গত কয়েক বছর ধরে চলে আসা অর্থনৈতিক সংকটের সঙ্গে করোনা অতিমারির প্রভাব যোগ হওয়ায় শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি এখন অনেকটাই বিপর্যস্ত। রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্সে ব্যাপকভাবে কমে আসার পাশাপাশি পর্যটন খাতে ধস নেমেছে। চলতি বছর এরই মধ্যে এক বিলিয়ন ডলারের ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে দেশটিকে। ফলে গত জুন মাস শেষে শ্রীলঙ্কার বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ চার বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে, যা দিয়ে তিন মাসের আমদানি ব্যয়ও মেটানো যাবে না।
শ্রীলঙ্কায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ব্যাপক ঘাটতি দেখা দিয়েছে। যার কারণে চা দিয়ে তেলের দাম মেটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশটি। এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে বিবিসি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ৪ বছর আগে ইরানের কাছে থেকে ২৫ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলারের তেল কিনেছিল শ্রীলঙ্কা। সেই দাম এখনো পরিশোধ করেনি দক্ষিণ এশিয়ার দেশটি। এর মধ্যেই দেখা দিয়েছে ভয়াবহ রিজার্ভ সংকট। এ অবস্থায় প্রতি মাসে কিছু পরিমাণে চা পাঠিয়ে মূল্য পরিশোধ করতে চায় লঙ্কান সরকার।
বুধবার (২২ ডিসেম্বর) শ্রীলঙ্কার বৃক্ষরোপণ মন্ত্রী রমেশ পাথিরানা জানান, তারা আগামী জানুয়ারি মাস থেকে ইরানে চা পাঠানো শুরু করতে চান। সেখানে প্রতি মাসে ৫০ লাখ ডলারের চা পাঠানো হবে। এভাবে চললে চার বছর ধরে ঝুলে থাকা লেনদেন পুরোপুরি মেটাতে আরও চার বছরের বেশি সময় লাগবে দেশটির।
তিনি বলেন, অতীতে ইরান থেকে তেল আমদানির একটি ঋণের নিষ্পত্তিতে চা সরবরাহের পরিকল্পনা করছে সরকার। তিনি আরও জানান, শ্রীলঙ্কা ২৫১ মিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধের জন্য প্রতি মাসে ইরানে ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের চা পাঠাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
শ্রীলঙ্কা বর্তমানে গুরুতরভাবে বৈদেশিক মুদ্রা ও ঋণ সংকটের সম্মুখীন। আর এই সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে করোনভাইরাস মহামারি। কারণ দেশটির জাতীয় আয়ের একটি বড় অংশ আসে পর্যটন খাত থেকে, যা এই মহামারির সময়ে উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে।
দেশটির চা বোর্ডের একজন সদস্য জানিয়েছেন, বৈদেশিক ঋণ মেটানোর জন্য এই প্রথম চা বিক্রি করা হচ্ছে।
রমেশ পাথিরানা জানিয়েছেন, অর্থ পরিশোধের পদ্ধতি জাতিসংঘ বা মার্কিন নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করবে না। কারণ মানবিক ভিত্তিতে চা খাদ্যসামগ্রীর অন্তর্ভুক্ত। পাশাপাশি লেনদেনে কালো তালিকাভুক্ত ইরানের কোনো ব্যাংক জড়িত থাকবে না বলেও জানান তিনি।
বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে তিনি বলেন, গত চার বছর ধরে ইরানের কাছ থেকে তেল কেনার বকেয়া অর্থ পরিশোধের জন্য আমরা প্রতি মাসে ৫ মিলিয়ন ডলার মূল্যের চা পাঠাব বলে আশা করছি।
শ্রীলঙ্কা ২৫১ মিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধের জন্য প্রতি মাসে ইরানে ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের চা পাঠাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
দেশটি প্ল্যান্টেশন মন্ত্রণালয় বলছে, প্রস্তাবিত স্কিমটি শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করবে। কারণ এই নিষ্পত্তিটি হবে শ্রীলঙ্কান রুপিতে সিলন চায়ের মাধ্যমে।
তবে, প্ল্যান্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব সিলনের একজন মুখপাত্র লেনদেনের এই পদ্ধতিটিকে ‘সরকারের প্লাস্টার সমাধান’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
মুখপাত্র রোশন রাজাদুরাই বলেন, এটি রপ্তানিকারকদের কোনো উপকারে আসবে না। কারণ এটি মুক্ত বাজার ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিয়ে আমাদের রুপিতেই পরিশোধ করা হবে। ফলে এর মাধ্যমে আমরা উপকৃত হবো না।
আগামী বছরের মধ্যে শ্রীলঙ্কাকে ৪৫০ কোটি ডলারের বকেয়া ঋণ পরিশোধ করতে হবে। দেশটির আন্তর্জাতিক সার্বভৌম বন্ডের মাধ্যমে ৫০০ মিলিয়ন ডলার দিয়ে জানুয়ারিতে এই বকেয়া পরিশোধ কার্যক্রম শুরু হবে।
শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ গত নভেম্বরের শেষের দিকে কমে ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে।
চলতি মাসের শুরুর দিকে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর অজিথ নিভার্দ বলেন, ২০২২ সালের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সব সার্বভৌম ঋণ পরিশোধ করতে পারবে বলে শ্রীলঙ্কা আত্মবিশ্বাসী।
