প্রায় সাড়ে চারশ কোটি বছরের ইতিহাসে পৃথিবী কখনও হালকা, কখনওবা বেশি গরম অবস্থা ধারণ করেছে৷ সূর্যের চারপাশে পৃথিবী ঘোরার সময় যখন তার অবস্থান সূর্যের কাছে এসেছে তখন পৃথিবী বেশি গরম ছিল, আর যখন সূর্য আর পৃথিবীর মধ্যে দূরত্ব বেশি ছিল, তখন পৃথিবী অপেক্ষাকৃত ঠাণ্ডা ছিল৷
১৯৯৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা এক হাজার বছরের বার্ষিক গড় তাপমাত্রা বিবেচনা করে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেন৷ এতে দেখা যায়, কয়েকশ বছর ধরে তাপমাত্রায় তেমন পরিবর্তন না হলেও বিংশ শতাব্দীতে এসে তা অনেক বেড়ে গেছে৷
এরপর ২০১৩ সালে ‘সায়েন্স’ জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় ১১ হাজার বছরের তথ্য ব্যবহার করা হয়৷ সেখানেও প্রায় একই রকম ফল পাওয়া যায়৷ অর্থাৎ সবশেষ বরফ যুগ শেষ হওয়ার পর গত শতকে পৃথিবী আগের যে-কোনো সময়ের তুলনায় দ্রুত গরম হয়েছে৷
এই গবেষণায় আরও বলা হয়, গত দুই হাজার বছরে পৃথিবী সূর্যের কাছাকাছি ছিল৷ ফলে এই সময়টা মোটামুটি ঠাণ্ডা থাকার কথা৷ কিন্তু তাপমাত্রা অপ্রত্যাশিতভাবে বেশি থাকার কারণে ঠাণ্ডা অবস্থাটা বোঝা যায়নি৷
অতীতে কখনো এতো উষ্ণ ছিল?
জলবায়ু পরিবর্তনের মতো ভয়ংকর সংকটের মুখোমুখি আধুনিক পৃথিবী খুব কমই হয়েছে। তবে এই উষ্ণতা কিন্তু অতি সাম্প্রতিক কোনো ঘটনা নয়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, শিল্প যুগের প্রাক-মুহূর্ত থেকে আমাদের এই গ্রহ খুব দ্রুত উষ্ণ হয়ে যাচ্ছে।
সেই ১৮৫০ সালের পর থেকে পৃথিবীর পৃষ্ঠের তাপমাত্রা গড়ে ১.১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের পর থেকে গত চার দশকের প্রত্যেক দশকে তাপমাত্রা ক্রমাগতই বৃদ্ধি পেয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সংগৃহীত লাখ লাখ তথ্য বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা এই উপসংহারে পৌঁছেছেন।
অতীতে পৃথিবীর তাপমাত্রা কীভাবে ওঠা নামা করেছে বিজ্ঞানীরা সেটাও খুঁজে বের করতে পারেন। গাছের কাণ্ড, বরফের স্তর, হ্রদের তলানিতে জমা পলি এবং প্রবাল এসবই অতীতে জলবায়ু কেমন ছিল তার সাক্ষ্য বহন করছে। তবে বর্তমানে যে হারে পৃথিবী উত্তপ্ত হয়ে উঠছে এসব থেকে পাওয়া যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ থেকে বিজ্ঞানীরা হিসেব করে বলছেন, গত সোয়া এক লাখ বছরের মধ্যে পৃথিবী এতো উত্তপ্ত আর কখনো ছিল না।
গাছের কাণ্ড এবং মেরু অঞ্চলের বরফ; এই দুটোই বায়ুমণ্ডলে রাসায়নিক পরিবর্তনের রেকর্ড বহন করে। এসব পরীক্ষা করে দেখা গেছে ১৮৫০ সালের পর থেকে, বিশেষ করে জীবাশ্ম জ্বালানির কারণে কার্বনের নির্গমন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়ে গেছে।
বিশ্লেষণে দেখা গেছে আট লক্ষ বছর ধরে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ ১০ লাখে ৩০০ পার্টসের বেশি (পার্টস পার মিলিয়ন বা পিপিএম) বৃদ্ধি পায় নি। কিন্তু শিল্প বিপ্লবের পর কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে বর্তমান মাত্রায় এসে দাঁড়িয়েছে যা ৪২০ পিপিএম।
জলবায়ু মডেল অর্থাৎ কম্পিউটার সিমুলেশন ব্যবহার করে দেখানো হয়েছে মানুষের কর্মকাণ্ডের কারণে যদি ব্যাপক হারে গ্রিনহাউজ গ্যাসের নির্গমন না ঘটতো তাহলে তাপমাত্রার কী হতো। এসব পরীক্ষায় দেখা গেছে যে, এরকম হলে বিংশ ও একবিংশ শতাব্দীতে তাপমাত্রা খুব সামান্যই বৃদ্ধি পেত। কিছু ঠাণ্ডা হওয়ারও সম্ভাবনা ছিল।
