয়ে দরিদ্র জনসাধারণের ত্রাহি অবস্থার মধ্যেই নভেম্বর মাসে দেশে জীবনযাত্রার ব্যয় ৫.৯৮ শতাংশ বেড়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)।
দ্রব্যমূল্যের বাড়তি প্রকৃতি ও জীবনযাত্রার ব্যয় নিয়ে পরিসংখ্যান ব্যুরোর মাসিক প্রতিবেদন গতকাল রোববার প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়েছে, অক্টোবর মাসে মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৫.৭০%। মাসের ব্যবধানে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ০.২৮ শতাংশ পয়েন্ট।
কী উল্লেখ আছে প্রতিবেদনে?
নভেম্বর মাসে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় চালের দাম ১৩%, আটার দাম ৩৭%, তেলের দাম ৪৫% ও ডালের দাম ৩০% পর্যন্ত বেড়েছে বলে দাবি করছে সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)।
বিবিএস-এর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, গত মাসে খাদ্যপণ্যে ৫.৪৩% আর খাদ্য বহির্ভূত খাতে ৬.৮৭ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছে। সব মিলে সার্বিক পয়েন্ট টু পয়েন্ট (আগের বছরের একই সময়ের তুলনায়) মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৫.৯৮ শতাংশে।
প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, নভেম্বর মাসে অক্টোবরের তুলনায় খাদ্য ও খাদ্য বহির্ভূত দুই খাতেই মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। অক্টোবরের ৫.২২ শতাংশ থেকে নভেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ০.২১ শতাংশীয় পয়েন্ট।
আর একই সময়ে ৬.৪৮% থেকে খাদ্য বহির্ভূত খাতের মূল্যস্ফীতি ০.৩৯ শতাংশীয় পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬.৮৭ শতাংশে।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বলছে, নভেম্বর মাসে পল্লী অঞ্চলে মূল্যস্ফীতি ৬.২০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। অক্টোবরে পল্লীতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৫.৮১%। পল্লী অঞ্চলে খাদ্য খাতে ৫.৯০% ও খাদ্য বহির্ভূত খাতে ৬.৭৮% মূল্যস্ফীতি হয়েছে।
অন্যদিকে শহরাঞ্চলে ৫.৫০ শতাংশ থেকে বেড়ে নভেম্বরে মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৫.৫৯ শতাংশে। শহরে খাদ্য খাতে ৪.৩৭% ও খাদ্য বহির্ভূত খাতে ৬.৯৯% মূল্যস্ফীতি হয়েছে নভেম্বরে।
মোভিং এভারেজ পদ্ধতি ব্যবহার করে বিবিএস বলছে, গত ১২ মাসে গড় মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৫.৪৮ শতাংশে। চলতি অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি ৫.৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল সরকার।
২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৫.৭৩%।
প্রসঙ্গত, প্রতি মাসেই সারা দেশে বিভিন্ন পণ্য ও সেবার দাম পর্যালোচনা করে মূল্যস্ফীতির প্রতিবেদন তৈরি করে বিবিএস। মূল্যস্ফীতির মাধ্যমে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় পরিবর্তনের মাত্রা প্রকাশ করা হয়।
নভেম্বর মাসে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ৫.৯৮% মূল্যস্ফীতির অর্থ দাঁড়ায়, গত একবছরে জীবনযাত্রার ব্যয় আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় এ হারে বেড়েছে।
অর্থাৎ, আগের বছরে যে পণ্য কিনতে ১০০ টাকা ব্যয় হতো তা কিনতে এখন ১০৫.৯৮ টাকা বেশি লাগবে। আয় না বাড়লে ৫.৯৮ টাকার পণ্য কম কিনতে হবে।
তবে নভেম্বরে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় শ্রমিকদের মজুরি ৬.০২% বেড়েছে বলেও প্রতিবেদনটিতে জানিয়েছে বিবিএস।
যেভাবে বেড়েছে খাদ্যপণ্যের দাম
