অং সান সু চি ও তার সরকারের সঙ্গে উত্তেজনা চলছিল মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর, এর ফলে ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারির সকালে মিয়ানমারে একটি সেনা অভ্যুত্থান সংগঠিত হয়। ২০২০ সালের ৮ নভেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি ৮৩ শতাংশ আসনে জয়ী হয়। ২০১১ সালে সেনা শাসনের অবসানের পর এটি ছিল দ্বিতীয় দফা নির্বাচন। তবে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তোলে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। সংকটের শুরুটা মূলত এখান থেকেই।
সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অং সান সু চির নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত ও ক্ষমতার পালাবদলের পর থেকে মিয়ানমারে অস্থিতিশীলতা জারি রয়েছে।এই ঘটনার পর দেশটিতে তীব্র গণ-আন্দোলন শুরু হয় এবং সামরিক ক্ষমতার জোরেই বার্মিজ সেনাবাহিনী তা দমনের চেষ্টা করে। এতে নিহত হচ্ছে শিশু নারীসহ অনেক বেসামরিক মানুষ।
সম্প্রতি মিয়ানমারের কায়াহ রাজ্যে ৩০ জনকে গুলি করে হত্যা করে লাশ পুড়িয়ে দিয়েছে দেশটির সেনাবাহিনী। নিহতদের মধ্যে নারী ও শিশুও রয়েছে।
গণমাধ্যম এবং স্থানীয় মানবাধিকার সংস্থার বরাত দিয়ে শনিবার(২৫ ডিসেম্বর) ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
স্থানীয় মানবাধিকার সংস্থা কারেনি হিউম্যান রাইটস গ্রুপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে বলেছে, আমরা মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী অমানবিক ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানাই।
কায়াহ প্রদেশের এই মানবাধিকার সংস্থা আরও বলছে, তারা প্রুসো শহরের মো. সো গ্রামের কাছে মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন সেনাবাহিনীর হাতে নিহত বৃদ্ধ, নারী ও শিশুসহ অভ্যন্তরীণ ভাবে বাস্তু চ্যুত মানুষের পোড়া মৃতদেহ দেখতে পেয়েছে। শেয়ার করা ছবিতে দেখা যায়, অঙ্গার হয়ে যাওয়া মরদেহ পুড়ে যাওয়া ট্রাকে পড়ে আছে।
সেনা অভ্যুত্থানের বিরোধী সবচেয়ে বড় বেসামরিক মিলিশিয়া গোষ্ঠী কারেনি ন্যাশনাল ডিফেন্স ফোর্স জানিয়েছে, সেনাদের হাতে নিহত এসব ব্যক্তি তাদের দলের সদস্য নয়। এরা আশ্রয়ের সন্ধানে যাওয়া বেসামরিক নাগরিক।
গ্রুপটির কমান্ডার রয়টার্সকে বলেছেন, ‘আমরা দেখে অত্যন্ত মর্মাহত হয়েছিলাম যে, সব মৃতদেহ বিভিন্ন আকারের, যার মধ্যে শিশু, নারী ও বৃদ্ধ রয়েছে।’
মিয়ানমার সেনাবাহিনী বলেছে, তারা ওই গ্রামে বিরোধী সশস্ত্র বাহিনীর অজ্ঞাত সংখ্যক ‘অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীকে’ গুলি করে হত্যা করেছে। এই অস্ত্রধারীরা অন্তত সাতটি গাড়িতে ছিলেন এবং সেনাবাহিনী থামার নির্দেশ দিলেও কর্ণপাত করেনি বলে রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের খবরে জানানো হয়েছে।
আমরা দেখে অত্যন্ত মর্মাহত হয়েছিলাম যে, সব মৃতদেহ বিভিন্ন আকারের, যার মধ্যে শিশু, নারী ও বৃদ্ধ রয়েছে।’
তবে এই হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে মন্তব্যের জন্য তাৎক্ষণিকভাবে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি বলে জানিয়েছে রয়টার্স।
