নাগরিকদের মৌলিক অধিকার রক্ষায় নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধেও প্রয়োজনে কঠোর হতে পারে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট। বুধবার ফের তারা সেটাই প্রমাণ করলেন। ফোনে আড়ি পাতা কাণ্ডে সরকারের যাবতীয় বক্তব্যকে উড়িয়ে দিয়ে নিরপেক্ষ তদন্তের নির্দেশ দিলেন ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট। সেই সঙ্গে তারা বললেন, শুধুমাত্র জাতীয় নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে নাগরিকদের গোপনীয়তার অধিকার খর্ব করা সংবিধান বরদাস্ত করে না। গণতন্ত্রে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার সুরক্ষিত রাখা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
বিজেপির বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্ট
প্রধান বিচারপতি এন ভি রামানা, বিচারপতি সূর্যকান্ত ও বিচারপতি হিমা কোহলির বেঞ্চ এই প্রসঙ্গে নাগরিকদের গোপনীয়তার অধিকার রক্ষার প্রসঙ্গেও মন্তব্য করেছেন। সুপ্রিম কোর্ট বলেন, শুধু রাজনৈতিক নেতা ও সাংবাদিক নন, গোপনীয়তার অধিকার রয়েছে প্রত্যেকের। সেই অধিকার রক্ষা করা গুরুত্বপূর্ণ। গোপনীয়তার অধিকারে কোনো কোনো সময় রাশ টানা হতে পারে। কিন্তু সরকারের সেই অধিকার সাংবিধানিক বৈধতার ঊর্ধ্বে নয়। এই ধরনের প্রযুক্তির ব্যবহার সংবাদমাধ্যমের অধিকারের ক্ষেত্রে মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে।
ইসরায়েলের সংস্থা পেগাসাস সফটওয়্যারের মাধ্যমে রাজনীতিবিদ, শিল্পপতি, বিচারপতি, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশার শ-তিনেক নাগরিকের ফোনে আড়ি পাতার অভিযোগে কড়া অবস্থান নিলেন ভারতের সর্বোচ্চ আদালত। তারা এদিন বুঝিয়ে দেন, সরকারে বেআইনি কার্যকলাপের অভিযোগ শুনে আদালত কখনো নিরব দর্শক থাকতে পারে না।
তাই সরকারের বক্তব্যে সন্তুষ্ট না হয়ে আদালত নিজেই তদন্তের নির্দেশ দিলেন। সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতির নেতৃত্বে তথ্য প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত কমিশনই এই তদন্ত রিপোর্ট দেবেন। সরকার তদন্ত করতে চাইলেও সেই আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন আদালত।
ভারতের প্রধান বিচারপতি এন ভি রামানা বলেন, গণতন্ত্রে নাগরিকদের ওপর নজরদারির কোনও অধিকার সরকারের থাকতে পারে না। ব্যক্তিগত গোপনীয়তার ওপর আক্রমণে সাংবিধানিক বৈধতা নেই। তা ছাড়া প্রযুক্তির ব্যবহার জীবনযাপন সুন্দর করে তোলার জন্যই ব্যবহার করা উচিত বলেও সুপ্রিম কোর্ট মন্তব্য করেন। ৮ সপ্তাহ পরে পেগাসাস মামলার ফের শুনানি হবে শীর্ষ আদালতে।
ভারতের প্রধান বিচারপতি এন ভি রামানা বলেন, গণতন্ত্রে নাগরিকদের ওপর নজরদারির কোনও অধিকার সরকারের থাকতে পারে না। ব্যক্তিগত গোপনীয়তার ওপর আক্রমণে সাংবিধানিক বৈধতা নেই। তা ছাড়া প্রযুক্তির ব্যবহার জীবনযাপন সুন্দর করে তোলার জন্যই ব্যবহার করা উচিত বলেও সুপ্রিম কোর্ট মন্তব্য করেন।
প্রধান বিচারপতি এনভি রামানা, বিচারপতি সূর্য কান্ত এবং বিচারপতি হিমা কোহলি জানিয়ে দেন রাষ্ট্র নাগরিকদের মৌলিক অধিকার খর্ব করলে তারা চুপ করে বসে থাকতে পারেন না। সেই সঙ্গে সরকারের বক্তব্যের মধ্যেও যে ধোঁয়াশা রয়েছে সেটাও এদিন স্পষ্ট করে দেন তারা। জাতীয় স্বার্থ বা নিরাপত্তার কথা বলে রাষ্ট্রের যা খুশি তাই করার ইচ্ছাতেও লাগাম টানেন সুপ্রিম কোর্ট।
এদিনের রায়ে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের মর্যাদা অনেকটাই বাড়ল বলে মনে করছেন আইনজ্ঞরা। গতকালও ভারতের সুপ্রিম কোর্ট কৃষক আন্দোলনে প্রতিমন্ত্রীর পুত্রের গাড়ি চাপার ঘটনা নিয়ে সরকারি তদন্তে অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। আবার বেলাগাম কৃষক আন্দোলনের জেরে অনির্দিষ্টকালের জন্য সড়ক অবরোধের সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন।