বছরে প্রায় ৩৪০ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন করে শ্রীলঙ্কা। গত বছর দেশটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ২৬৫ দশমিক ৫ মিলিয়ন কেজি চা রপ্তানি করেছে। এর মাধ্যমে দেশটি আয় করেছে প্রায় এক দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার।
শ্রীলঙ্কার মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫ শতাংশই বিলিয়ন-ডলারের এই চা শিল্পে কাজ করেন; যারা পাহাড়ের ঢালে পাতা তোলা এবং কারখানায় চা প্রক্রিয়ার কাজের সাথে জড়িত।
করোনাভাইরাস মহামারির ধাক্কায় ২০২০ সালে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি সংকুচিত হয়েছিল রেকর্ড ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। এসময় তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও ঘাটতি দেখা দেয়। ২০১৯ সালে যেখানে শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল সাড়ে সাতশ কোটি ডলার, তা কমতে কমতে চলতি বছরের জুলাইয়ে এসে দাঁড়ায় মাত্র ২৮০ কোটি ডলারে।
এ অবস্থায় বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের লক্ষ্যে গত বছরের মার্চ মাসে গাড়ি, ভোজ্যতেল, হলুদসহ বেশ কিছু পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করে লঙ্কান সরকার। স্থানীয় আমদানিকাররা জানিয়েছেন, তারা ডলার জোগাড় করতে না পারায় খাদ্য-ওষুধের মতো অনুমোদিত পণ্যও কিনতে পারছেন না। লঙ্কান জ্বালানিমন্ত্রী উদয় গামনপিলা গাড়িচালকদের কম জ্বালানি তেল ব্যবহারের অনুরোধ জানিয়েছেন, যেন সেখান থেকে বৈদেশিক মুদ্রা বাঁচিয়ে প্রয়োজনীয় ওষুধ ও টিকা কেনা যায়।
বাস্তব চিত্র হলো শ্রীলঙ্কায় মূল্যস্ফীতি এরই মধ্যে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এরই মধ্যে দেশটিতে প্রধান খাদ্যপণ্য চালের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গিয়েছে। পরিস্থিতি সামলাতে বর্তমানে মিলারদের সঙ্গে সহযোগিতার ভিত্তিতে চালের সর্বোচ্চ মূল্য নির্ধারণ করে দেয়ার কথা ভাবছে শ্রীলঙ্কার সরকার। একই সঙ্গে বাড়তি দামে চাল বিক্রির অভিযোগ প্রমাণ হলে শাস্তির মাত্রা বাড়ানোরও পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
মুদ্রা সংকট শ্রীলঙ্কাকে এখন মারাত্মক এক সমস্যার দিকে ঠেলে দিয়েছে। ডলারের অভাবে দেশটিতে ক্রমেই আমদানি সংকুচিত করে আনা হয়েছে। কলম্বোর কেন্দ্রীয় ব্যাংকও এখন আর আমদানিকারকদের জন্য কোনো ডলার ইস্যু করছে না। একই সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও ব্যবহার করা হচ্ছে রেশনিংয়ের ভিত্তিতে। একই সঙ্গে দেশটিতে একই সময়ে সমান্তরালে ভিন্ন বিনিময় হারের উপস্থিতিও দেখা যাচ্ছে।
শ্রীলঙ্কায় এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে বৈধভাবে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ফলে দেশটিতে এখন ডলারের বিকল্প উৎস হয়ে উঠেছে কালোবাজার।
২০০৩ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত শ্রীলঙ্কা ভালো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করে। কিন্তু এরপর থেকেই দেশটির অর্থনীতি নানা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। করোনাভাইরাসের প্রভাবে অর্থনীতির এই সংকট চরম আকার ধারণ করেছে।
২০২০ সালে ৩ দশমিক ৭ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি)। বাজেট ঘাটতি বেড়ে জিডিপি ১১ শতাংশ ছাড়িয়েছে। বড় ধরনের টান পড়েছে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভে। এ ছাড়া ডলারের বিপরীতে মুদ্রার মান কমে যাওয়ার পাশাপাশি বেড়ে গেছে বিদেশি ঋণ। চরম এই সংকট কাটাতে বিভিন্ন দেশ থেকে ইউএস ডলার ধার করছে তারা। এমন পরিস্থিতিতে সম্প্রতি বাংলাদেশের কাছ থেকেও এ ধরনের সহায়তা চায় শ্রীলঙ্কা।
এদিকে এই কঠিন মুহূর্তে শ্রীলংকার পাশে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। শ্রীলঙ্কাকে মোট ২০ কোটি ডলার দিতে চেয়েছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে প্রথম দফায় গত ১৯ আগস্ট পাঁচ কোটি ডলার দেওয়া হয়। এরপর পাঠানো হয়েছে আরো ১০ কোটি ডলার।বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, নিউইয়র্কের ফেডারেল ব্যাংক থেকে রিজার্ভে থাকা অর্থ থেকে শ্রীলঙ্কার জন্যে ছাড় দেয়া হয়।
তবে শ্রীলঙ্কাকে দেওয়া এই সাহায্য সরাসরি অনুদান কিংবা ঋণ নয়। ২০ কোটি ডলারের বদলে শ্রীলঙ্কা সমপরিমাণ রুপি বাংলাদেশকে দেবে। এর সঙ্গে কিছু সুদও পাবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এটিকে বলা হয় ‘কারেন্সি সোয়াপ’ নীতি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০১৪
আপনার মতামত জানানঃ