এরকম হতো যদি শুধু প্রাকৃতিক কারণগুলোই জলবায়ুর ওপর প্রভাব রাখতো। কিন্তু যখন মানুষের কারণগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হলো, জলবায়ু মডেলে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি লক্ষ্য করা গেছে। পৃথিবী ইতোমধ্যে যে মাত্রায় উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে তার ফলে আমাদের চারপাশে অনেক বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটবে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
বিবিসির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, পৃথিবীর ইতিহাসে বেশ কয়েকবারই সময় এসেছে যখন এই গ্রহটি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল। এখন থেকে নয় কোটি ২০ লাখ বছর আগে পৃথিবীর তাপমাত্রা এতো বেশি ছিল যে মেরু অঞ্চলে বড় আকারের কোনো বরফের খণ্ড ছিল না। ক্যানাডিয়ান আর্কটিকের মতো উত্তরাঞ্চলে কুমিরের মতো কোন প্রাণীরও অস্তিত্ব ছিল না। তবে তখনও মানুষের আবির্ভাব ঘটেনি।
এছাড়াও অতীতে কখনও কখনও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বর্তমানের চেয়ে ২৫ মিটার (৮০ফুট) উঁচু ছিল। যেখানে বিজ্ঞানীরা বলছেন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা পাঁচ থেকে আট মিটার (১৬ থেকে ২৬ ফুট) বৃদ্ধি পেলে পৃথিবীর বেশিরভাগ উপকূলীয় শহরই পানির নিচে তলিয়ে যাবে।
অতীতের যে সময়গুলোতে তাপমাত্রা বেশি ছিল তখন গণহারে পশুপাখি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার প্রচুর তথ্যপ্রমাণ রয়েছে। জলবায়ু মডেল বলছে, গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এলাকায় কখনও কখনও তাপমাত্রা এতো বেশি ছিল যে বেশিরভাগ পশুপাখির জন্যেই সেরকম উত্তপ্ত পরিবেশে বেঁচে থাকা খুব কঠিন ছিল।
নানা কারণেই এই তাপমাত্রা ঠাণ্ডা ও গরমের মধ্যে ওঠা নামা করেছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এসবের মধ্যে রয়েছে সূর্যের চারপাশে দীর্ঘ সময়ে ধরে প্রদক্ষিণের সময় পৃথিবীর এপাশে ওপাশে নড়ে ওঠা, আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত এবং এল নিনোর মতো জলবায়ু চক্র।
মহাবিলুপ্তির যত ঘটনা
পৃথিবীতে যত প্রজাতির প্রাণী একসময় ছিল, তার ৯৯ শতাংশের বেশি বর্তমানে বিলুপ্ত। প্রাণীদের মধ্যে খুব কম সংখ্যক প্রজাতি এক লক্ষ বছর টিকতে পেরেছিল। বেশিরভাগ প্রাণীই প্রাক-মানব যুগে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এমন সময়ও ছিল যখন বিলুপ্তির হার স্বল্প সময়ের মধ্যে দ্রুত বেড়ে গিয়েছিল এবং পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীর উল্লেখযোগ্য পরিমাণ হারিয়ে গিয়েছে। এই বিলুপ্তির হারকে মহাবিলুপ্তিও বলা যায়।
এমনকি এই যুগের বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন, আমরাও সেরকম বিলুপ্তির যুগেই বাস করছি। বিজ্ঞানীরা সত্যি বলছে কিনা তা বোঝার জন্য আগের মহাবিলুপ্তির ঘটনাগুলোর দিকে তাকালেই পরিষ্কার বোঝা যাবে, যখন বেশিরভাগ প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। সাধারণত বিজ্ঞানীরা সবচেয়ে বড় পাঁচটি বিলুপ্তির কথা বলে থাকেন।
অর্ডোভিসিয়ান যুগ
৪৪৫ মিলিয়ন বছর আগের এই মহাবিলুপ্তি শুরু হয়েছিল জলবায়ু পরিবর্তন অর্থাৎ পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধে বরফ গলে যাওয়ার কারণে। পৃথিবীব্যাপী হিম শীতলতার ফলে বিলুপ্তির এটাই সবচেয়ে বড় ঘটনা। এই মহাবিলুপ্তিতে ট্রাইবিটেস, ব্রাচিওপডস এবং কন্ডোন্টস জাতীয় ইল প্রাণীসহ প্রায় ৫৭ শতাংশ সামুদ্রিক প্রজাতি বিলুপ্ত হয়েছিল।
