বিশ্বের নিম্ন ও মধ্যম আয়ের অন্যান্য দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও বাড়ছে স্ট্রোকে আক্রান্তের সংখ্যা। দেশে প্রতি বছর হাজারে ১১ দশমিক ৪ জন রোগী স্ট্রোকে আক্রান্ত হয় বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নিউরোসায়েন্স বিভাগ। সে হিসাবে দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ধরলে বছরে স্ট্রোকে আক্রান্ত হন ১৮ লাখ ২৪ হাজারের বেশি রোগী। দেশে ৬৪ জেলা থেকে স্ট্রোকের রোগীর নমুনা সংগ্রহ করে গবেষণার পর এমন তথ্য জানিয়েছে বিভাগটি।
গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে সবচেয়ে বেশি স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগী ময়মনসিংহ ও খুলনা বিভাগে। দুটি বিভাগে এই হার সর্বোচ্চ হাজারে ১৪ জন করে। অন্যদিকে উত্তরবঙ্গের রাজশাহী বিভাগে স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগীর হার সবচেয়ে কম পাওয়া গেছে। বিভাগটিতে এই হার ৭ দশমিক ৪০।
আজ বুধবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে বিশ্ব স্ট্রোক দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক কর্মশালায় এই তথ্য জানানো হয়েছে। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢামেকের নিউরোসায়েন্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শফিকুল ইসলাম।
অধ্যাপক শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘নানা কারণে স্ট্রোকে আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। তবে উচ্চ রক্তচাপের কারণে মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে স্ট্রোক হয়, যা অন্যতম প্রধান কারণ। বিশেষ করে অনিয়ন্ত্রিত রক্তচাপ থাকলে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে।’
অধ্যাপক শফিকুল ইসলাম আরও বলেন, ‘প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ ভালো। স্ট্রোক সম্পূর্ণ প্রতিরোধ ও নিরাময়যোগ্য। স্ট্রোকের ঝুঁকি এড়াতে ফাস্ট ফুড ও ধূমপান ত্যাগ করা, ব্লাড পেশার আর সুগার থাকলে তা নিয়ন্ত্রণে রাখা, নিয়মিত ব্যায়াম করা, লক্ষণ দেখার সঙ্গে সঙ্গে অবহেলা না করে হাসপাতালে নেওয়া ও সর্বোপরি জনসচেতনতা গুরুত্বপূর্ণ।’
এই অধ্যাপক বলেন, ‘স্ট্রোকের চিকিৎসার ক্ষেত্রে ঢামেক অনেক অগ্রসর হয়েছে। এই রোগের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু করা হচ্ছে। ১৯৮০ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ইউরোপ ও আমেরিকাতে স্ট্রোকের ৪২ শতাংশ রোগী কমেছে। কিন্তু অনুন্নত ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে এই রোগ শতভাগ বেড়েছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে সবচেয়ে বেশি স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগী ময়মনসিংহ ও খুলনা বিভাগে। দুটি বিভাগে এই হার সর্বোচ্চ হাজারে ১৪ জন করে। অন্যদিকে উত্তরবঙ্গের রাজশাহী বিভাগে স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগীর হার সবচেয়ে কম পাওয়া গেছে। বিভাগটিতে এই হার ৭ দশমিক ৪০।
ঢামেকের নিউরোসায়েন্স বিভাগের আরেক সহযোগী অধ্যাপক ডা. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘প্রতিদিন অপারেশন লাগবে এমন ১০ জনের বেশি স্ট্রোকের রোগী আসে এই হাসপাতালে। তবে দুই-তিনজনের সার্জারি করা সম্ভব হয়। আমরা চাই ১০ জনকেই সময়মতো সার্জারি করাতে। কিন্তু সেই সুবিধা এই মুহূর্তে নেই। স্ট্রোক রোগীদের আইসিইউ ও এসডিইউ অনেক বেশি প্রয়োজন। তবে ঢামেকে এখনো বসানো সম্ভব হয়নি। এটা দ্রুত সময়ের মধ্যে বসানোর ব্যবস্থা নিলে দুর্ভোগ কমবে।’
নিউরোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আহমেদ হোসাইন চৌধুরী বলেন, ‘রোগীর সঠিক সময়ে চিকিৎসা নিশ্চিতে নিউরোলজি বিভাগের একটি আইসিইউ ইউনিট খুলতে হবে। তাহলে অনেক রোগীর জীবন বাঁচানো সম্ভব হবে। এ জন্য সবার মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন।’
স্ট্রোকের লক্ষণ মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়া, চোখে ঘোর দেখা, চেহারা পরিবর্তন হওয়া, বাহু অবশ হওয়া, কথা বলার সময় জড়তা চলে আসা ইত্যাদি। এসব লক্ষণ দেখা দিলে সঠিক সময়ে (৩ থেকে ৪ ঘণ্টার) মধ্যে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকেরা।
এদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সবশেষ তথ্যমতে, স্ট্রোকে মৃত্যু বিশ্বে দ্বিতীয়। আর বাংলাদেশে তৃতীয়। বিশ্বে প্রতি বছর দেড় কোটি মানুষ স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ মারা যায়, সমমান পরিমাণ অক্ষম ও সুস্থ হয়।
বিশ্বে যেসব অসংক্রামক ব্যাধি আছে, তার মধ্যে হৃদ্রোগের পরেই স্ট্রোকের অবস্থান। এ ছাড়া পঙ্গুত্ব বা শারীরিক অক্ষমতার জন্য স্ট্রোক বেশি দায়ী। বিশ্বে বছরে দেড় কোটি মানুষ স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে মারা যান ৫০ লাখ। একই সংখ্যক মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করেন। প্রতি ছয়জন সুস্থ ব্যক্তির মধ্যে একজন স্ট্রোকের ঝুঁকিতে আছেন। উন্নত বিশ্বের চেয়ে নিম্ন আয়ের দেশে ঝুঁকি বেশি।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্ট্রোকের ঝুঁকিও বাড়ে। বয়স ৪০–এর পর থেকেই ঝুঁকি বাড়তে থাকে। নারীর চেয়ে পুরুষের ঝুঁকি বেশি। এটা বংশগত কারণেও হতে পারে। এ ছাড়া অনিয়ন্ত্রিত জীবযাপনের কারণেও হতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, স্ট্রোক হঠাৎ করেই ঘটে যায়। তাই এর চিকিৎসাও সঙ্গে সঙ্গে দিতে হবে। স্ট্রোকের লক্ষণ দেখা দিলে রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে এবং প্রথমে মাথার সিটি স্ক্যান করতে হবে। তাহলে ধরা পড়বে এটি কোন ধরনের স্ট্রোক। স্ট্রোক হয়ে গেলে একটি পরিবারকে ভুগতে হয়। তাই এই রোগটিকে প্রাথমিক অবস্থাতেই শনাক্ত করে চিকিৎসা শুরু করতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০০৬
আপনার মতামত জানানঃ