সারা বিশ্বের মানুষ এখন করোনাভাইরাস আতঙ্কে। এই ভাইরাস একেক জনের দেহে এত বিচিত্র এবং ভিন্ন ভিন্ন উপসর্গ সৃষ্টি করে, যা বিজ্ঞানীদের বিস্মিত করছে। করোনা আক্রান্ত অনেকে অত্যন্ত দ্রুত গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ছেন, আবারও কারো শরীরে দেখা যাচ্ছে খুবই মৃদু উপসর্গ। আবার অনেকের করোনা পজিটিভ নিশ্চিত হওয়ার পরও কোনো উপসর্গ দেখা যাচ্ছে না।
এ পরিস্থিতিতে একটা প্রশ্ন বারবারই ঘুরে ফিরে আসছে যে, করোনাভাইরাসে গুরুতর অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি কার ক্ষেত্রে কতটা? এটা কি আগে থেকে অনুমান করা এবং সে অনুযায়ী সতর্ক হওয়া সম্ভব?
বিষয়টি নিয়ে অনেক গবেষণা চলছে। প্রতিনিয়তই বিভিন্ন দিকের ওপর আলোকপাত করছেন বিজ্ঞানীরা। সম্প্রতি এক গবেষণায় বলা হচ্ছে, মানুষের ‘জিন’-এর সাথে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকির সম্পর্ক আছে।
করোনাভাইরাস সংক্রমণে ফুসফুস বিকল হওয়াসহ মৃত্যুঝুঁকি দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিতে ভূমিকা রাখে একটি ‘জিন’। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল বিজ্ঞানী এমন একটি জিনের সন্ধান পেয়েছেন। তাদের গবেষণা বলছে, দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূতদের মধ্যে ৬০ শতাংশের শরীরে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এ ধরনের জিন রয়েছে। তবে করোনার টিকা এ ঝুঁকি উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমিয়ে দেয়।
বিবিসির খবরে বলা হয়, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা তাদের ‘দ্য নেচার জেনেটিকস’ গবেষণায় দেখতে পেয়েছেন, দক্ষিণ এশিয়ার বংশোদ্ভূত ৬০ শতাংশ এবং ইউরোপীয় বংশোদ্ভূতদের ১৫ শতাংশ মানুষের শরীরে ‘এলজেডটিএফএলওয়ান’ নামের উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ জিনটি রয়েছে। কেন যুক্তরাজ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার কিছু সম্প্রদায়ের মানুষ করোনার উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন, সে দিকটি সামনে এনেছে এ গবেষণা। তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানানো হয়নি।
জিন নিয়ে আগের করা কিছু কাজের ওপর ভিত্তি করে গবেষকেরা এ জিন চিহ্নিত করতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও নতুন জৈবাণুপ্রযুক্তি ব্যবহার করেছেন।
গবেষণা দলের প্রধান অধ্যাপক জেমস ডেভিস বলেন, এ ঝুঁকিপূর্ণ জিনের ধরনটি সব মানুষের শরীরে সমানভাবে কাজ করে না, যা খুব গুরুত্বপূর্ণ। বয়সসহ নানা কারণে ঝুঁকির মাত্রা কম–বেশি হয়। নির্দিষ্ট জাতিগোষ্ঠীর মানুষই বেশি আক্রান্ত হচ্ছে কেন, এর পেছনে কারণ ব্যাখ্যা করতে গেলে আর্থসামাজিক দিকটিও বিশ্লেষণ করে দেখা গুরুত্বপূর্ণ।
জেমস ডেভিস বলেন, ‘যদিও আমরা আমাদের জিন পাল্টাতে পারব না, কিন্তু আমাদের গবেষণার ফলে দেখা গেছে এ ধরনের জিনবাহক ব্যক্তিরা টিকা থেকে বিশেষ উপকার পেয়েছেন।’