সপ্তাহখানেক ধরেই উত্তপ্ত মিয়ানমার সীমান্ত পরিস্থিতি। দেশটির সীমান্তবর্তী কারেন প্রদেশে নতুন করে বিমান হামলা ও ভারী গোলাবর্ষণ চালিয়েছে জান্তা বাহিনী। মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী সংগঠন কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন কেএনইউ জানায়, বৃহস্পতিবার রাতে প্রদেশটিতে অন্তত দুবার বিমান হামলা চালিয়েছে সামরিক বাহিনী। শুক্রবারও লে কায় কাও শহরে গোলা বর্ষণ করা হয়। পরপর বেশ কয়েকটি বিমান হামলায় নতুন করে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে জনমনে। প্রাণ বাঁচাতে থাইল্যান্ড সীমান্তে আশ্রয়ের খোঁজে ভিড় করছেন হাজার হাজার মানুষ।
এমন পরিস্থিতিতে কারেন যোদ্ধারা লে কায় কাও শহরকে ‘নো ফ্লাই জোন’ ঘোষণার দাবি জানিয়েছে জাতিসংঘের কাছে।
এদিকে মিয়ানমার সেনাবাহিনী দেশটিকে অস্থিতিশীল করতেই এমন উপর্যুপরি হামলা চালাচ্ছে বলে দাবি দেশটির মানবাধিকার সংস্থাগুলোর। খুব শিগগিরই থাইল্যান্ডে ঢুকে পড়া শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন তারা।
এর আগেও সম্প্রতি মিয়ানমারের একটি গ্রামে ১১ জনকে গুলি করে ও পুড়িয়ে হত্যার অভিযোগ উঠেছে দেশটির সেনাদের বিরুদ্ধে।
সাগাইং নামে একটি গ্রামে বর্বর এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে জানিয়েছে রয়টার্স। ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারে সেনা অভ্যুথানের পর সেনাবাহিনীর বিরোধিতা করে দেশটিতে গড়ে ওঠা মিলিশিয়াদের সাথে ওই গ্রামে এর আগে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে।
স্থানীয়রা বলছেন, গুলি করে শরীরে আগুন দেওয়ার সময়ও কয়েকজন জীবিত ছিলেন।
গত ১ ফেব্রুয়ারি সামরিক অভ্যুত্থানে গণতান্ত্রিক সরকারকে হটিয়ে অং সান সু চিকে বন্দি করে সেনাবাহিনী। বিভিন্ন অভিযোগে সু চির বিরুদ্ধে মামলা চলছে এবং এরই মধ্যে দুটি অভিযোগে তাকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এদিকে অভ্যুত্থানের পর থেকে চলমান সহিংসতায় নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে কমপক্ষে এক হাজার ৩০৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১০ হাজার ৬০০ জনকে। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে জান্তাবিরোধী বিক্ষোভকারীদের পাশাপাশি রয়েছে আইনজীবী, মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।
তবে জান্তা সরকারের নির্যাতনের শিকার সবচেয়ে বেশি নারী ও শিশুরা। গেল দশ মাসে অন্তত ৯৮ শিশু ও ৮৯ জন নারীকে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। হত্যার এ ঘটনাকে পূর্ব পরিকল্পিত বলে অভিযোগ উঠেছে জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে।
ক্ষমতাসীন জান্তা বিক্ষোভ দমনে প্রথমে লাঠিচার্জ, টিয়ার শেল, রাবার বুলেট ও জলকামানের ব্যবহার অনুমোদন করলেও এক পর্যায়ে দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করার নির্দেশ দেয়। তারপর থেকেই দেশটিতে বাড়তে শুরু করে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নিহতের সংখ্যা।
নিজ দেশের জনগণের ওপর প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার করে দমনপীড়নের জন্য বিশ্বজুড়ে সমালোচিত হয়েছেন জান্তাপ্রধান হ্লাইং। পশ্চিমা দেশগুলো মিয়ানমারের সেনাসদস্য ও সেনাসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এরপরও কমেনি জান্তার দমনপীড়ন। পাল্টা-আক্রমণের পথ বেছে নিয়েছেন সেনাশাসনের বিরোধীরা। দেশটিতে প্রায় প্রতিদিনই দুই পক্ষের সংঘর্ষ চলছে। এর মধ্য দিয়ে মিয়ানমার দীর্ঘমেয়াদি গৃহযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা বিশ্লেষকদের।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯১৮
আপনার মতামত জানানঃ