করোনাভাইরাসের তাণ্ডবে বিপর্যস্ত ভারত। করোনা সংক্রমণের মধ্যেই ভারতে জিকা ভাইরাসের সংক্রমণ আতঙ্ক তৈরি করেছে। ইতোমধ্যে ১০০ বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে সে দেশে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশেও এই ভাইরাসের ভয়াবহ ঝুঁকির শঙ্কা করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, এডিস মশা জিকা ভাইরাসের বাহক। সেই একই মশা ডেঙ্গু ছড়ায়। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্টরা যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। এ ছাড়া রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট ছাড়া দেশের অন্য কোনো হাসপাতালে জিকা শনাক্ত করার কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই করোনা ও ডেঙ্গুর ব্যাপকতার মধ্যে দেশে জিকা ভাইরাস দেখা দিলে মহাবিপদ দেখা দেবে।
ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়ার মতো জিকা ভাইরাসও মশাবাহিত। সংক্রমিত এডিস মশার কামড়ে ছড়ায় এ সংক্রমণ। এ রোগে, জ্বর, চুলকানি, পেশি, গাঁটে ব্যথা, মাথা ব্যথা, চোখ লাল হয়ে যাওয়াসহ সাধারণ ফ্লুর মতো উপসর্গ দেখা দেয়। কিন্তু আক্রান্ত হওয়ার পর অনেক সময় প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষের ক্ষেত্রেই কোনো উপসর্গ দেখা যায় না। যারা সক্রিয় জিকা সংক্রমণের এলাকায় বাস করেন বা ভ্রমণ করেন তাদেরই জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ভারতের কানপুর সম্প্রতি মশা-বাহিত এই রোগের হটস্পট হয়ে উঠেছে। শহরজুড়ে জারি করা হয়েছে সতর্কতা। জিকা সংক্রমণ রোধে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ নিয়ন্ত্রণ অভিযান চালু করেছে।
কেন্দ্র থেকেও সেখানে বিশেষ দল পাঠানো হয়েছে৷ স্থানীয় স্বাস্থ্য বিভাগ ৫২৫ জনের নমুনা সংগ্রহ করেছে। এরা কোনো না কোনো সময় সংক্রমিতদের সংস্পর্শে ছিলেন। কানপুরের প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তা জানিয়েছেন, রোগটি ছড়িয়ে পড়া রোধ করতে বেশ কয়েকটি টিম তৈরি করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ।
কানপুরে গত ২৩ অক্টোবরে ভারতীয় বিমানবাহিনীর এক ওয়ারেন্ট অফিসার জিকা আক্রান্ত হওয়ার পর আশপাশের এলাকায় থাকা বিভিন্ন মানুষের দেহ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে তা পরীক্ষার জন্য পাঠানো হলে আরও ৩০ জনের শরীরে জিকা ভাইরাস ধরা পড়ে।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের সামাল দিতে ভারত যখন হিমশিম খাচ্ছে, তখনই নতুন করে এই জিকা ভাইরাসের প্রকোপ দেখা দিল।
উগান্ডায় ১৯৪৭ সালে বানরের দেহে প্রথমবারের মতো জিকা ভাইরাস চিহ্নিত হয়েছিল।মানবদেহে এর প্রথম সংক্রমণ শনাক্ত হয় ১৯৫৪ সালে নাইজেরিয়ায়। এরপর থেকে আফ্রিকা, দক্ষিণপূর্ব এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপগুলোতে জিকা ভাইরাসের প্রকোপ দেখা দিয়েছে।
১৯৪৭ সালে প্রথমবারের মতো আবিষ্কৃত মশা-বাহিত ভাইরাস জিকা ভাইরাস ২০১৫ সালে ব্রাজিলে মহামারি আকারে পৌঁছায়। ওই সময় দেশটিতে হাজার হাজার শিশুর জন্ম হয় মাইক্রোসেফালি নিয়ে। এই রোগে আক্রান্ত শিশুদের মাথা অস্বাভাবিক ছোট এবং মস্তিষ্ক শুকিয়ে ছোট হয়ে যায়। সংক্রমিত এডিস মশার কামড়ের মাধ্যমে সংক্রমণ ছড়ায়।
এডিস মশা জিকা ভাইরাসের বাহক। সেই একই মশা ডেঙ্গু ছড়ায়। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্টরা যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। এ ছাড়া রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট ছাড়া দেশের অন্য কোনো হাসপাতালে জিকা শনাক্ত করার কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই করোনা ও ডেঙ্গুর ব্যাপকতার মধ্যে দেশে জিকা ভাইরাস দেখা দিলে মহাবিপদ দেখা দেবে।
জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে মৃত্যুর ঘটনা বিরল। যারা আক্রান্ত হন তাদের পাঁচজনের মধ্যে মাত্র একজনের শরীরের এর উপসর্গ দেখা দেয়। এসব উপসর্গের মধ্যে রয়েছে- হালকা জ্বর, চোখ জ্বালাপোড়া কিংবা লাল হয়ে যাওয়া, মাথাব্যথা, হাড়ের জোড়ায় ব্যথা এবং ত্বকে ফুসকুড়ি দেখা দেওয়া।
জিকা ভাইরাসের চিকিৎসায় এখনো পর্যন্ত কোনো ওষুধ আবিষ্কার হয়নি। নেই কোনো টিকাও। ১৯৪৭ সালে উগান্ডার জিকা জঙ্গলে প্রথম এই ভাইরাস পাওয়া গেছিল। কিন্তু তারপর এত দিন কেটে গেলেও কোনো ওষুধ বা টিকা আবিষ্কার হয়নি।
২০১৩ সালে সিলেটে জিকার অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছিল। তখন স্বাস্থ্য বিভাগে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। তখন বিমানবন্দর, নৌ-বন্দর, স্থলবন্দরসহ বৈদেশিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোয় কড়া নজরদারির ব্যবস্থা নেয়া হয়। তবে এরপর এ বিষয়ে আর কোনো দৃশ্যমান সতর্কতা চোখে পড়েনি।
চিকিৎসকরা বলছেন, উদ্বেগজনক বিষয় হচ্ছে, এই ভাইরাস প্রতিরোধে এখনও টিকা বা ওষুধ আবিষ্কার হয়নি। যেহেতু এই রোগ মশাবাহিত, তাই এর প্রাদুর্ভাব রোধ করতে অবিলম্বে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। সেইসঙ্গে কারও শরীরে লাল লাল বিন্দু দেখা দিলে, জ্বর জ্বর ভাব, মাথা ব্যথা, পেশীতে যন্ত্রণা, বমি ভাবের উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত সরকারি হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
এ বিষয়ে জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সদস্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য (ভাইরোলজিস্ট) অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘জিকা ভাইরাসের ঝুঁকি অবশ্যই রয়েছে। ভারতে যে সময় এই রোগের প্রকোপ দেখা দিয়েছে, ঠিক সেই সময় ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সব ধরনের ভ্রমণ ভিসা চালু হয়েছে। এটা অবশ্যই উদ্বেগের। এখনই যদি স্বাস্থ্য বিভাগ সর্তক না হয়, সামনে মহা বিপদ অপেক্ষা করছে। দেশে করোনা ও ডেঙ্গুর প্রকোপ রয়েছে। এর মধ্যে জিকা ভাইরাস দেখা দিলে সামাল দেয়া কষ্ট হয়ে যাবে।’
স্বাস্থ্য বিভাগের প্রস্তুতি কোনো কাজে আসে না জানিয়ে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘মহামারি করোনা ও ডেঙ্গু মোকাবিলায় স্বাস্থ্য বিভাগের প্রস্তুতি দেখেছি। তারা মুখে প্রস্তুতির কথা বললেও বাস্তবে তেমন কিছু চোখে পড়ে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘শহর-গ্রামগুলোয় এডিস মশার ঘনত্ব বেড়ে গেছে। ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার সঙ্গে এই ভাইরাস যদি বাংলাদেশে আসে, তাহলে ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করতে পারে। প্রতিবেশী নেপালেও এটি দেখা দেয়ায় বাংলাদেশ বড় ঝুঁকিতে।’
বিমানবন্দরে জিকা ভাইরাস শনাক্তকরণ স্ক্যানিং মেশিন বসানোর আহ্বান জানান এই বিশেষজ্ঞ।
রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ এস এম আলমগীর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দেশে প্রথম জিকা ভাইরাস শনাক্ত হয় ২০১৩ সালে। এরপর এমন কোনো কেস পাওয়া যায়নি। প্রতিনিয়ত এই ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স করা হচ্ছে। বিমান বন্দরে স্ক্যানিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে।’