ডেভোনিয়ান যুগ
৩৮০ মিলিয়ন বছর আগে এই যুগটা শুরু হয়েছিল এবং ২০ মিলিয়ন বছর ধরে প্রাণের এই মহাবিলুপ্তি চলছিল। এই যুগে অনেক ধরনের সামুদ্রিক কোরাল, ট্রাইলোবাইটস, স্পঞ্জেস এবং আরমোর্ড জাতীয় মাছ সহ প্রায় ৫০ শতাংশ প্রজাতির সামুদ্রিক প্রাণী বিলুপ্ত হয়েছিল। সাইবেরিয়া অঞ্চলের ভল্কানিক আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের ফলে প্রাণী প্রজাতির এই মহাবিলুপ্তি ঘটে বলে ধারণা করা হয়। সাধারণত, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এবং সমুদ্রের পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা ঘন ঘন পরিবর্তন হলে বড় ধরনের বিলুপ্তির আশঙ্কা তৈরি হয়।
মধ্য পার্মিয়ান যুগ
বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি ২৬২ মিলিয়ন বছর আগের আরো একটি যুগের সন্ধান পেয়েছেন, যা এটিকে মহা ‘পাঁচ বিলুপ্তির’ মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেছে। বর্তমান গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের কাছাকাছি সেময় এমাইশান অগ্নুৎপাত ফলে প্রাণী প্রজাতির ব্যাপক বিলুপ্তি ঘটে। অতিরিক্ত উষ্ণতা এবং অক্ষাংশের পরিবর্তনের কারণেই এই মহাবিলুপ্তি ঘটেছিল। এই সময়ে ব্র্যাচিওপড এবং একক-কোষবিশিষ্ট বেন্থিক ফোরামিনিফেরা সহ ৮0 শতাংশের বেশি প্রজাতি নিশ্চিহ্ন হয়েছিল।
শেষ পার্মিয়ান যুগ:
প্রায় ২৫২ মিলিয়ন বছর আগে ‘শেষ পার্মিয়ান’ যুগে কমপক্ষে ৯৬ শতাংশ প্রজাতির প্রাণী বিলুপ্ত হয়েছিল। এই মহাবিলুপ্তির যুগে অনেক প্রজাতির ট্রাইলোবাইটস, কোরালস এবং টেরিস্ট্রিয়াল প্রজাতির সকল প্রজাতির প্রাণী বিলুপ্ত হয়েছিল। সাইবেরিয়াতে বেশ বড়সড় একটি অগ্ন্যুৎপাত দ্বারা এই বিলুপ্তির সূচনা হয়েছিল। এটি এত সময় ধরে চলছিল যে, আধুনিক সাইবেরিয়াতেও তার প্রভাব থেকে গিয়েছিল। সমুদ্রে তখন অক্সিজেনের পরিমান উল্লেখযোগ্যহারে কমে গিয়েছিল এবং এসিডের পরিমান বাড়তে থাকায় গ্রীনহাউসের প্রতিক্রিয়া বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়েছিল। এর ফলে সূর্যের ক্ষতিকর আল্ট্রা ভায়োলেট রশ্মী থেকে পৃথিবীকে রক্ষাকারী ওজন স্তরের অনেকাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ওজন স্তরের এই ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে প্রায় দশ মিলিয়ন বছর লেগেছিল এবং এই ভারসাম্যহীন জলবায়ু থেকেই মহা বিলুপ্তিকারক ট্রায়াসিক যুগের সূচনা হয়েছিল।
ট্রায়াসিক যুগ
ট্রায়াসিক যুগ শুরু হয়েছিল ২০১ মিলিয়ন বছর আগে, শেষ পার্মিয়ান যুগের সঙ্গে এই যুগের অনেকাংশে মিল আছে। মধ্য আটলান্টিকের ম্যাগমাটিক প্রদেশের কাছাকাছি একটি বড়সড় বিস্ফোরণ দিয়ে এই মহাবিলুপ্তির সূচনা এবং আটলান্টিক মহাসাগর সৃষ্টির ভীত রচনা হয়েছিল। শেষ পার্মিয়ান যুগের মতো এই যুগের জলবায়ুতেও ক্যাসকেড ইফেক্ট (এক ধরনের অপ্রত্যাশিত ধারাবাহিকতা) দেখা গিয়েছিল, যা ৪৭ শতাংশ সব প্রজাতির প্রাণী বিলুপ্ত করেছিল। এই মহাবিলুপ্তির ফলে কনোডন্টস এর মতো ইয়েল, সেইসঙ্গে সর্বাধিক পরিচিত স্ক্লেরাক্টিনিয়ান কোরালগুলোর বিলুপ্তি ঘটে। স্থলজগতের সরীসৃপ এবং আম্ফিবিয়ানদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে মুছে ফেলেছিল এবং জুরাসিক যুগের ডাইনোসরদের টিকে থাকার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ পাওয়ার পথ তৈরি করে দিয়েছিল।
এসডব্লিউ/এসএস/১২৪৭
আপনার মতামত জানানঃ