সুপ্রিম কোর্টের এ দিনের নির্দেশকে স্বাগত জানিয়েছে প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস। দলের মুখপাত্র রণদীপ সুরজেওয়ালার মতে, ছদ্ম জাতীয়তাবাদ সর্বত্র কাপুরুষ স্বৈরতন্ত্রীদের শেষ ভরসা। তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল ঘোষের দাবি, তদন্তের স্বার্থে পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দলনেতা কুণাল ঘোষকে গ্রেপ্তার করতে হবে। কারণ শুভেন্দু বলেছিলেন, সব ফোন, কললিস্ট, রেকর্ডিং ওর কাছে আসে।
উল্লেখ্য, পেগাসাস কেলেঙ্কারি নিয়ে সমস্ত বিরোধী দল এক জোট হয়ে ভারতের জাতীয় সংসদের অধিবেশনে সোচ্চার হন। প্রতিদিনই বিঘ্নিত হয় সভার কাজ। ভারতের স্বরাষ্ট্রামানা্ত্রী বিরোধীদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ করেছিলেন। কিন্তু সর্বোচ্চ আদালতে আজকের নির্দেশে উজ্জীবিত বিরোধীরাও।
পেগাসাসে কুপোকাত বিজেপি
ইসরায়েলের এনএসওর তৈরি পেগাসাস প্রযুক্তির সাহায্যে ভারত সরকার সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, বিচারপতি, রাজনৈতিক নেতাসহ বহু সাধারণ মানুষের ফোনে আড়ি পেতেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। দুই বছর আগে, ২০১৯ সালে এই অভিযোগ প্রথমবার ওঠার পর সরকার সংসদে জানিয়েছিল, আইনবহির্ভূত কিছু করা হয়নি।
সম্প্রতি বিশ্বের প্রথম সারির ১৬টি দেশের সাংবাদিকদের এক সংগঠন তদন্ত শেষে জানায়, কীভাবে বিভিন্ন দেশের সরকার এই প্রযুক্তির সাহায্যে সাধারণ নাগরিকদের ওপর নজরদারি চালাচ্ছে। সেই তদন্ত প্রতিবেদনে ভারতের অনেক বিচারপতি, সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, সমাজসেবী, রাজনৈতিক নেতার নাম উল্লেখ করা হয়, যাদের ফোনে ওই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও এ অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করে। এই প্রতিবেদন জানাজানি হওয়ার পর বিভিন্ন সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতা, এডিটরস গিল্ডের পক্ষ থেকে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করে বলা হয়, সর্বোচ্চ আদালত এই বিষয়ে হস্তক্ষেপ করুন। তদন্তের নির্দেশ দিন।
সেই আবেদনে সাড়া দেওয়ার আগে সুপ্রিম কোর্ট ভারত সরকারকে অভিযোগ অস্বীকার করার সুযোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু সরকার বারবার বলেছে, আইনের বাইরে গিয়ে কিছু করা হয়নি। সরকার যে পেগাসাস প্রযুক্তি কিনেছে, তাও স্পষ্ট করে বলেনি। শুনানির সময় শুধু বলেছে, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার স্বার্থে কোন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়, তা বলা যাবে না। কেননা, তাতে সন্ত্রাসীদের সাহায্য করা হবে।
অভিযোগের সারবত্তা খতিয়ে দেখতে সরকার নিজে থেকে বিশেষজ্ঞ কমিটি গড়ার প্রস্তাব সুপ্রিম কোর্টকে দিয়েছিল। সর্বোচ্চ আদালত তাও মানেননি। আজ সেই প্রসঙ্গে প্রধান বিচারপতি বলেন, সরকারকে অনেক সুযোগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারা ভাসা ভাসা অস্বীকার ছাড়া কিছুই বলতে পারেনি। বারবার রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে পার পাওয়া যায় না। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আদালত হস্তক্ষেপ করতে চান না। কিন্তু তাই বলে নীরব দর্শক সেজেও থাকতে পারেন না। প্রধান বিচারপতি এ কথাও বলেন, সরকারকে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের অনুমতি দিলে তা ন্যায়বিচারের নীতির পরিপন্থী হতো।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩৩৫
আপনার মতামত জানানঃ