ভারতে এই ভাইরাস উদ্বেগজনক হারে বাড়লেও আইইডিসিআর-এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ঝুঁকি দেখছেন না। তিনি বলেন, ‘ভারতে এর আগেও একবার জিকা ভাইরাসের প্রকোপ দেখা দিয়েছিল। তখনও আমরা এ বিষয়ে সর্তক ছিলাম। আর যেহেতু এই ভাইরাস এডিস মশার মাধ্যমে ছড়ায়, তাই ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়ার সঙ্গে জিকা পরীক্ষারও ব্যবস্থা রয়েছে।
‘২০১৩ সালের পর এখন পর্যন্ত এই ভাইরাসের অস্তিত্ব এখানে পাওয়া যায়নি। তবে আইইডিসিআর এ বিষয়ে সর্তক অবস্থানে রয়েছে। যদি জিকা ভাইরাসে নমুনা কারও দেহে শনাক্ত হয়, তাহলে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে। আইইডিসিআর এ বিষয়ে সকল প্রস্তুতি নিয়ে রাখছে। এ বিষয়ে চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণও দেয়া রয়েছে। সার্বিক প্রস্তুতি রয়েছে।’
তিনি জানান, এই ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি সহজে মারা যায় না। তবে সমস্যা হলো ৯৫ শতাংশ মানুষ উপসর্গ ছাড়া এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। আর একটি বড় সমস্যা হলো, এই ভাইরাসে যদি গর্ভবর্তী মা আক্রান্ত হন, তাহলে নবজাতকের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়, মাথার আকার ছোট হয়ে যায়। তবে আশার বিষয়, এখনও এখানে গত পাঁচ/ছয় বছরে কোনো রোগী পাওয়া যায়নি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মশা দ্বারা সংক্রমিত অন্যান্য ভাইরাসের (যেমন, ডেঙ্গু) তুলনায় এই ভাইরাসে আক্রান্ত মশা গর্ভবতী মহিলাদের কামড়ালে গর্ভের শিশুর মাইক্রোসেফালি হতে পারে এবং অন্যান্য মস্তিষ্ক-সংক্রান্ত জটিলতা দেখা দিতে পারে; পঙ্গুত্ব বা কম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে জন্মানো শিশুরা পরবর্তিতে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে না। অর্থাৎ এই ভাইরাস পরবর্তী প্রজন্মের স্বাস্থ্যের জন্য অনেক বেশি ভয়ঙ্কর।
তারা বলেন, এখন পর্যন্ত এই ভাইরাসের জন্য কোনও টিকা অথবা ওষুধ নেই। তাই প্রতিরোধই একমাত্র ভরসা। মশার কামড় না খাওয়া (মশারি ব্যবহার করা এবং দীর্ঘ পোশাক পরা), মশার বংশবিস্তার রোধ করা (জমাট পানি যেমন টবে জমানো পানিতে মশা বংশবিস্তার করতে পছন্দ করে) প্রয়োজন। এই ভাইরাস বাতাসবাহিত নয়, অর্থাৎ বাতাসের মাধ্যমে অথবা আক্রান্ত ব্যক্তির পাশাপাশি বা সংস্পর্শে এলেই ভাইরাস সংক্রামিত হবে না, তবে আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তগ্রহণ অথবা আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে যৌনমিলনের ফলে সংক্রামিত হয় (যা ডেঙ্গু ভাইরাসের ক্ষেত্রে হয় না)।
সাধারণত ৫-১২ দিনের মধ্যে উপসর্গগুলো এমনিতেই সেরে যায়, তবে ভাইরাসটি দীর্ঘদিন (প্রায় ৭২-৯০ দিন পর্যন্ত) আক্রান্তের শরীরে টিকে থাকতে পারে। তবে আক্রান্ত ব্যক্তির উচিত পর্যাপ্ত বিশ্রাম গ্রহণ, প্রচুর পানি ও সুষম খাবার খাওয়া। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবনও করা যায় উপসর্গ দেখা দিলে।
তারা আরও বলেন, এমন-ও হতে পারে যে বাংলাদেশ বা কিছু দেশের মানুষের মধ্যে ইতোমধ্যে জিকা ভাইরাসের বিরুদ্ধে অনাক্রম্যতা রয়েছে। তাই এইসব দেশে বিস্তারের গভীর আশঙ্কা থাকলেও ব্যাপারটি মহামারি আকার ধারণ করবে না, আমরা এটি আশা করতে পারি। কিন্তু একইসঙ্গে আমাদের সচেতন থাকবে হবে অন্যান্য আশঙ্কা সম্পর্কে এবং সেইসব ক্ষেত্রে কী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার সেই সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা প্রয়োজন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৩৩
আপনার মতামত জানানঃ