করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে বাংলাদেশ সরকার এখনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের সিদ্ধান্তে অটল রয়েছে। তবে এর মধ্যেই সীমিত পরিসরে বিশেষ অনুমতি নিয়ে কিছু কার্যক্রম পরিচালনা করছে মাদরাসা ও ইংরেজি মাধ্যমের প্রতিষ্ঠানগুলো। বাংলা মাধ্যমের কাজ একেবারেই বন্ধ। এ অবস্থায় দেশের অন্যান্য কার্যক্রম পুরো দমেই চলছে। এর মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের (সিডিসি) কান্ট্রি ডিরেক্টর ডা. মাইকেল ফ্রিডম্যান এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ সরকারকে রেস্তোরাঁর পরিবর্তে স্কুল খোলা রাখার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, স্কুলগুলো বন্ধ বা খোলা রাখার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্তে এটি বিবেচনা করা উচিত। যুক্তরাষ্ট্র এবং বৈশ্বিক পর্যায়ে ২৭ বছরের বিবিধ কাজের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন এ বিশেষজ্ঞ বিশ্বব্যাপী চলমান পরিস্থিতির ওপর আলোকপাত করে বলেন, ‘সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীরা আপাতত প্রাপ্তবয়স্ক বা বর্তমান প্রজন্মকে বাঁচতে সহায়তা করার জন্য ভবিষ্যত প্রজন্মকে ধ্বংস হতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।’ বার্তা সংস্থা ইউএনবিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেছেন তিনি।
এ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘স্কুল বন্ধ রেখে কোনো উপকার পাওয়া যাচ্ছে কি না সেটি একটি বড় প্রশ্ন। আপনি যদি আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, স্কুল এবং রেস্তোরাঁর মধ্যে আমি কোনটি বন্ধ রাখার পক্ষে। আমি বলব রেস্তোরাঁগুলো বন্ধ করুন এবং স্কুলগুলো খুলে দিন।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, স্কুলগুলো বন্ধ থাকার ফলে শিশুদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং উন্নতি, পরিবারের আয় ও সামগ্রিক অর্থনীতিতে এর স্পষ্ট নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। ডব্লিউএইচও’র মতে স্কুলগুলো পুনরায় খোলার সিদ্ধান্তের মধ্যে যে বিষয়গুলো বিবেচনা করা উচিত তা হলো- শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা শেষ করতে সহায়তা এবং পরবর্তী ক্লাসে উত্তীর্ণ অব্যাহত রাখা, প্রয়োজনীয় পরিষেবা, পুষ্টি নিশ্চিত করা, শিশু কল্যাণ যেমন শিশুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা প্রতিরোধ, সামাজিক এবং মানসিক সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা, কীভাবে নিজেকে এবং অন্যদের সুরক্ষিত রাখতে হবে সে বিষয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য সরবরাহ, স্কুলে ফিরে না আসার ঝুঁকি হ্রাস এবং সমাজের উপকার করা।
ডা. ফ্রিডম্যান বলেন, শিশুদের কোভিড-১৯ আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম এবং তাদের মাধ্যমে পরিবারের অন্য সদস্যদের সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা আরো কম। এ ছাড়া শিশুদের গুরুতর রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও কম বলে জানান তিনি। এ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, ‘এখানে যদি কোনো শিশু ও প্রাপ্তবয়স্ক কোনো ব্যক্তি বসে থাকে এবং উভয়ই যদি কোভিড আক্রান্ত হয়, তাহলে ওই প্রাপ্তবয়স্কের মাধ্যমে আপনার কোভিড-১৯ আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, শিশুর থেকে নয়।’
