বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা চলমান কয়েকটি মামলা সম্পর্কে জানতে চেয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। গত মঙ্গলবার ব্রাসেলসে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে এক বৈঠকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক উইগ্যান্ড গুনার এ বিষয়ে জানতে চান।
এ সময় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে ইইউ জানায় ওই আইনের কয়েকটি ধারা ডিজিটাল অপরাধ দমনের থেকে অন্য কাজে বেশি ব্যবহার হচ্ছে। পাশাপাশি গত ইউনিভার্সাল পিরিওডিক রিভিউতে বাংলাদেশ যেসব সুপারিশ বাস্তবায়নে সম্মত হয়েছিল সেগুলোর পূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য ইইউ উৎসাহ প্রদান করেছে।
এ ছাড়া কোভিড-পরবর্তী পরিস্থিতিতে গণতান্ত্রিক সুশাসন শক্তিশালীর বিষয়ে উভয়পক্ষ একমত হয়েছে। পাশাপাশি সম্প্রতি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ওপর হামলার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে উভয়পক্ষ সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও যেকোনও ধরনের বৈষম্যের প্রতি নিন্দা জানায়।
শোষণের হাতিয়ার
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিভিন্ন ধারায় হয়রানির সুযোগ আছে উল্লেখ করে সাংবাদিক, সুশীল সমাজ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষ থেকে শুরু থেকেই আইনটি নিয়ে আপত্তি ছিল। দেখা যাচ্ছে, আইনটি কার্যকর হওয়ার পর মাত্র তিন বছরেই শত শত মামলায় বহু মানুষকে জেল খাটতে হয়েছে।
এ আইনের ৪৩ ধারায় আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বিনা পরোয়ানায় তল্লাশি, জব্দ এবং আটকের অসীম ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। আর আইনে ব্যাক্তি বা রাষ্ট্রের ভাবমূর্তী ক্ষুণ্ন করা, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত বা উস্কানি, মানহানিকর তথ্য প্রচার ও প্রকাশ এবং আইন শৃঙ্খলার অবনতির মতো বিষয়গুলোতে বিভিন্ন ধারায় অপরাধ ও শাস্তির বিধান রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে ভুল ব্যাখ্যার সুযোগ রয়েছে বলে মনে করেন অনেকে এবং হচ্ছেও।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহনাজ হুদা বলেন, সংবিধানে নাগরিকদের স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার দিয়েছে। যেখানে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অনেক ক্ষেত্রে মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব হচ্ছে।
তিনি বলেন, “সবার মধ্যে একটা ভীতি যে এইটা বললে কী হবে! এবং আমরাও বলি যে এতকিছু বলো না তোমার বিপদ হবে। এটা স্বাধীন দেশে আমরা কেন করবো? এটা কিন্তু বেশ স্বার্থকভাবে সরকার করে ফেলেছে। সেল্ফ সেন্সরশিপ একটা ভীতি প্রদর্শন, ভীতি মানুষের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া।”
এর আগেও ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের চারটি ধারা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এবং ১০টি দেশ৷ তারা মনে করে, ওই চারটি ধারা বাকস্বাধীনতা এবং স্বাধীন মত প্রকাশকে বাধাগ্রস্ত করবে৷
কী আছে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের ৪টি ধারায়
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১ ধারা:
যদি কোনো ব্যাক্তি ডিজিটাল মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা জাতির পিতার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রপাগান্ডা বা প্রচারনা চালায় বা উহাতে মদত প্রদান করেন, তাহলে অনধিক ১৪ বছর কারাদণ্ড, এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন৷
যদি কেউ এই অপরাধ দ্বিতীয়বার বা পূনঃ পুনঃ সংঘটন করেন, তাহলে তিনি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা তিন কোটি টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন৷
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫ ধারা:
যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রিক বিন্যাসে,- (ক) ইচ্ছাকৃতভাবে বা অজ্ঞাতসারে, এমন কোনো তথ্য প্রেরণ করেন যা আক্রমণাত্মক বা ভীতি প্রদর্শক, (খ) এমন কোনো তথ্য সম্প্রচার বা প্রকাশ করেন, যা কোনো ব্যক্তিকে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ করিতে পারে (গ) মিথ্যা বলে জানা থাকা সত্ত্বেও কোনো ব্যক্তিকে বিরক্ত, অপমান, অপদস্ত বা হেয় প্রতিপন্ন করবার অভিপ্রায়ে কোনো তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ, প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, বা (ঘ) রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি বা সুনাম ক্ষুন্ন করবার, বা বিভ্রান্তি ছড়াবার উদ্দেশ্যে, অপপ্রচার বা মিথ্যা বলে জানা থাকা সত্বেও কোনো তথ্য সম্পূর্ন বা আংশিক বিকৃত আকারে প্রকাশ, প্রচার বা সম্প্রচার করেন বা করতে সহায়তা করেন, তাহলে তিন বছরের কারাদণ্ড অথবা তিন লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন৷ এই অপরাধ যদি দ্বিতীয় বার বা পুনঃ পুনঃ সংঘটন করেন, তাহা হইলে তিনি পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন৷
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৮ ধারা:
ওয়েবসাইটে বা কোনো ইলেকট্রিক বিন্যাসে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করে এমন কোনো তথ্য প্রকাশ, সম্প্রচার ইত্যাদি।
(১) যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করবার উদ্দেশ্যে ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন বা করান, যা ধর্মীয় অনুভূতি বা ধর্মীয় মূল্যবোধের উপর আঘাত করে, তাহলে তিনি সাত বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন৷ এই অপরাধ যদি একই ব্যক্তি দ্বিতীয়বার বা পুনঃ পুনঃ সংঘটন করেন, তাহলে দশ বছরের কারাদণ্ড বা ২০ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন৷
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩৫ ধারা:
যদি কোনো ব্যক্তি এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ সংঘটনে সহায়তা করেন, তাহলে সেটাও অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে৷ অপরাধ সংঘটনে সহায়তা করার অপরাধের ক্ষেত্রে মূল অপরাধটির জন্য যে দণ্ড নির্ধারিত রয়েছে, সহয়তাকারী ব্যক্তি সেই একই দণ্ডে দণ্ডিত হবেন৷
এসডব্লিউ/এসএস/১৫০৮
আপনার মতামত জানানঃ