গত বছরের নভেম্বরে রাজধানীর বাজারে ৫৫ থেকে ৫৮ টাকায় পাওয়া যেত এক কেজি নাজিরশাইল চাল। গত মাসে একই চালের দাম উঠেছে ৬০-৬৮ টাকা। এক কেজি চালের দাম ৩ থেকে ৮ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
টিসিবির দাম আমলে নিলে ১৩.৩৩% পর্যন্ত বেড়েছে সরু চালের দাম। একইভাবে মোটা চালের দাম বেড়েছে ১০ শতাংশ পর্যন্ত।
আগের বছরে ২৮-৩৪ টাকা কেজি দরের খোলা আটা নভেম্বরে বিক্রি হয়েছে ৩২-৩৮ টাকায়। এ হিসাবে খোলা আটার দাম বেড়েছে ২১.৪৩%।
৩০-৩২ টাকা কেজি দরে বিক্রি হওয়া প্যাকেট আটার দাম উঠেছে ৪০-৪৫ টাকায়। এ আটার দাম কেজিতে ১৩ টাকা বা ৪০% পর্যন্ত বেড়েছে।
৪৫ টাকা বেড়ে ১০০ টাকা লিটারের খোলা তেলের দাম উঠেছে ১৪৫ টাকায়। দাম বৃদ্ধির হার ৪৫ শতাংশ। একইভাবে ভোজ্য তেলের দামও বেড়েছে ৪০ শতাংশ।
তাছাড়া পাম তেলের দাম ৪৫ শতাংশ, মসুর ডালের দাম ৩০ শতাংশ, আমদানি করা পেয়াঁজ ২৯ শতাংশ, আমদানি করা রসুন ৫০ শতাংশ, আদার ৩৭ শতাংশ দাম বেড়েছে।
সব ধরনের মাছের দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি ব্রয়লার মুরগীর দাম বেড়েছে ২৬%। ৯-১৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের গুঁড়া দুধের দাম।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
জ্বালানী তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিভিন্ন পণ্য ও সেবার দাম বৃদ্ধির সঙ্গে পরিসংখ্যান ব্যুরোর মূল্যস্ফীতির তথ্যের সঙ্গতি নেই বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, নভেম্বরের শুরুতে জ্বালানী তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে মাস জুড়ে দফায় দফায় পরিবহন ভাড়ার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের পণ্য ও সেবার দাম বেড়েছে। সরকারের অন্যান্য সংস্থার দাম আমলে নিলে মূল্যস্ফীতি আরও বেশি হবে বলে মনে করছেন তারা।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, পণ্য ও সেবার দাম যে হারে বেড়েছে, পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যে তার প্রতিফলন নেই। এর একটা কারণ হতে পারে যে, সরকারি সংস্থাটি পুরাতন ভিত্তির ওপর নির্ভর করে মূল্যস্ফীতির প্রতিবেদন প্রকাশ করছে।
তিনি বলেন, সময়ের সঙ্গে মানুষের আয় বৃদ্ধির কারণে ভোগের ধরনে পরিবর্তন এসেছে। নতুন নতুন পণ্য ও সেবা মানুষের ভোগের তালিকায় যোগ হয়েছে। এ অবস্থায় ২০ বছরের পুরাতন ভিত্তি ব্যবহার করে মূল্যস্ফীতির সঠিক তথ্য পাওয়া সম্ভব নয় বলেও তিনি মনে করেন।
তিনি আরও বলেন, সরকারি পর্যায়ে তথ্যের ঘাটতি ও অসঙ্গতি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে প্রকৃত অবস্থা সামনে না আসায় সরকারের নীতি প্রণয়নেও সমস্যা হচ্ছে বলে মনে করেন এ অর্থনীতিবিদ।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর মহাপরিচালক মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, পণ্য ও সেবার নির্দিষ্ট বাস্কেটের দামের তথ্য নিয়ে মূল্যস্ফীতির হিসাব করা হয়। এ কারণে কিছু পণ্যের দামবৃদ্ধির বিপরীতে অন্য পণ্যের দাম কমলে মূল্যস্ফীতির খুব একটা পরিবর্তন হয় না।
তিনি আরও বলেন, প্রতি মাসের ১২ থেকে ১৮ তারিখ সময়কালে বাজার দর বিশ্লেষণ করে মূল্যস্ফীতির প্রতিবেদন তৈরি করা হয় বিধায় এর আগে ও পরে দাম বাড়লে মূল্যস্ফীতির তথ্যে তা প্রতিফলিত হয় না।
মূল্যস্ফীতির ভিত্তিবছর অনেক পুরাতন হয়ে গেছে স্বীকার করে তিনি বলেন, ভিত্তিবছর হালনাগাদ করার কাজ চলছে। আগামী বছরের জুন থেকে নতুন ভিত্তি বছর ব্যবহার শুরু হলে তথ্যের অসঙ্গতি কমবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩০০
আপনার মতামত জানানঃ