চার মহাদেশে বসবাস এবং কাজ করা এ বিশেষজ্ঞ বলেন, এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় এবং সহজ কোনো সিদ্ধান্ত নয় (বিদ্যালয় পুনরায় চালু করা)। শিক্ষা, বিশেষ করে নারী শিক্ষাকে বিশ্বের উন্নত স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মূল কারণ উল্লেখ করে ডা. ফ্রিডম্যান বলেন, আপনি যদি প্রায় পুরো বছরই মানুষকে আর শিক্ষিত না করেন তাহলে ক্ষতির পরিমাণ খুব বেশি। এক বছর ধরে শিশুদের স্কুলে না যাওয়ার জনস্বাস্থ্যের প্রভাবগুলোও আমাদের বুঝতে হবে।
ডা. ফ্রিডম্যান আরও বলেন, ‘অনলাইন শিক্ষা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভালো শিক্ষার্থীদের জন্য কার্যকর। তবে এর বাইরে বিশালসংখ্যক শিক্ষার্থীর জন্য আমার খুব খারাপ লাগছে। ভালো শিক্ষার্থীদের মতো সক্ষমতা এবং সংস্থান তাদের নেই।’ ডা. ফ্রিডম্যান বলেন, মানুষকে সুরক্ষিত রেখেই বাংলাদেশ এখনও রেস্তোরাঁগুলো খোলা রাখার অনুমতি প্রদান এবং ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশে সামাজিক দূরত্ব আরো বেশি কঠিন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘শত ভাগ মানুষের মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত এবং নিয়মিত হাত ধোয়ার নীতি চালু করে আপনার সত্যিই এটি করা সম্ভব।’ এ দুটি কৌশল কঠোরভাবে অনুসরণ করে বাংলাদেশ তার অর্থনীতির চাকা চালু রাখতে পারে।
সিডিসির বিশেষজ্ঞ বলেন, অর্থনীতির চাকা চালু রাখার মধ্য দিয়ে মানুষকে উপার্জনে সহায়তা করার জন্য বাংলাদেশ কিছুটা শিথিলতা চায় এবং এটিই মূল চ্যালেঞ্জ। ‘জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ হিসেবে, মানুষের জীবিকা এবং তাদের সুরক্ষার মধ্যে আমাকে ভারসাম্য বজায় রাখতে হয়। তবে এ ভারসাম্য বজায় রাখা কঠিন,’ বলেন তিনি।
ডা. ফ্রিডম্যান বলেন, এ দুটি ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার এখন পর্যন্ত বেশ ভালো কাজ করেছে। মার্কিন এ বিশেষজ্ঞ বলছেন, প্রথম ঢেউ কেটে যাওয়ার পর দ্বিতীয় ঢেউ আঘাত হানতে পারে। তবে প্রথম ঢেউই আসলে শেষ হয়নি। তিনি বলেন, কোভিডের বর্তমান ঢেউ আরও বৃদ্ধি পেতে পারে কারণ মানুষ নিজের সুরক্ষা নিয়ে কম চিন্তিত। শুধুমাত্র শীতের মৌসুমের কারণে নয়, মানুষের অসচেতনতাই সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলবে।
এ বিশেষজ্ঞ মনে করেন, আবহাওয়া নয়, মানুষের আচরণই সমস্যার বড় কারণ। ‘মহামারি প্রায় শেষের দিকে রয়েছে মনে করে মানষ যদি ভাইরাসটিকে গুরুত্বের সঙ্গে না নেয়, যদি তারা মাস্ক ব্যবহার না করেন, সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতে যান এবং গণপরিবহন ব্যবহার করেন তাহলে তারা কোভিডে আক্রান্ত হতে পারেন এবং ঢেউ আরো বড় হতে পারে। এসব বিষয় একসাথে কোভিড-১৯ সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ তৈরি করতে পারে,’ বলেন তিনি।
কোভিড-১৯ মোকাবিলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্যের বিষয়ে জানতে চাইলে মার্কিন বিশেষজ্ঞ বলেন, এটি বিচার করা কঠিন, তবে সফল কি না তা ইতিহাসই বলে দেবে। তিনি বলেন, ‘এ মুহূর্তে এটি বলা কঠিন কারণ কোভিড-১৯ মেকাবিলায় বিশ্বব্যাপী নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ সফল হয়েছে না কি ব্যর্থ হয়েছে সে বিষয়ে এখনও আমাদের কাছে পর্যাপ্ত তথ্য নেই। তবে এ সংকট থেকে ইতোমধ্যেই শেখার মতো বিষয় পাওয়া গেছে এবং সেটি আমরা জানি।’
এসডাব্লিউ/এমএম/১০১৫
আপনার মতামত জানানঃ