গবেষকদের ধারণা, জিনের এ ধরন করোনাভাইরাসে ফুসফুস সংক্রমণ সহজ করে দেয়। তারা বলছেন, এটি ফুসফুস কোষের প্রতিরোধব্যবস্থাকে সক্রিয় থাকতে দেয় না।
সাধারণত করোনাভাইরাসের সংস্পর্শে এলে ফুসফুসের কোষগুলো প্রতিবন্ধকতা গড়ে তোলে। কিন্তু যাদের শরীরে এলজেডটিএফএলওয়ান নামের জিনটি রয়েছে, তাদের শরীরে স্বাভাবিক প্রতিরোধব্যবস্থা কাজ করে না।
গবেষকেরা বলছেন, এটি গুরুত্বপূর্ণ যে জিনটি ফুসফুসকে আক্রান্ত হতে দিলেও শরীরের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থায় কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না। এর মানে উচ্চ ঝুঁকির এই জিনবাহী মানুষেরাও টিকা থেকে সুরক্ষা পেতে পারেন।
গবেষকেরা আশা করছেন, তাদের এ আবিষ্কার ফুসফুসকে প্রাধান্য দিয়ে নতুন ওষুধ তৈরিতে সহায়তা করবে। বর্তমানে বাজারে থাকা বেশির ভাগ ওষুধই রোগ প্রতিরোধব্যবস্থাকে প্রাধান্য দিয়ে তৈরি করা।
নভেল করোনাভাইরাস যে বয়স, লিঙ্গ, এমনকি জাতিভেদে কম বা বেশি প্রাণঘাতী হতে পারে, তা এত দিনে প্রায় সবাই জেনে গেছেন। দেখা গেছে, নারীদের চেয়ে পুরুষের মৃত্যুহার বেশি। শিশুদের সংক্রমণ এবং মৃত্যুহার অনেক কম। এমনকি জাতিভেদেও রোগের লক্ষণ কম বা বেশি গুরুতর হচ্ছে। বিষয়টি একেবারে নতুন নয়। কিছু কিছু রোগ আছে নির্দিষ্ট জাতির মানুষের মধ্যে বেশি বিস্তার করে। যেমন ‘সিকল সেল ডিজিজ’ আফ্রিকান ও মেডিটেরেনিয়ানদের মধ্যে বেশি, ‘সিস্টিক ফাইব্রোসিস’ রোগটি ইউরোপীয়দের মধ্যে বেশি দেখা যায়।
এদিকে ইউরোপে নতুন করে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় ‘গভীর উদ্বেগ’ সৃষ্টি করেছে। করোনার প্রকোপ বাড়তে থাকলে আশঙ্কা করা হচ্ছে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির মধ্যে মহাদেশটিতে আরো ৫ লাখ মানুষের মৃত্যু হতে পারে। এভাবে বাড়তে থাকলে ইউরোপ আবারও করোনাভাইরাস মহামারির কেন্দ্র হতে পারে বলে সতর্ক করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)।
ইউরোপজুড়ে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এমন আশঙ্কা করা হয়েছে বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে বিবিসি।
ডব্লিউএইচওর ইউরোপবিষয়ক প্রধান হ্যান্স ক্লুজ বলছেন, ইউরোপের ৫৩টি দেশ এবং মধ্য এশিয়া অঞ্চলের দেশগুলো আগামী সপ্তাহগুলোতে করোনাভাইরাস মহামারি পুনরুত্থানের প্রকৃত হুমকির সামনে বা ইতোমধ্যে সংক্রমণের নতুন ঢেউয়ের সম্মুখীন হচ্ছে।
ক্লুজ জানান, বিশ্ববাসী ফের মহামারি শুরু হওয়ার পয়েন্টে রয়েছে। এক বছর আগের মতো ইউরোপ আবারও মহামারির উৎসকেন্দ্রে পরিণত হতে চলেছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। এই পরিস্থিতির জন্য তিনি যথেষ্ট পরিমাণ টিকা না থাকাকে দোষারোপ করেন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪০০
আপনার মতামত জানানঃ